Published : 21 May 2020, 10:39 PM
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে অধিকাংশ মানুষ। কারণ এটি এমন এক ছোঁয়াচে রোগ যে আপনি নিজে সচেতন হলেই হবে না, আপনার আশেপাশের মানুষদেরও করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সমান সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। কিন্তু সরকারের এত নির্দেশনা সত্ত্বেও বাজারে বা রাস্তায় বের হলেই মনে হচ্ছে বাংলাদেশে কোনও সংক্রমণ নেই। গত কয়েকদিন মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ও মাওয়া ফেরিঘাটে মানুষের জনসমাগম দেখে মনে হয়েছে ঈদের আগের দিন। হুড়োহুড়ি করে ফেরিতে কোনো রকমে মানুষ নিজের জায়গা করে নিয়েছে; এরপর গাদাগাদি করেই পার হয়েছে পদ্মা। এছাড়াও ঢাকার বিপণী বিতান এবং ঢাকার ফুটপাথে ক্রেতাদের ভিড় লক্ষণীয়। মানুষকে কার্যকর লকডাউন ছাড়া কোনভাবেই ঘরে রাখা যাবে না বলেই প্রতীয়মান হয়।
সরকার সাধারণ ছুটি কয়েকবার বর্ধিত করেছে। কেন করেছে? কারণ যাতে মানুষ ঘরে থাকে। চাকরিজীবীরা ঘরে থাকলেও অন্য মানুষ রাস্তায় বের হচ্ছে। তাই তারা সচেতন হলেই হবে না। বিশ্লেষকের মতে মে মাসের শেষ সপ্তাহ করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পিক টাইম, তাই সরকারকে গভীরভাবে চিন্তা করে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় খুবই খারাপ পরিণতি হতে পারে। দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সাথে সাথে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। মাঝে কিছুটা মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস পেলেও এই সপ্তাহ থেকে সেটা আবার ঊর্ধ্বমুখী এবং ভবিষ্যতে তা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। টেস্ট এবং শনাক্তের হার বিশ্লেষণ করলে তা উপলদ্ধি করা যায়।
গত ১৯ মে তারিখেও ২৪ ঘণ্টায় ৮,৪৪৯ নমুনা পরীক্ষা করা হয় এবং করোনায় সংক্রমিত হয় ১ হাজার ২৫১ জন। এক্ষেত্রে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্তের হার প্রায় ১৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। বর্তমানে জনসংখ্যা হল ১৬ দশমিক ৫২ কোটি, সুতরাং ১৪ দশমিক ৮১ শতাংশ হারে করোনাভাইরাস আক্রান্তের আশঙ্কায় রয়েছে ২কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এত শক্তিশালী নয় যে এত রোগী সামাল দেওয়া বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে। আমাদের লকডাউন পলিসি তেমন কাজে দেয়নি। কারণ আমরা তো সচেতন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যে সব পদক্ষেপ নিয়েছেন,তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। তিনি খুবই বিচক্ষণ ও সুদৃঢ় পরিকল্পনার সহিত করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছেন। অন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর যদি অনুরূপ দক্ষতার সাথে কাজ করতো তাহলে আমাদের দেশের অবস্থা এরকম নাও হতে পারত। কিন্তু অন্যান্য দপ্তর তেমন কোন কাজের অগ্রগতি দেখাতে পারেননি।
দেশে ১৯ মে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩৭০ জন। মূলত সংক্রমণ শুরুর দশম সপ্তাহে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষ এবং মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। ১৯ মে পর্যন্ত দশম সপ্তাহের প্রতিদিনই মৃত্যুর সংখ্যা ১০-এর ওপরে ছিল, যা আগে দেখা যায়নি। এখন প্রতিদিন রোগী শনাক্ত আগের তুলনায় বেশি। গত পাঁচ দিনে ৬ হাজার ২৫৮ রোগী শনাক্ত করা হয়।
তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০ ছাড়ায় ১৫ এপ্রিল, সংক্রমণ শনাক্তের ৩৯তম দিনে। ৪৫ দিনে এসে মৃত্যুর সংখ্যা পোঁছায় ১০০। পরবর্তী সাত দিনের ব্যবধানে মৃত্যুর সংখ্যা হয় ১৫০। এরপর মৃত্যু ১৫০ থেকে ২০০ ছাড়াতে সময় লেগেছে ১১ দিন। আর ২০০ থেকে ৩৭০ মৃত্যুর সংখ্যা হয়েছে মাত্র ১০ দিন। ১৯.০৫.২০২০ তারিখ পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃত্যুর হার প্রায় ১.৫০ শতাংশ। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর হার কম। নেপাল, ভুটান এবং মালদ্বীপ এর সাথে তুলনা করলে আমাদের অবস্থা খারাপ। তবে ভারত এবং পাকিস্তানে বাংলাদেশের চেয়ে আগে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ শুরু হয়।
গণমাধ্যমে জানতে পারি ভারত ও পাকিস্তান ছাড়িয়ে মাত্র দুই মাসেই করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ এখন 'এশিয়ার হটস্পট'। এটা আমাদের জন্য মারাত্বক হুমকিতে পরিণত হয়েছে। কিছুদিন পূর্বেই করোনাভাইরাস সংক্রমণে এশিয়ার হটস্পট ছিল পাকিস্তান। তারপর পাকিস্তাকে টপকে সেই স্থান দখল করে ভারত। তবে বর্তমানে ভারত ও পাকিস্থানকে পেছনে ফেলে শীর্ষ স্থানে বাংলাদেশ।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে করোনায় সংক্রমণের হার বাড়লেও পরীক্ষার হার এখনও অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। তাই 'পিক টাইম' এ লকডাউন শিথিল করা কতটুকু ঠিক হয়েছে, তা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন ও ভয় রয়েছে। কার্যত বাংলাদেশে কখনও কিন্তু কার্যকর লকডাউন ছিল না।
