Published : 12 Oct 2019, 07:41 PM
ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার প্রস্তাব অবাস্তব কারণ যার অস্তিত্বই নেই তাকে বন্ধ বা খোলা কিছুই করা যায়না।
প্রকৃত ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হয়ে গেছে সেদিন, যেদিন ছাত্রনেতাদের হাতে উঠেছে অস্ত্র, উঠেছে সিট বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, টেণ্ডারবাজী, হল-দখল প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। প্রকৃত ছাত্র রাজনীতি উচ্ছেদ হয়ে গেছে সেদিন, যেদিন রাজনীতিকদের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সহায়তায় ও ছত্রছায়ায় ছাত্রনেতারা হয়েছে ক্রিমিন্যাল আর ক্রিমিন্যালদের হাতে চলে গেছে ছাত্র-নেতৃত্ব। ব্যতিক্রম আছে কিন্তু এক্সেপশন কখনো নর্ম নয়। বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি আসলে "ছাত্র রাজনীতি"-র মুখোশ পরা প্রকাণ্ড এক দানবের জন্ম যা আদপে ছাত্র রাজনীতিই নয়।
ছাত্র রাজনীতি বন্ধের বিরুদ্ধে অনেকে ছাত্রলীগের অতীত গৌরব ও ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে থাকেন। তাঁরা ভুলে যান অতীতের গৌরব ভাঙ্গিয়ে বর্তমান চলেনা, বর্তমানকেও নতুন গৌরব অর্জন করতে হয়। মধ্য ষাট দশকে আমাদের (ছাত্রলীগের) বিপক্ষ এতই পরাক্রান্ত ছিল যে এফএইচ হলের নির্বাচনে জিতেও আমাদেরকে জিতবার "অপরাধে" মাখন ভাইয়ের নির্দেশে হল ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। এফএইচ হলের ছাত্রলীগ কমিটি আমরা এফএইচ হলে বসে বানাতে পারিনি, গোপনে মাঝরাতে কার্জন হলের বারান্দায় টিমটিমে আলোর মধ্যে বসে বানাতে হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সারা দেশের অগণিত ছাত্রলীগ নেতাকর্মী আমরা ছাত্রলীগের গৌরবময় অতীত ইতিহাস রক্ষা করে নতুন গৌরব অর্জন করেছিলাম। তেমন কর্মীদল এখনো আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু তেমন নেতৃত্ব? ভেতর বাইরের পরাক্রান্ত দানবীয় অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদের সৎ ও সবল নেতৃত্বে ছিলেন তোফায়েল ভাই, রাজ্জাক ভাই, মাখন ভাই, রব ভাই, নূরে আলম সিদ্দিকী ভাই, শাজাহান সিরাজ ভাই, ফেরদৌস কোরেশী ভাই, দাদাভাই, সেই সাথে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের মেনন ভাই, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ভাই, মতিয়া আপারা। সর্বোচ্চ নেতা শেখ মুজিব তখন আগরতলা মামলায় জেলে, আওয়ামী লীগ দুর্বল, পাকিস্তান ভাঙার পুরো আন্দোলনটাই ছিল ছাত্র-চালিত। আমাদের এতো পরিশ্রম, এতো আবেগ এতো ত্যাগের ফল ছাত্রলীগের সেই গৌরব ও ঐতিহ্য আমাদেরই চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে গেছে।
আমার এ বুকভাঙা বেদনা কেতাবী জ্ঞানের ভিত্তিতে নয়। বরং একজন প্রাক্তন তীব্র ছাত্রলীগার হিসেবে। ১৯৬৪-১৯৬৬ সালে আমি ছিলাম ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সহ সভাপতি এবং ১৯৬৬-১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ব-বিদ্যালয়ে এফএইচ হল ছাত্রলীগের সহ সভাপতি ও হলের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন মুশতাক এলাহী ভাই, জি-এস ছিল আব্দুর রশীদ, মাথার ওপরে মাখন ভাই তো ছিলেনই। পাকিস্তান ভাঙার সেই উত্তাল বছরগুলোতে ছাত্রলীগের সৎ ও দুর্দান্ত নেতৃত্বের অধীনে আমাদের কি যে উত্তাল সময় ছিল সেটা, এখনকার ছাত্রলীগারেরা কি তা কল্পনাও করতে পারবে? সেজন্যই বলি, একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর আমার নশ্বর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন !
হিংস্রতা হল মাদকের মত, সময়ের সাথে ওটার ডোজ বাড়তে থাকে। সরকারী ক্ষমতার সাথে হিংস্রতারও পালাবদল হয়েছে ও মাত্রা বেড়েছে। কয়েক দশক ধরে জাতি দেখেছে শিবিরের ও ছাত্রদলের ভয়াবহ হিংস্রতা, এখন দেখছে ছাত্রলীগের। বহু বছর ধরে দেশে ছাত্র-রাজনীতির নামে যা চলছে তা স্রেফ ছাত্র-গুণ্ডামী। সেটা বন্ধ করাও কঠিন, কোনো রাজনৈতিক দল তা করবেনা কারণ তারা তাদের ছাত্র সংগঠনের পেশীশক্তির ওপরে নির্ভরশীল। তাছাড়া ছাত্রনেতারা ইতোমধ্যেই ক্ষমতা ও টাকার স্বাদ পেয়ে গেছে, তারা কোনো কারণেই সেগুলো হারাতে চাইবে না বরং সুযোগ পেলেই পাল্টা আঘাত হানবে তাকে যে তাদের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে।
একদিকে অবিশ্বাস্য উন্নয়ন, অন্যদিকে জাতির মূল্যবোধ আজ সর্বগ্রাসী অন্যায় অত্যাচারের গহ্বরে। ঘুসখোর, চাঁদাবাজ, ব্যাংক আর শেয়ার লুটেরা, নদী আর ভূমিখেকো, পুলিশ ও প্রশাসনের কিছু হিংস্র দানব, সর্বত্র ধর্ষণের মহোৎসব, সংখ্যালঘুর ওপরে অত্যাচার প্রত্যেকটি অন্যায়ের শেকড় একসূত্রে গাঁথা। সেটা হল ব্যাপক বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি। আমাদের বিবেকের দরজায় তনু, মিতু , সাগর, রুনি, নুসরাতসহ অসংখ্য ব্যর্থ করাঘাতের পর বুয়েটে আবরার ফাহাদের খুন সেই সর্বগ্রাসী অন্যায়কে আরেকবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে মাত্র। এই নিবিড় তিমির অমানিশায় একটুখানি আলো – সম্প্রতি আমরা বিভিন্ন 'লীগ' এর ভয়াবহ ক্রিমিন্যালদের গ্রেপ্তার দেখছি, সরকারের উদ্যোগ দেখছি চেষ্টা দেখছি। কিন্তু আমরা অপরাধীর শাস্তি দেখতে চাই যেটা এখনো আশাব্যঞ্জক নয়। সেই সাথে, রাষ্ট্রপতি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত খুনীকে 'ক্ষমা' করে দেবেন এটা আমরা দেখতে চাই না।
বুয়েট-এর বিভিন্ন হলে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ জানাতে দুই বছর আগে চালু করা ওয়েবপেইজটি সম্প্রতি বন্ধ করে দিয়েছে বিটিআরসি। এতে ২০১৭ সালের ৩১ মার্চ থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ১৬৬টি অভিযোগ জমা পড়েছিল। এটা কেন করা হল?
সেখানে একটা অভিযোগের কিছু বর্ণনা: "ছাত্রলীগ সভাপতি জমি'র রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি অনেক মানুষের জটলা……২২১ নম্বর রুমের জীবন নামে একটা ছেলেকে রক্তাক্ত অবস্থায় জমি'র রুম থেকে বের করে আর সাথে সাথে ওই ছেলেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যায়। পুরো সময় হল প্রভোস্ট তার রুমে বসা ছিল যখন ওই ছেলেকে মারা হয়…সবাই জানে একজনকে মারা হচ্ছে কেউ এগিয়ে আসেনি"।
ভয়াবহ!
