Published : 18 May 2020, 09:31 PM
অর্থনৈতিক উন্নতির নিরিখে বাংলাদেশের অগ্রগতি চোখে পড়ার মত। যে দেশের পাঁচ ভাগের চার ভাগ মানুষ স্বাধিনতার প্রাক্কালে দারিদ্র্যসীমার মধ্যে বসবাস করত সেই দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ১৯০৯ মার্কিন ডলারের উপরে, গত বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক১৫ শতাংশ। দশ বছর যাবত আমাদের প্রবৃদ্ধি টেকসই যেটা ১৯৭১ সালের পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ অর্থনীতির চিত্রের সাথে মিলালে অবাক বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। আমাদের জিডিপির আকার বেড়েছে, জিডিপিতে শিল্প ও সেবা খাতের অবদান বেড়েছে, স্বাস্থ্যে উন্নতি হয়েছে, শিশু-মৃত্যুহার কমেছে, মাতৃ মৃত্যুহার কমেছে, মাথাপ্রতি খাদ্যগ্রহণের হার বেড়েছে, শিক্ষার হার, গড় আয়ু ও শিক্ষার হার বেড়েছে, রপ্তানি ও রেমিটেন্স আয় বেড়েছে, বৈশ্বিকভাবে আমাদের ইমেজ বেড়েছে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ ২০১৯ বলছে গত এক দশক ধরে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের। দ্রুত যেসব দেশের রপ্তানি বাড়ছে, বাংলাদেশ তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয়, প্রথম হচ্ছে ভিয়েতনাম। বাংলাদেশ বিশ্বে ৪২ তম বড় রপ্তানিকারক দেশ। মোটকথা বাংলাদেশকে অবহেলা করা বা কম গুরুত্ব দেয়ার দিন গত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি যথেষ্ট উন্নতি করেছি নাকি আরও উপরে যেতে পারতাম কিন্তু পারলাম না- দুর্নীতি, জবাবদিহিতা ও সুশাসনের অভাব কি আমাদের পেছনে টেনে রেখেছে?
তাত্ত্বিকভাবে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে সেই ধ্রুপদী (Classical) অর্থনীতিবিদদের আমল থেকে। ধ্রুপদী অর্থনীতির জনক বলে খ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ (১৭২৩-১৭৯০) কর্তৃক ১৭৭৬ সালে রচিত 'An Enguiry into the Nature and causes of wealth of Nations' নামক গ্রন্থে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমস্যা নিয়ে আলোচনার প্রয়াস পান। সেখান থেকে শুরু করে আধুনিক অর্থনীতিবিদরা পর্যন্ত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি নিয়ে নানাবিধ আলোচনা করেছেন। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন হয়েছে। একটা সময় ছিল, যখন মনে করা হতো, কোনো দেশের জাতীয় আয় যদি চলমানভাবে ৫ থেকে ৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এর ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটে তাহলে বুঝতে হবে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংঘটিত হয়েছে। তখন মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও কাঠামোগত পরিবর্তনকে উন্নয়নের পরিমাপক হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। এটি সনাতন একটি ধারণা যা বহাল থেকেছে অনেক দিন পর্যন্ত।
যাহোক, গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের দিকে উন্নয়ন অর্থনীতিবিদরা অর্থনীতির কিছু অনুষঙ্গ দেখে হোঁচট খেলেন। তারা দেখলেন উন্নয়নশীল দেশগুলোর শতকরা ৪০ ভাগেরও বেশি লোকজন অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনো সুফল বা কল্যাণ ভোগ করতে পারেনি। তখন তারা জাতীয় আয় বৃদ্ধিভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণা থেকে অন্যত্র দৃষ্টি ফেরালেন। সত্তরের দশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণাকে তারা প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পুনঃবণ্টনের দৃষ্টিকোণ থেকে পুনর্ব্যাখ্যা প্রদান করলেন। এই মতবাদের প্রবক্তাদের অন্যতম ডাডলি সিয়ার্স (Dudley Seers)। তিনি দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অসমতার প্রসঙ্গ আনলেন। তার মতে, যদি এ তিনটি সূচক উঁচুস্তর থেকে একটা সময়ের ব্যবধানে নিচুস্তরে নেমে আসে, তবে সন্দেহাতীতভাবে সংশ্লিষ্ট দেশটির উন্নয়ন হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। মাথাপিছু আয় যদি দ্বিগুণও হয়, আর দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অসমতা যদি সামাজিকভাবে বা স্বতন্ত্রভাবে বেড়ে যায় কিংবা আংশিকভাবে বেড়ে যায় তবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে বলা যাবে না।
সময়ের পরিক্রমায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের সংজ্ঞা আধুনিক রূপ ধারণ করেছে। আধুনিক এ ধারণায় শুধু আর্থিক উপাদানকে বিবেচনা করা হয়নি বরং সামাজিক ও কল্যাণের দিকটিও বিবেচনা করা হয়েছে।
মাইকেল টোডারো আধুনিক এ ধারার অর্থনীতিবিদ। তাঁর মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলো একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সামাজিক কাঠামো ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন ঘটে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়, অর্থনৈতিক-সামাজিক বৈষম্য ও দারিদ্র্য দূর হয় এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে সামগ্রিক সামাজিক কাঠামোতে পরিবর্তন ঘটবে। যার ফলে মানুষের মৌলিক চাহিদা মিটবে এবং মানুষের জীবনযাত্রার আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের পরিবর্তন আসবে।