দেশে লকডাউন নেই বলা যায়। গণপরিবহন ছাড়া সব ধরনের যানবাহনের দেখা মিলছে সড়কে। বাজারে কিংবা সব জায়গায় মানুষের আনাগোনা আগের মত হয়ে যাচ্ছে। কাঁচাবাজারসহ ওষুধের দোকান তো আগেই খোলা ছিল, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অন্যান্য দোকানপাটও। বাজারে দেখা যাচ্ছে লোকজনের ভিড়। রাজধানীতে ফিরে এসেছে আগের চিরচেনা রূপ। সড়কে শুরু হয়েছে যানজট। ফলে ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছে দেশের পরিস্থিতি। প্রথম মাসে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ৪০-৫০ এর উপরে ওঠেনি। আর এখন প্রায় প্রতিদিনই করোনাভাইরাসে সংক্রমণের সংখ্যা হাজার বা হাজারের বেশি হচ্ছে।
আমাদের দেশে বাজার যেভাবে গড়ে উঠছে, তা আমরা সবাই অবগত। আপনি নিজে ইচ্ছে করলেও সতর্ক থাকা যাবে না। মানুষ শারীরিক দূরত্ব না মেনে আপনার কাছে এসে দাঁড়াবে। এটা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। দোকানগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে মানুষ গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে বাজার করছে। নেই মাস্ক ও অনন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা দ্রবাদি। বাজার সমস্যা সমাধানে তাই আমি মনে করি যে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির মত সকল এলাকায় বিকল্প বাজার ব্যবস্থা চালু হলে মানুষ এই করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেত। বিকল্প বাজার ব্যবস্থায় ভ্রাম্যমাণ গাড়ি প্রতিদিন একবার প্রত্যেক এলাকায় যেতে পারে। সময় আগেই থেকে নির্ধারিত করা থাকতে পারে, মানুষ ওই সময় অনুযায়ী প্রত্যেক পরিবারকে ৫-১০ মিনিট সময় নির্দিষ্ট করে দিবে, তার মধ্য বাজার শেষ করতে হবে। একই সাথেই এক পরিবারকে বাজার করার সুযোগ দিতে হবে। এক পরিবারের শেষ হলে অন্য পরিবারের লোক বাজার করতে পারবে।
ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে মুদির দোকানের সব দ্রবাদি রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া অনলাইন সিস্টেম চালু করা যায়। যেমন আগের দিন অনলাইনে অর্ডার দিবে এবং মোবাইল নম্বরসহ ঠিকানা দিবে। গাড়ি বাসার নিচে এসে কল দিবে অথবা বাঁশি বাজাবে। গ্রাহক এসে বাজার নিয়ে যাবে এবং এতে আরও সময় কম লাগবে। কারণ দ্রব্যাদি তো রাতে প্যাকেট করে রাখবে এবং সকালে শুধু গাড়িতে লোড করবে। এর বিনিময়ে কিছু সার্ভিস চার্জ নিবে। সরকার এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে দেশবাসী অনেক উপকৃত হবে এবং সেই সাথে সাথে করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন কমে যাবে বলে বিশ্বাস করি। যারা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য বাজারে যেত, এতে তাদের এখন যেতে হবে না। যদিও বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় কিছু জায়গায় ভ্যানে করে কাঁচাবাজার বিক্রি করে থাকে কিছু দোকানদার। কিন্তু তা সব জায়গায় নেই। এই সময়ে এ ধারণার সঠিক ও ব্যাপক বাস্তবায়ন দরকার।
সৌদি আরবে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলেও মৃত্যুর সংখ্যা কম। তারপরও করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে ঈদুল ফিতরের ছুটিতে সৌদি আরবজুড়ে ২৪ ঘণ্টার কারফিউ জারি করার খবর সংবাদপত্রে এসেছে। কারণ ঈদের সময় মানুষের চলাফেরা বেশি হওয়ার কথা। মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। আমাদের দেশে সরকারি ছুটি ৩০ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সাধারণত ঈদের তিন দিন ছুটি থাকে। এই বছর আরও বেশি ছুটি ভোগ করবে চাকরিজীবীরা।
যেখানে অন্য মুসলিম দেশ কারফিউ দিতে পারে আমরা সেখানে কার্যকর লকডাউন দিতে পারি। ফলে রাস্তায় মানুষের সমাগম অনেক কমে যাবে। যা করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে আমাদেরকে রক্ষা করতে পারে। কার্যকর লকডাউন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে আলোচনা চলমান যে সরকার এই পদক্ষেপ নিলে হয়তোবা করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার কমে যাবে। তাই সরকার ঈদের আগে-পরে মিলিয়ে ১০-১৫ দিন এ বিষয়ে ভেবে দেখতে পারে। এমনিই ঈদের আগে এবং পরে শিল্প কারখানায় কাজ কম হয়ে থাকে। তাই অযথা যাতে জনসমাগম করোনাভাইরাস বিস্তার করতে না পারে তার জন্য এখনই চিন্তাভাবনা করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।