এ হল দেশব্যাপী বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অসংখ্য "টর্চার সেল"-এর একটা মাত্র, যেগুলোর কথা আমরা জানতামই না।
এখন গণরুমের দুর্দশা লাঘবে ঢাবি কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং বুয়েটে আবরার ফাহাদকে খুনের মামলায় অভিযুক্ত ১৯ জন ছাত্রলীগ নেতাকে বহিস্কার করা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, বুয়েটে ছাত্র-রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা জাতির জন্য মোক্ষম একটা টেস্ট কেস। এতে যদি বুয়েটে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে আসে তবে প্রমাণ হবে ছাত্র-রাজনীতি নিষিদ্ধই শ্রেষ্ঠ পথ। যদি না হয় তবে আমাদের অন্য বিকল্প খুঁজতে হবে। শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি, কিন্তু আমাদের আর পেছন ফিরে তাকাবার অবকাশ নেই। ছাত্র রাজনীতি সব সমস্যার মূলেও নয়, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলেই ম্যাজিকের মতো দেশের সব সমস্যার সমাধানও হয়ে যাবেনা। তবে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে সেটা অবশ্যই হবে ছাত্র রাজনীতি থেকে উদ্ভুত সমস্যা সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ।
'ছাত্র-রাজনীতি থেকে রাষ্ট্রনেতার জন্ম হয়'- এটা একটা আপ্তবাক্য মাত্র। দুনিয়ার আর কোনো দেশে আমাদের মত মূল রাজনৈতিক দলের পোঁ ধরা ছাত্র সংগঠন আছে বলে জানিনা। কিন্তু কই, দুনিয়াজুড়ে তাদের তো রাষ্ট্রনেতার অভাব হয়না! ছাত্র-রাজনীতি থেকে আমরা পেয়েছি কিছু রাষ্ট্রনেতা ও বহু দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক। সাত সাতজন ছাত্রের প্রমাণিত খুনী, আদালতে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ছাত্রনেতা মুক্তি পেয়ে রাজনৈতিক দলের প্রধান হয়েছেন। আমাদের সময়ে কোটিপতি দূরের কথা, লাখপতিও ছাত্রনেতা ছিলনা। গাড়ি বাড়ি দূরের কথা, পায়জামা-পাঞ্জাবী, সুতির শাড়ি আর রিকশা, এই ছিল সম্বল। কিন্তু সেই পায়জামা পাঞ্জাবী আর সুতি শাড়ির নেতৃত্বে আমরা বিশ্ব-কাঁপানো সশব্দে মানচিত্র ভেঙেছিলাম, ভেতর-বাইরের দানবকে পরাস্ত করেছিলাম, নেতাকে শত্রুর কারাগার থেকে মুক্ত করেছিলাম, প্রজন্মকে সার্বভৌম দেশ ও পতাকা উপহার দিয়েছিলাম। তখনকার ছাত্রলীগ আর এখনকার ছাত্রলীগের পার্থক্যটা এখানেই, নেতৃত্বে। আবারো বলছি ব্যতিক্রম আছে কিন্তু এক্সেপশন কখনো নর্ম নয়।
কালতামামী
সর্বশ্রেষ্ঠ পথ হল নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্র-রাজনীতিকে লেজুড়বিহীন সুষ্ঠু ও সৎ করা যা আমরা মধ্য ষাট দশকে দেখেছি। সেটা সম্ভব না হলে এ দানবকে উচ্ছেদ করাই মন্দের ভালো। সেক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীরা রাজনৈতিক সংগঠনের বি-টিম না হয়ে শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি চারু-কারুকলা সম্পর্কিত সংগঠন ও কর্মকাণ্ড করুক, সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন করুক যেটাতে শিবির-দল-লীগের মতো লেজুড় বিশিষ্ট সংগঠনের দরকার হয়না। এইসব কর্মকাণ্ড থেকে তারা সাংগঠনিক ও নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করুক। আমরা মেধাবী জাতি, ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনেতা সেখান থেকেই বেরিয়ে আসবে।
জয় বাংলা !!