হাজার বছরের বাঙালি সত্তা রাতারাতি বাংলাদেশিতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। নাগরিকতা হয়ে দাঁড়াল জাতীয়তার সমার্থক। কী? না, বাংলাদেশি জাতীয়তা। কিন্তু এই জাতিটা হুট করে কোত্থেকে গজালো?
Published : 20 Sep 2022, 10:40 PM
১.
বাঙালি কৌতুকপ্রিয় জাতি। কৌতুক বলা এবং শোনা দুটোই পছন্দ করে। অবশ্য তাদের কৌতুকের বিষয় সদা সর্বদাই অন্য কেউ। নিজেকে নিয়ে কৌতুক করতে পারাটা উচ্চমার্গীয় মননের ব্যাপার। সবাই তা পারে না। যারা পারে, তারা পারে। তারা অন্যরকম।
বব হোপের কথাই ধরুন না। মার্কিন কৌতুকাভিনেতা, গায়ক, নৃত্যশিল্পী, মল্লক্রীড়াবিদ ও লেখক। তার ৮০ বছরের বেশি সময়ের কর্মজীবনে তিনি ৭০টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। এর মধ্যে ৫৪টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে শ্রেষ্ঠাংশে অভিনয় করেছেন। সর্বাধিক ১৯ বার অ্যাকাডেমি আয়োজনের উপস্থাপনা করেছেন। এছাড়া তিনি মঞ্চ ও টেলিভিশনে অভিনয় এবং ১৪টি বই রচনা করেছেন।
এক সুন্দরী প্রতিযোগিতায় জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, পৃথিবীর সেরা মানুষ কে? একেকজন একেক মহামানবের নাম বলেছিলেন। একজন সুন্দরী উত্তর দিয়েছিলেন, বব হোপ। কারণ, বব হোপ নিজেকে নিয়ে হাসি-মশকরা করে সারা পৃথিবীকে হাসান।
বব হোপ নিজেকে নিয়ে কৌতুক করতেন। নিজেকে নিয়ে তার একটা কৌতুক এরকম। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তিনি কীভাবে নাচ শিখলেন। জবাব দিলেন, ‘আমি কীভাবে নাচ শিখলাম? আমরা ছিলাম ছয় ভাই। বাথরুম ছিল একটা। বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় আমি নাচ শিখে ফেলেছি।’
হোপ নিজেকে নিয়ে কৌতুক করেছেন। একই সঙ্গে ছোটবেলায় নিজেদের বৈষয়িক অবস্থার কথাও তুলে ধরেছেন। কষ্টেসৃষ্টে বড় হওয়া মানুষ বৈষয়িক প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলে অতীতকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। হোপ কিন্তু তা করেননি। কৌতুকের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন, ছোটবেলায় তাকে অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে। সে কষ্টের একটা দিক ছয় ভায়ের সঙ্গে বাথরুম শেয়ার। একই সঙ্গে জরুরি এবং বিব্রতকর বিষয়টাকে কী সরস ভাবেই না উপস্থাপিত করলেন!
তবে এটা ঠিক। মানুষ অন্যকে নিয়ে কৌতুক করলেও নিজেকে নিয়ে কৌতুক করতে পারে না। অন্য কেউ তাকে নিয়ে কৌতুক করুক, এটাও পছন্দ করে না। কিন্তু তাই বলে কৌতুক থেমে থাকে না। নিত্য নতুন কৌতুক তৈরি হয়। আর মানুষ অন্যের বিষয়ে কৌতুক শুনে দাঁত বের করে হাসে। বোঝা যাচ্ছে, বিনোদিত হওয়ার ক্ষেত্রে পরকে নিয়ে কৌতুক একটা উপাদেয় উপাচার।
জর্জ বুশকে নিয়ে নেট দুনিয়ায় অনেকগুলো কৌতুক আছে। তার মধ্যে একটা হলো:
আলবার্ট আইনস্টাইন, পাবলো পিকাসো ও জর্জ বুশ মারা গেছেন। তিন জনের মৃত্যু দশক দশক ব্যবধানে হলেও স্বর্গীয় সময়ের সামান্য ত্রুটির কারণে তারা তিনজনই একই সময়ে স্বর্গে যাওয়ার অনুমতি পেলেন।
স্বর্গের দরজায় যেতেই ভ্যাটিক্যানের পোপ সেইন্ট পিটারের সঙ্গে তাদের দেখা। পিটার আইনস্টাইনকে দেখে বললেন, ‘আপনাকে তো আইনস্টাইনের মতো দেখাচ্ছে। আচ্ছা, আপনি কীভাবে প্রমাণ করবেন যে, আপনিই আইনস্টাইন? আপনার চেহারার আরো মানুষও তো থাকতে পারে, তাই না?’
