Published : 08 Aug 2019, 06:51 PM
শৈশবে খুলনায় আমার গ্রামের বাড়িতে দেখতাম মা-কাকীরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই বাড়ির উঠান ঝাড়ু দিত। ময়লা-আবর্জনা ফেলার যথাযথ জায়গা না থাকায় ঝাড়ু দিয়ে আবর্জনাসমূহ বাড়ির কোণায় অবস্থিত টিউবওয়েলের পানি নিষ্কাশন নালার শেষপ্রান্তে জড়ো করা হতো। ফলাফল যেটা হওয়ার সেটাই হতো। ঝাড়ু দেওয়ার ফলে বাড়ির উঠান তকতক করত বটে, তবে একই সাথে টিউবওয়েলের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্থ হতো। ফলে ধীরে ধীরে সেখানে ময়লা জমে স্তুপে পরিণত হতো। একই চিত্র মোটামুটি গ্রামের প্রায় সকল বাড়িতেই ছিল। অর্থাৎ, সুষ্ঠু ময়লা ব্যবস্থাপনা না থাকায় ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখতে গিয়ে আঙিনার কোণাতেই ময়লার ভাগাড় তথা রোগ-জীবানুর তীর্থস্থান গড়ে তোলা হতো।
পরবর্তীতে পড়াশুনার তাগিদে জেলা শহর খুলনা, রাজশাহী হয়ে যখন খোদ রাজধানী ঢাকাতে আসলাম, মনে হতো এই শহরগুলো থেকে আমার গ্রামের বাড়ি ঢের ভালো। বাড়িতে তো অভিভাবক ছিল, গৃহস্থরা কিছুদিন পর পর হলেও ময়লার স্তুপ সরিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলত। কিন্তু এখানে দেখতাম কোনো বাসাবাড়িতে কোন অভিভাবক নিজে তো নয়ই, বাসার অন্যকে দিয়ে হলেও ময়লা সরানোর প্রয়োজন বোধ করতেন না। কাজের বুয়াকে দিয়ে যেটুকু সম্ভব সেটুকুই সিটি কর্পোরেশনের ভ্যানে বা নির্ধারিত স্থান পর্যন্ত পৌঁছানো হতো। যে বাসায় নিয়মিত কাজের লোক নেই তারা জানালা দিয়ে ময়লা-আবর্জনা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিত।
আবার যে আবর্জনাটুকুর ভাগ্যে সিটি কর্পোরেশনের ভ্যান বা ময়লার ভাগাড় জুটত তাদেরও চরম অব্যবস্থাপনার ফলে নগরবাসী তথা আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গিয়েছিল। যেখানেই যাই দুর্গন্ধ আর পিছু ছাড়ে না! ফলশ্রুতিতে কিছুদিন পর দেখলাম আমার নাসিকার রিসেপ্টরগুলো আর মস্তিস্কের অলফ্যাক্টরী সেন্টারে কোন সিগনাল পাঠায় না, আর পাঠালেও তা অতি ক্ষীণ! ফলে গন্ধসমূহ অনুভূতিহীন হতে লাগল।
সময়ের পরিক্রমায় প্রায় এক যুগ আগে যখন পড়াশুনার জন্য ইউরোপে গেলাম, তখন প্রথমবারের মতো দেখলাম ময়লা নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা কাকে বলে! তাছাড়া পরবর্তীতে যখন অস্ট্রেলিয়ায় আসলাম, তখন থেকেই দেখছি কিভাবে এখানকার সকল আবাল-বৃদ্ধ-বণিতারা ময়লা নিষ্কাশন ব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের মত এখানে জমিদারি প্রথা নেই যে, বাড়িতে কাজের লোক থাকবে। টয়লেট পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে ঘাস কাটা পর্যন্ত নিজেদের সব কাজ নিজেকেই করতে হয়।
যেটা বলছিলাম, এখানকার সবাই ময়লা নিষ্কাশন ব্যবস্থার সাথে সরাসরি জড়িত। এখানকার প্রত্যেকটা বাড়িতে নিজস্ব অর্থে কেনা মুখবন্ধ রাবিশ বিন থাকে। এটা পূর্ণ হয়ে গেলে বাড়ির গ্যারেজে বা বাইরের এক কোণায় থাকা সিটি কাউন্সিলের বিনে স্থানান্তর করা হয়, যেটা সপ্তাহান্তে সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি এসে নিয়ে যায়। এই বিন আবার তিন শ্রেণির যেটা তিনটি ভিন্ন রঙ দ্বারা নির্দেশিত- লাল, হলুদ ও সবুজ। সবুজ বিনে শুধু গ্রিন প্রোডাক্ট, যথা ঘাস, লতা-পাতা, গাছের ডাল ইত্যাদি রাখা হয় যেটা সিটি কর্পোরেশন থেকে মাসে একবার নিয়ে যায়। হলুদ বিনে শুধুমাত্র পূনরুৎপাদনযোগ্য পণ্যসমূহ, যথা প্লাস্টিক, ক্যানের কৌটা, প্যাকেজিং পণ্য ইত্যাদি রাখা হয়, এবং এটা প্রতি দুই সপ্তাহ পর পর নিয়ে যায়। আর পচনশীল দ্রব্য, যথা ফুড ওয়াস্ট থেকে শুরু করে বাকি সবকিছু লাল বিনে রাখা হয়। এটা প্রতি সপ্তাহে সিটি কাউন্সিলের গাড়ি এসে নিয়ে যায়। নিয়ে যায় মানে কিন্তু বিনশুদ্ধ নিয়ে যায় না, বিনের ভিতরের সবকিছু নিয়ে খালি বিনটা রেখে যায়, যেটা পুনরায় ব্যবহার করতে হয়।
