Published : 11 May 2020, 03:44 PM
করোনাভাইরাস মহামারীর এ ক্রান্তিকালে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছোটাছুটি করেও ভর্তি হতে না পেরে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে প্রতিদিনিই। মরণাপন্ন রোগী নিয়ে জরুরী পরিস্থিতিতে নিকটজনের যে অসহায়ত্ব তা কিছুটা উঠে এসেছে সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব ড. সাদাত হোসেনের পুত্র এবং অতিরিক্ত সচিব গৌতম এইচ সরকারের চিকিৎসক কন্যার কথায়। মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের মর্মান্তিক হাহাকার সবার হৃদয় বিদীর্ণ করলেও সমস্যা সমাধানে কোনও উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলা আর নিরবে অশ্রু বিসর্জন করা ছাড়া যেন কিছুই করার নেই! অথচ সমস্যার প্রকৃতি অনুধাবন করে তা সমাধানের যথাযথ ব্যবস্থা নিলে সংকট উত্তরণ কঠিন কিছু নয়। প্রযুক্তির লাগসই ব্যবহার নিশ্চিত করে বিদ্যমান চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই সংকটের সমাধান সম্ভব। প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ, সদিচ্ছা আর সুশাসন।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে রোগীর চিকিৎসা দিতে বা জরুরী হলে তাৎক্ষণিক ভর্তি করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনীহা বা অপারগতা প্রকাশের প্রধান কারণ হচ্ছে রোগী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিনা তা নিশ্চিত না হওয়া। রোগী আক্রান্ত হলে ভাইরাসের সংক্রমণ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীসহ অন্য রোগীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ার পরিণতিতে পুরো হাসপাতালই 'লকডাউন' করার আশঙ্কা থাকে। ফলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা থাকলেও রোগী ভর্তির ঝুঁকি নিতে চান না। এমতাবস্থায় হাসপাতালে আগত রোগীকে অপেক্ষমাণ রেখে স্বল্প সময়ের মধ্যে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করে হাতেনাতে ফলাফল দিতে পারলেই সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়ে যাবে।
রোগী করোনাভাইরাস আক্রান্ত না হলে হাসপাতাল স্বাভাবিক নিয়মে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে আর পজিটিভ হলে করোনাভাইরাস চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে পাঠানো হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে হাসপাতালে আগত রোগীকে অপেক্ষমাণ রেখে তাৎক্ষণিক করোনাভাইরাস পরীক্ষা করে ফলাফল দেওয়া প্রযুক্তিগতভাবে সম্ভব কিনা? উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ, সম্ভব। টেস্টের মানের সাথে আপস না করে বর্তমানে প্রচলিত আরটি-পিসিআর পদ্ধতি প্রয়োগ করেই তা করা সম্ভব। পৃথিবীর অনেক দেশ এক্ষেত্রে সফল হয়েছে আরটি-পিসিআর প্রযুক্তির বিন্যাস ও প্রয়োগ-প্রণালী উন্নীত করে অথবা বিদ্যমান ল্যাবরেটরি সুবিধার সাথে ন্যানো- চিপ প্রযুক্তি (Nano-Chip Technology) সংযুক্ত করে।
বাংলাদেশে এ কাজটি সফলভাবে করা যায় দুইভাবে।
প্রথমত,এ মুহূর্তে ল্যাবরেটরিতে থাকা মেশিনগুলোর পুনর্বিন্যাস করে করোনাভাইরাস টেস্টিং এর জন্য আরটি-পিসিআর পদ্ধতি দেশীয় প্রেক্ষিতে প্রয়োগ উপযোগী করার মাধ্যমে।
আর দ্বিতীয়ত হচ্ছে, সকল হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ন্যানো-চিপ প্রযুক্তি (Nano-Chip Technology) সম্বলিত আরটি-পিসিআর মেশিন সংযুক্ত করে, যা বর্তমানে সুলভে এবং সহজে পাওয়া যায়।
বিদ্যমান ল্যাবরেটরি সুবিধার পুনর্বিন্যাস করে অথবা আধুনিক ন্যানো- চিপ প্রযুক্তি সংযুক্ত করে স্বল্প খরচে আর স্বল্প সময়ে করোনাভাইরাস টেস্টিং এর সুবিধা থাকলে হাসপাতালগুলো আর রোগীর সেবা দিতে নিরুৎসাহিত বোধ করবে না।
হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীরা সবসময় রোগীর সেবা দিতে আগ্রহী বলেই আমার বিশ্বাস, তা পরিস্থিতি যাই হোক না কেন। কারণ এটিই তাদের পেশা, এটিই তাদের প্রত্যয়। দীর্ঘ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন চিকিৎসক নিজেকে প্রস্তুত করেন, রোগীর সেবা করার জন্যই। হাতেনাতে করোনাভাইরাস টেস্টিং এর ব্যবস্থা করে তাৎক্ষণিক ফলাফল দেয়া গেলে এই সংকটকালে চিকিৎসকরা সেবা দেওয়ায় আরও উৎসাহী আর প্রত্যয়ী হয়ে উঠবেন।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় এর বিস্তার ঠেকানোর কাজটিতে পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আক্রান্তদের কাছাকাছি যেতে হচ্ছে বলে তারা রয়েছেন উচ্চ ঝুঁকিতে।
দেশব্যাপী দায়িত্বরত এসব বাহিনীর সদস্যদের মাঝে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে প্রয়োজন কর্মস্থলেই করোনাভাইরাস টেস্টের ব্যাপক ব্যবস্থা করে তাৎক্ষণিক ফলাফল দেওয়া। কিন্তু দেশের প্রত্যেক থানায় আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরি স্থাপন বাস্তবসম্পন্ন নয়। যা করা প্রয়োজন তা হল চলমান ল্যাবরেটরি (Mobile Laboratory) প্রস্তুত করা যা ঘুরে ঘুরে দেশব্যাপী দায়িত্বরত এসব বাহিনীর সদস্যদের টেস্টিং করে তাৎক্ষণিক ফলাফল দিবে। যেমনটি করা হয় জৈবিক যুদ্ধের (Biological Warfare) মত জরুরী পরিস্থিতিতে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ একটি পূর্ণাঙ্গ আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরিকে পঞ্চাশ আসনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের ভিতর প্রতিস্থাপন করে দেশীয় পদ্ধতিতে চলমান আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরি (Mobile Corona RT-PCR Lab) প্রস্তুত করা যায় সহজে আর স্বল্প খরচে।
এ ক্ষেত্রে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসটিকে দুই ভাগ করে ল্যাবরেটরি অংশকে ঋণাত্মক চাপ (Negative Pressure) এর আওতায় আনতে হবে। এই চলমান আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরি সংক্রমণ কবলিত এলাকায় সংক্রমিত ব্যক্তিকে শনাক্ত করে আলাদা করা এবং তার সংস্পর্শে আসা যে কাউকে শনাক্ত করতে সহায়তা করবে। এতে পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ আর পরিবহনের ঝুঁকিও কমে যাবে বহুলাংশে।
বিদ্যমান ল্যাবরেটরি সুবিধার বিন্যাস আর ব্যবহার পদ্ধতি উন্নীত করার মাধ্যমে স্বল্প সময়ে মানসম্পন্ন টেস্ট করার সুযোগ থাকলেও কেন আমরা তা করছিনা? এটি কোটি টাকার প্রশ্ন হলেও জবাব কঠিন নয়। এক কথায় জবাব হল মহল বিশেষের বাণিজ্যিক স্বার্থ আর দুর্নীতি।
আমরা বাধ্য হচ্ছি নির্দিষ্ট বিদেশি কোম্পানির এদেশিয় এজেন্ট এর সুপারিশ করা নির্ধারিত যন্ত্রপাতি ও কিট উচ্চ দামে কিনে তাদেরই শেখান পদ্ধতিতে তোতা পাখির মত ব্যবহার করতে। সিস্টেম এর কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছি আমরা সবাই। আমাদের যেন আর কোন উপায় নেই। এমনকি প্রযুক্তির ব্যবহার পদ্ধতি উন্নীত করার লক্ষ্যে দেশীয় বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনী ধারণা আর প্রয়োগ করার দক্ষতা উপেক্ষিত হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। এমন ধারণা তৈরি করা হচ্ছে যেন আরটি-পিসিআর প্রযুক্তি রকেট বিজ্ঞানের মত উচ্চমানের, নির্দিষ্ট কিছু লোক ছাড়া আর কেউ এটি জানে না, বোঝেও না। কোম্পানির এজেন্ট এর শেখান পদ্ধতির বাইরে গেলেই সর্বনাশ, সবকিছু নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা ভুলে যাই যে এদেশীয় বিজ্ঞানীদের অনেকেই আরটি-পিসিআর এর মৌলিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ভূমিকা রেখে স্বীকৃতি লাভ করেছেন বিদেশি ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করেই। যারা উদ্ভাবনে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তাদেরকে প্রয়োগের ক্ষেত্রে অপারগ ভাবা হচ্ছে। দেশীয় বিজ্ঞানীদের দক্ষতার উপর আস্থা নেই বলেই হয়ত করোনাভাইরাস টেস্টের জন্য কম খরচে আরটি-পিসিআর কিট তৈরির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া প্রস্তাবে কোন সাড়া মেলেনা দীর্ঘ সময় পরও। কিন্তু সংকটময় সময়ে প্রযুক্তির লাগসই ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের মানুষকে রক্ষা করার কোনও বিকল্প তো নেই।