‘জী। ঠিক আছে। দয়া করে একটা চক আর ব্ল্যাকবোর্ডের ব্যবস্থা করুন। প্রমাণ দিচ্ছি,’ আইনস্টাইন বললেন।
চক-ব্ল্যাকবোর্ডের ব্যবস্থা করা হলো। আইনস্টাইন তার রহস্যময় গণিতবিদ্যা আর আপেক্ষিকতার সূত্র নিয়ে ঝড়ের গতিতে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে চললেন। একটু দেখেই সেইন্ট পিটার বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আর লাগবে না। আপনিই সত্যিকারের আইনস্টাইন। স্বর্গে আপনাকে স্বাগতম। দয়া করে ভেতরে ঢুকুন।’
এবার পিকাসোর পালা। তাকে সত্যিকারের পিকাসো কিনা প্রমাণ করতে বলতেই তিনি চক হাতে নিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে কয়েকটা আঁচড় দিয়ে সেইন্ট পিটারের প্রতিকৃতি এঁকে ফেললেন। তাকেও সসম্মানে স্বর্গে ঢুকতে দেয়া হলো।
এবার পিটারের চোখ পড়ল জর্জ বুশের ওপর। বললেন, 'আপনার আগে আইনস্টাইন আর পিকাসো তাদের পরিচয় প্রমাণ করে স্বর্গে ঢুকে গেছেন। আপনি নিজেকে বুশ হিসেবে প্রমাণ করুন।’
বুশ অবাক হয়ে বললেন, ‘আইনস্টাইন! পিকাসো! এরা আবার কারা?’
সেইন্ট পিটার স্মিত হেসে বললেন, ‘একদম ঠিক। তারা আবার কারা? আপনি সত্যিই বুশ। ভেতরে আসুন।’
রাজনীতিবিদরা গড়পরতা কেমন মাথা, সম্ভবত এটা বোঝানোর জন্যেই এই কৌতুকের সৃষ্টি হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সব প্রেসিডেন্টই জর্জ ওয়াশিংটন কিংবা আব্রাহাম লিঙ্কন নন, মাথামোটা বুশ কিংবা ট্রাম্পও আছেন। কৌতুকের বিষয় তারাই হন।
ট্রাম্পকে নিয়েও কৌতুক আছে। ট্রাম্প ছিলেন টুইটারপ্রিয়। কথায় কথায় তার টুইট করা চাই-ই। একবার যে কোনোভাবে হোক, এগারো মিনিটের জন্যে তার টুইটার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ট্রাম্প তো রেগেমেগে কাঁই। শেষে জানা গেল, একজনের অনিচ্ছাকৃত ভুলে তিনি এগারো মিনিটের মতো তার অ্যাকাউন্টে ঢুকতে পারেননি।
এদিকে ট্রাম্পের টুইট বন্ধ হওয়াকে কেন্দ্র করে হাসাহাসি শুরু হয়েছে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে। অনেকে আবার কৌতুকপূর্ণ পোস্টও দেন।
অ্যারন ডোরান্ড নামে এক ব্যক্তি টুইটার পোস্টে বলেছেন, 'আশা করি, ভবিষ্যতে কেউ না কেউ প্রেসিডেন্টের টুইট অ্যাকাইন্ট বন্ধের এই ঘটনা নিয়ে সিনেমা বানাবে, যাতে বলা হবে, ওই কয়েকটা মিনিট বিশ্বের মানুষ কতোটা খুশি ছিলেন।'
মানে অ্যারন বলতে চেয়েছেন, ট্রাম্পের অবিরাম উল্টোপাল্টা টুইটে ত্যক্ত-বিরক্ত বিশ্বের মানুষ এগারো মিনিটের জন্যে একটু স্বস্তিতে ছিল।