ক'দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি মন্ত্রী-মেয়র থেকে শুরু করে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব পর্যন্ত রাস্তায় ঝাড়ু নিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নেমে পড়েছে। প্রেক্ষাপট ডেঙ্গি জ্বরের মহামারি থেকে বাঁচতে এডিস জীবাণুবাহী মশা নিধন কল্পে জনসাধারণকে নিজ নিজ বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে উৎসাহ প্রদান। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয়গণ কিংবা নগর পিতারা কি নিজেদের কাজ ঠিকমত করছেন? আপনারা কি নিশ্চিত করেছেন সব জনগণ যদি ঠিকঠাকমতো নিজেদের ময়লা-আবর্জনা নিয়ে আপনাদের কাছে দিতে আসে আপনারা তা গ্রহণ করে সুষ্ঠু ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সেটা ব্যবস্থাপনা করতে পারবেন? যদি না পারেন তাহলে জনগণ তো আপনাদের উৎসাহমূলক কাজকে সার্কাস হিসেবেই নিবে। তাই আমি মনে করি রাস্তায় ঝাড়ু নিয়ে বেরোনোর আগে আপনারা ময়লার ভ্যান নিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে যান। এতে জনগণও উৎসাহিত হবেন নিজেদের ময়লা-আবর্জনা নিজেরা নিয়ে এসে উক্ত ভ্যানে তুলে দিতে।
আর আমরা জনগণ, কিছু হলেই সবসময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দোষ দিতে ব্যস্ত থাকি। মনে করি, ভোটে নির্বাচিত হয়ে নেতা-নেত্রীরাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে দেশের উন্নয়ন সব তাঁরাই করে ফেলবেন। আর প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আমাদের গোলামী করবেন। কারণ, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাঁরা চলেন। অথচ আমি নিজের কাছে কখনও প্রশ্ন করতে চাই না, আমি নিজে ঠিকমতো ট্যাক্স দেই তো?
মনে রাখতে হবে সরকারি কর্মকর্তারা কিন্তু নিজ যোগ্যতা বলেই উক্ত পদে আসীন হয়েছেন, কারও করুণায় নয়। যাঁরা অন্য চাকরি করেন তাঁদেরকে যদি আমি প্রশ্ন করি, আপনি কি আপনার উর্ধতন কর্মকর্তা বা মালিকের চাকর? কি জবাব দিবেন তখন? তাই উভয়কেই উভয়ের সম্মান করা শিখতে হবে। মালিক পক্ষ যেমন চাকরিজীবীর মেধা ব্যবহার করে উপকৃত হয় এবং প্রতিদান হিসেবে বেতন দেয়, তেমনি সরকারী চাকরিজীবীরাও আমাদের সেবার বিনিময়ে বেতন নিয়ে থাকেন। এটাকে নেতিবাচক এবং তুচ্ছ হিসেবে দেখার কোন অবকাশ নেই।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা সরকারি কর্মকর্তার কাছে জবাবদিহিতা চাওয়ার অধিকার অবশ্যই আপনার আমার আছে। কিন্তু তার আগে আমার নিজের কাজগুলোও ঠিকমত করতে হবে, অন্যথায় জবাবদিহি চাওয়ার অধিকার আমি হারিয়ে ফেলব। এটা খুবই দুঃখজনক যে, আমাদের বাড়িঘর পরিষ্কার করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত অনুরোধ করতে হয়, এমনই নোংরা জাতি আমরা।
আমার মনে হয় সময় হয়েছে অন্যকে দোষারোপ করার এই হীনমন্যতা থেকে বেরিয়ে এসে দেশের জন্য কিছু করা। আর দেশের যদি কোন উপকার করতে না পারি, অন্তত কোন ক্ষতি যেন না করি। এতে করে সরকারের কাঁধ থেকে অতিরিক্ত জনসংখ্যার ঘনত্বের বোঝা কিছুটা হলেও কমবে, ফলে তাদের কাছ থেকে আরেকটু ভালো সার্ভিস পাব বলে আশা করি।