Published : 15 Dec 2011, 06:11 PM
রক্তক্ষতের অলংকারে আবার এসেছে অভ্রভেদী ভাষার মাস। আসছে শহীদ দিবস, সেই ৬৭ বছর আগে যখন সবার অলক্ষ্যে সময়ের জঠরে বাংলাদেশের ভ্রূণ প্রথম নড়ে উঠেছিল জন্ম যন্ত্রনায়। দেশে বিদেশে আবার মঞ্চে টিভিতে হবে অমর একুশে, সুগভীর শ্রদ্ধায় জাতি স্মরণ করবে বায়ান্নের শহীদদের, গাওয়া হবে "আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো"। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানটা হবে না যেটা আমি দেখতে চাই।
ব্যক্তিগত উপস্থিতিতে ও ইন্টারনেটে দেশে বিদেশে অজস্র একুশের অনুষ্ঠান দেখেছি। ঢাকা কলেজের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এফ এইচ হলের ও বিদেশে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের একটানা প্রায় ১৬ বছর সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে আমার হাত দিয়েই হয়েছে একুশে'র অনুষ্ঠানগুলো। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানটা করিনি। অভিজ্ঞতার অভাব ছিল, অভাব ছিল তথ্যের, অন্তর্দৃষ্টির। তারপরে প্রায় ১৫ বছর আগে পর্যন্ত পরোক্ষভাবে অনেক একুশে অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকে দেখেছি, কিছু অনুসঙ্গ বাদ দিলে সবগুলো অনুষ্ঠানই আগের অনুষ্ঠানের ফটোকপি মাত্র। একুশে এর যে সর্বশ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠানটা দেখতে চাই সেটা হলোনা আজও।
কী সেই একুশের অনুষ্ঠান ? নতুন কী দেখতে চাই আমি একুশে অনুষ্ঠানের মঞ্চে?
১. মঞ্চে নিশ্চয়ই গাওয়া হবে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখা আলতাফ মাহমুদের সুরে আমাদের অনানুষ্ঠানিক দ্বিতীয় জাতীয় সংগীত – "আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো"। বেদনাবিধুর এই অনন্য গান ছাড়া একুশের অনুষ্ঠান কল্পনাই করা যায়না। আমি দেখতে চাই, শুরুতে শিল্পীরা গানটার প্রথম ক'টা লাইন লতিফ ভাইয়ের (বিখ্যাত গায়ক সুরকার আব্দুল লতিফ) সুরে গান। বায়ান্ন থেকে প্রথম ক'বছর গানটা সেই সুরেই গাওয়া হয়েছে, সেই সুর আমাদের ইতিহাসের অঙ্গ । সেটা প্রায় হারিয়েই গেছে, সেটাকে হারিয়ে যেতে দেয়া ঠিক হবেনা।
২. আমি দেখতে চাই শহীদ মিনারের আদি নকশাটা মঞ্চের পেছনের দেয়ালে ফোম বোর্ড বা কাপড় বা কোনও কিছুর ওপরে বানানো বা আঁকা হোক এবং উপস্থাপক বর্ণনা করুন সেই নকশা কারা, কোথায়, কত সালে কোন বৈধতার ভিত্তিতে বানিয়েছিলেন। তিনি এটাও বর্ণনা করুন স্বয়ং সেই স্রষ্টারা সেই মিনারের কোন অংশের কী অনিন্দ্যসুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। দলিলের উদ্ধৃতি দিচ্ছি:-
"১৯৫৬ সালে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করিবার পর জনাব আতাউর রহমান খান শহীদ মিনারের ব্লুপ্রিন্ট ও ডিজাইন তৈরির জন্য প্রখ্যাত স্থপতি হামিদুর রহমানকে নিযুক্ত করেন। শহীদ মিনারের অঙ্গশোভা পরিকল্পনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ও শিল্পী কামরুল হাসান। স্থপতি হামিদুর রহমানের মূল নকশা ছিল নিম্নরূপ:-
স্থপতির ব্যাখ্যা:-
(উদ্ধৃতি শেষ)