ব্যক্তিমানুষ ছাড়াও জাতি বা সম্প্রদায় নিয়ে কৌতুকে আছে। সমাজবিজ্ঞানী ক্রিস্টি ডেভিস সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে জাতিগত কৌতুক বলা হয়ে থাকে, তা নিয়ে বিশদভাবে লিখেছেন। সাধারণত একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ভাষাগত দিক সবই জানা থাকে একজন কৌতুক উপস্থাপকের। সে জন্যে অনেক সময় সেসব অঞ্চলের অধিবাসীদের টার্গেট করে কৌতুক নির্মাণ করতে পারেন তারা। তিনি উদাহরণ দিয়েছেন বিভিন্ন জাতিগত কৌতুকের।
ডেভিস বলেছেন, আমেরিকানরা কৌতুক বলে পোলিশ আর ইতালিয়ানদের নিয়ে। আবার জার্মানরা কৌতুক করে তাদের পশ্চিম ফ্রিশিয়া পেনিনসুলার নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী ‘অস্টফ্রিশেন্স’দের নিয়ে। যুক্তরাজ্যের লোকেরা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে আইরিশদের নিয়ে। এভাবে বিদ্রুপাত্মক কৌতুকের মাধ্যমে এক ধরনের আনন্দ পায় তারা। খ্রিস্টি ডেভিসের অবশ্য এসব ভালো লাগেনি। তাই এসব জাতিগত কৌতুককে তিনি ‘স্টুপিডিটি’ বলেছেন।
তা সে ‘স্টুপিডিটি’ হোক আর গাধামিই হোক, এটা চলতে থাকে। আমাদের এই বাঙালিকে নিয়েও কৌতুক আছে। যেমন ‘বাঙালির দোজখে দারোগা লাগে না’। আবার ছোটবেলায় শুনতাম, আয়ুব খান নাকি বাঙালিদের ব্যাঙের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ব্যাঙকে যেমন পাল্লায় মাপা যায় না, লাফিয়ে লাফিয়ে পাল্লা ছেড়ে পালায়, তেমনি বাঙালিকেও এক পাল্লায় কিংবা এক বৈশিষ্ট্যে বিশ্লেষণ করা যায় না। তারা কখনো কোনো বিষয়ে একমত হবে না, কখনো এক অবস্থানে আসবে না।
বাঙালিদের নিয়ে এরকম কৌতুক, একজন বাঙালি হিসেবে নিশ্চয় আপনার ভাল লাগবে না। মানুষ ব্যক্তিগত অপমানে আহত হয়, কিন্তু জাতিগত অপমানে ‘নিহত’ হয়। ছোটবেলায় আরেক জেলার এক লোক আমাকে ঠাট্টা করে বলেছিল, ‘তোরা ......এলাকার মানুষ হইল বেঈমান।’
শুনে খেপে গিয়ে বলেছিলাম, ‘আমাকে বেঈমান বলো, ঠিক আছে। কিন্তু আমার জেলার লোকদের বেঈমান বলবে না ‘
তখন অত শত বুঝিনি। ওই প্রতিবাদটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এসে গিয়েছিল। এখন বুঝি, মানুষ নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে, ঠিক আছে, তবে তার নিজের অস্তিত্বের নিশ্চয়তা পেয়ে থাকে সমষ্টির মধ্যেই। সমষ্টি আক্রান্ত হলে সে রুখে দাঁড়ায়।
২.