উপরের নিতান্ত তাত্ত্বিক আলোচনায় আমরা দেখলাম অর্থনীতি ক্রমাগতভাবে তার পরিসরকে ব্যাপকতার সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে। মাথাপিছু আয় থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্পৃক্ততা মানুষের জীবনযাত্রায় আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের সীমা পর্যন্ত ব্যাপৃত হয়েছে। এখন যদি জাতীয় আয় আকাশ স্পর্শ করে অথচ মানুষ মানবিক সুবিধাবঞ্চিত, অবনতিশীল হয়; সন্ত্রাস দুর্নীতিতে জাতি আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকে, মানবতা যদি পদে পদে লাঞ্ছিত হয়, দেশে মানবাধিকার অব্যাহতভাবে লঙ্ঘিত হয়, কালো অর্থনীতি দিন দিন ব্যাপকতর হয়, তবে দেশে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে_ এমনটি বলা যাবে না। এখন আবশ্যিকভাবে উন্নয়নের সঙ্গে সামাজিক শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক পরিবেশ সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। কারণ রাজনীতি অর্থনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, প্রভাবান্বিতকরণে ও বিকাশে ব্যাপকতর ভূমিকা রাখে।
আমাদের সমাজে দুর্নীতি একটা সামাজিক ক্যান্সারের রূপ পরিগ্রহ করেছে। ক্যান্সার যেমন কোনো ব্যক্তিকে মৃত্যুর দেশে পাঠিয়ে তারপর শান্ত হয়; দুর্নীতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা, জবাবদিহিতার অভাব, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লুটপাট- এসব সামাজিক ক্ষত দেশটাকে তথা সামগ্রিক অর্থনীতিকে পঙ্গু না করে শান্ত হবে বলে মনে হয় না। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন, হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার, সামাজিক ও রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা, খুন, রাহাজানি, দেশি-বিদেশি কেলেঙ্কারি বিশ্বের মানুষকে বা সচেতন মহলকে দেশটি ও তার অর্থনীতি, রাজনীতি সংক্রান্ত যে বার্তা দেয় তা মোটেও সুখকর ও স্বস্তিদায়ক নয়। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণেও মানুষের মন থেকে, সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে- দুর্নীতির ভাইরাস উৎপাটিত হচ্ছে না, চুরির প্রকোপ কমছে না।
যাইহোক, অর্থনৈতিক উন্নয়নে দুর্নীতি প্রভাব ফেলে কি-না বা দুর্নীতি অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে কি-না এবং সেই দুর্নীতি, জবাবদিহিতা ও সুশাসনের অভাব আমাদেরকে পিছিয়ে দিচ্ছে কিনা তা একটি আলোচনার বিষয়।
উন্নয়ন অর্থনীতিবিদরা ১৯৬৮ সালের আগে দুর্নীতিকে কোনো অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে ধরতে রাজি হননি। প্রখ্যাত নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডাল ১৯৬৮ সালে তার বিখ্যাত Asian Drama বইতে বলেছেন উন্নয়নের স্বার্থে দুর্নীতিকে প্রতিহত করার কথা। তার এ বক্তব্য প্রথমে অর্থনীতির পণ্ডিতেরা মানতে রাজি হননি। পরে তারা কথাটির সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের ধারণা, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পক্ষে আমাদের বড় অন্তরায় সীমাহীন দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার কোটি টাকার লোকসান দেয়। দুর্নীতির কারণে আমাদের সমাজে হলমার্ক, বিসমিল্লাহগ্রুপ তৈরি হয়; কয়েকটি ব্যাংক ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়, সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রকট হয়; পদ্মা ব্রিজের কাজ শুরু হতে বিলম্ব হয়; সরকারের ঋণ বাড়ে, সমাজের টার্গেট গ্রুপ তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়; জিডিপিতে প্রায় একটি বড় অংশ নিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমির জন্ম হয়; দেশের বাইরে হাজার হাজার কোটি টাকার পাচার হয়। দুর্নীতি একটা বিষাক্ত বাষ্প, যা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অরাজকতা ও অব্যবস্থাপনা ছড়িয়ে দেয়, সমাজকে কলুষিত ও শুদ্ধ বিকাশকে প্রতিহত করে উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। সমাজকে সামগ্রিকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে তোলে।
দুর্নীতির কারণে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রাণপণ চেষ্টা করেও এই দুর্যোগের মধ্যেও স্বাস্থ্যখাতের কার্যক্রম ও প্রণোদনাসহ ত্রাণ কর্মকাণ্ডকে পুরোপুরি সুষ্ঠু রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন । মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে আন্তরিকতা ও সততা নিয়ে তাঁর সার্বিক কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সেই একই ভাবে যদি তাঁর সহযোগীরা সৎ ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করতেন তাহলে এই দেশ সত্যিকারভাবে কল্যাণের পথে এগিয়ে যেত। আমরা অনেক আগেই পৌঁছে যেতাম বঙ্গবন্ধুর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ও কল্যাণ অবস্থানে।