{সূত্র – জাতীয় রাজনীতি – ১৯৪৫ থেকে ৭৫ (২য় সংস্করণ) পৃষ্ঠা ১৩৬ – ১৩৭, লেখক বাহান্নর অগ্রগণ্য ভাষা সৈনিক অলি আহাদ, প্রকাশক বাংলাদেশ কোঅপারেটিভ বুক সোসাইটি লি:।}
৩. শহীদ মিনারের সেই তিন স্রষ্টা যখন মাসের পর মাস এ নিয়ে আলোচনা তর্কবিতর্ক (ঝগড়া, মনোমালিন্য ?) করছিলেন তখন সেখানে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত উপস্থিত ছিলেন একজন। তার চোখের সামনে সবকিছু ঘটেছে, তিনি সেই তিন বন্ধুকে চা বানিয়ে দিতেন, হয়তো ডিনারও খাওয়াতেন কখনো। তিনি হামিদুর রহমানের স্ত্রী, শহীদ মিনারের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। তিনি বহু বছর ধরে মন্ট্রিয়লে থাকেন কিন্তু তাকে কেউ কোনওদিন একুশের অনুষ্ঠানে ডেকেছে বলে জানিনা। তাকে যদি মঞ্চে কিংবা কোনো টেলিভিশন শোতে স্কাইপে এনে তার কাছ থেকে দুটো কথা শোনা যেত, মনে কি হতোনা পুরো শহীদ মিনারটাই মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে মঞ্চে উঠে এলো! কিছু কিছু দিক দিয়ে আমরা সত্যিই বড়ো হতভাগা জাতি।
৪. আমি দেখতে চাই মঞ্চে স্লাইডে বা কোনোভাবে দেখানো হোক সেই একুশের রাতেই বানানো একুশের প্রথম শহীদ মিনার, রাজশাহী কলেজ প্রাঙ্গনে সেটা বানিয়েছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। উপস্থাপক মঞ্চে সেটা ব্যাখ্যা করুন। সেটা কয়েক ফুট উঁচু একটা ঢিবির মতো ছিল, সেটার ছবি ইন্টারনেটে পাওয়া যায়, এর ওপরে পত্রিকায় নিবন্ধও ছাপা হয়েছিল।
৫. আমি শুনতে চাই আবৃত্তিকার আবৃত্তি করুন একুশের প্রথম কবিতা "কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি"র অন্তত: কিছু পংক্তি (কবিতাটা অনেক বড়)। এটা সেই একুশের রাত্রেই লিখেছিলেন চট্টগ্রামের ভাষাসৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী, এটা মাত্র কয়েকটা অনুষ্ঠানে শুনেছি।
৬. একুশের অনুষ্ঠান হবে কিন্তু সেখানে বিশ্ব-একুশের নায়ক ভ্যানকুভারের রফিকুল ইসলাম ও তার সহযোগী আব্দুস সালামকে স্মরণ করা হবেনা তাই কি হয়? রফিকুল ইসলাম দুনিয়া ছেড়ে গেছেন কিন্তু আব্দুস সালাম তো এখনো আমাদের মধ্যেই আছেন। আমি দেখতে চাই উপস্থাপক তাদের নিয়ে কিছু বলুন, সম্ভব হলে আব্দুস সালামের ভিডিও করা বক্তব্য শোনান।
৭. বিশ্ব-একুশের একটা গান আছে ইন্টারনেটে, সা-মা-ধা কর্ডে কাহার্বার ওপরে হর্মোনাইজড সুরে। একুশের একটা অনুষ্ঠানে এটার সাথে নাচ দেখেছি আমি, এটা হতেও পারে। লিরিকটা দিচ্ছি:-
দিগন্তরে,
অমর একুশে যুগ যুগান্তরে,
ছড়িয়ে গেলো আজ কি মন্তরে,
মুক্তিকামী মানুষের অন্তরে ।।
ওই একুশে – একুশে – একুশে !!
রফিক সালাম,
দেশ বিদেশে ছড়িয়ে গেলো নাম,
দেশ বিদেশে সবে জানালো সালাম ।।
রক্তরাগে,
শহীদ মিনার কি অলক্ত রাগে,
বিশ্ব বীণায় বাজে সপ্ত রাগে ।
ওই একুশে – একুশে – একুশে !!
কি ঝংকারে
বিশ্ব ললাটে জ্বলে অহংকারে,
একুশে রক্তক্ষতের অলংকারে ।
ওই একুশে – একুশে – একুশে !!
এসো সবে,
বিশ্ব মাতৃভাষার এ উৎসবে,
বাংলার দানে ধরা ধন্য হবে ।
এসো এসো ভাই,
অমর একুশের জয়গান গাই,
মায়ের ভাষার বড় নাই কিছু নাই ।
ওই একুশে – একুশে – একুশে !!
আমি জানি একুশের ওপর এই অনন্য অনুষ্ঠান একদিন হবে। সেদিন হয়তো আমি থাকবো না কিন্তু হবে।