সামষ্টিকভাবে আক্রান্ত বাঙালির রুখে দাঁড়ানোর প্রমাণ ইতিহাসের পাতায় পাতায়। গত শতকের ৪৮, ৫২, ৬২, ৬৬, ৬৯ আর সব বিক্ষোভের কেন্দ্রীভূত-পুঞ্জীভূত অগ্ন্যুৎপাতসম ৭১। মাত্র দুই যুগেই ছোট্ট ডোবার নিস্তরঙ্গ অস্তিত্ব থেকে গর্জনশীল তরঙ্গবিক্ষুব্ধ মহাসমুদ্রোপম আত্মপ্রকাশ। বাঙালির অনুপম অর্জন। আয়ুব খানের ‘ব্যাঙ-বাঙালি’র ঐক্যবদ্ধ উল্লম্ফন। বিশ্বের ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব কমই আছে।
কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছর। তারপর যে বাঙালি সে বাঙালি। নীরদ সি চৌধুরীর ‘আত্মঘাতী বাঙালি’। দোজখের সব দারোগাকে ছুটি দিয়ে বাঙালি নিজেই নিজের দোজখের দারোগা হয়ে দাঁড়াল। সবাই এক একজন দারোগা। অন্য জাতির দোজখ থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে চাইলে তাদের দোজখের বিধাতানিয়োজিত দারোগা ওপর থেকে গোর্জের বাড়ি লাগায়। কিন্তু বাঙালির দোজখ থেকে কেউ যদি একটু বেরোতে চায়, ওপর থেকে গোর্জ লাগে না, নিচের বাঙালিরাই তার ঠ্যাঙ ধরে হ্যাঁচকা টানে নামিয়ে নেয়। ব্যাটা, আমি উঠতে পারছি না, তুই উঠবি ক্যান?
বাঙালির দোজখে দারোগা লাগে না, এটা শুধু কৌতুকসিদ্ধ কথাই নয়, বলা যায় স্বতঃসিদ্ধ এক প্রবচন। যে সিন্ধুসংক্ষুব্ধকণ্ঠের গর্জন আর অভ্রভেদী অঙ্গুলিসঙ্কেতে নির্দেশিত হয়েছিল বাঙালির ভবিষ্যৎ ঊর্ধ্বযাত্রা, সে ভবিষ্যৎ আর ভবিষ্যৎদ্রষ্টাকে ঝাড়ে বংশে নিপাত করে দিয়ে ফের অতলযাত্রা শুরু হতে সময় লাগেনি। হাজার বছরের বাঙালিসত্তা রাতারাতি বাংলাদেশিতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। নাগরিকতা হয়ে দাঁড়াল জাতীয়তার সমার্থক। কী? না, বাংলাদেশি জাতীয়তা। কিন্তু এই জাতিটা হুট করে কোত্থেকে গজালো? উত্তর সোজা। এই ‘জাতীয়তা’ বোধ এসেছে মতলবি বুদ্ধি থেকে। ’৭৫ এর পর নতুন এক জাতি গজিয়ে উঠেছে মাটি ফুঁড়ে।
৩.
কৌতুক নিয়ে কৌতুক করতে গিয়ে সিরিয়াস প্রসঙ্গ অবতারণা করে ফেললাম। ফের কৌতুকে ফিরে যাই। একটা পুরনো কৌতুক। একজন সার্জন, একজন আর্কিটেক্ট এবং রাজনীতিবিদ তর্ক করছেন কার পেশা সবচেয়ে প্রাচীন এই বিষয়ে। সাজর্ন বললেন, ‘ইভকে অ্যাডামের পাঁজরের হাড় থেকে তৈরি করা হয়েছে এবং সেটা একটা সার্জিক্যাল অপারেশন।’
আর্কিটেক্ট বললেন, ‘হতে পারে। কিন্তু তার আগে বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে একটা নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, আর সেটা অবশ্যই একটা আর্কিটেকচারাল কাজ।’
রাজনীতিবিদ বললেন, ‘কিন্তু বিশৃঙ্খলাটা করলো কারা?’