Published : 22 May 2012, 10:26 PM
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করার জন্য দু'দলের সংলাপে বসার পক্ষে বলছেন সবাই। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও সংলাপে বসার আহবান জানিয়ে গেলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার একটা প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ কাদের সঙ্গে সংলাপে বসবে? সেই দলের সঙ্গে কি যারা রাষ্ট্রের মূলনীতিতেই বিশ্বাসী নয়? রাষ্ট্রের আদর্শিক অস্তিত্বকেই যারা মেনে নিতে চায়নি? সামরিক উর্দির অনুশাসনে গড়ে ওঠা দল বিএনপি তো পাকিস্তানি আদর্শে বিশ্বাস করে। স্বাধীনতা অর্জনের পর আমাদের দেশটা গত চল্লিশ বছরের বিশ বছরই ছিল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সামরিক শাসনের অধীন। তাই এতদিনের জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে। যারা দেশটাতে ইসলামাইজেশন বা পাকিস্তানাইজেশন করতে চেয়েছে, তাদের সঙ্গে সমঝোতা কিসের? আমি মনে করি, আওয়ামী লীগ সরকারকে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তৈরির জন্যই ব্যাপক কাজ করতে হচ্ছে।
তাই সমঝোতা হতে পারে সেসব দলের সঙ্গে যারা রাষ্ট্রের মূলনীতিতে বিশ্বাসী এবং সেই সমঝোতায় অবশ্যই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক চেতনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এখানে অনেকেই এখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের কথা বলেন। আমার প্রশ্ন হলো, নিরপেক্ষতা বিষয়টা কী? কেউ কি আসলে নিরপেক্ষ হতে পারেন? এ ধরনের সরকার পুরোপুরি অস্বাভাবিক। পৃথিবীর কোনও দেশে এটা দেখা যায় না। তাই এ ধরনের সরকার গঠনের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধানের চিন্তা করা গণতান্ত্রিক চেতনারই বিরোধী।
এদেশে এখন হরতাল মানেই নৈরাজ্য সৃষ্টি। হরতালের আগের দিন একটি বাসে আগুন দিয়ে একজন ড্রাইভারকেও জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হলো। হরতালের নামে এ ধরনের নৈরাজ্য কোথাও নেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আমি এ ধরনের 'বনধ' বা হরতাল হতে দেখেছি। সেখানে হরতালকারীরা সাধারণ মানুষ বা পথেঘাটে বিভিন্ন যানবাহনের পাশ কেটে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করেন। কোনও ধরনের হিংসাত্মক কাজকর্মের তো প্রশ্নই উঠে না। বিষয়টা হচ্ছে এই যে একটি দেশে যদি গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় তাহলেই এটা সম্ভব। কারণ গণতন্ত্র মানে কিন্তু যা খুশি তা করা নয়। বরং কিছু নিয়ম-নীতি মেনে চলা। এক কথায় যা করা উচিত, তাই করা হলো গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে নিজের বা দলের স্বার্থে কেউ এমন কিছু করবে না যাতে জনস্বার্থ ক্ষুন্ন হয়। গণতান্ত্রিক কাঠামোর একটি রাষ্ট্রে সুস্থ দায়িত্বশীল ও শিক্ষিত নেতৃত্ব গড়ে উঠলে তারা দাবি আদায়ের জন্য ভিন্ন পন্থাই অবলম্বন করবেন। সরকারের ওপর সত্যিকারের কোনও গণদাবি নিয়ে চাপ তৈরি করতে হলে, আমি বলব, হরতাল খুব অনিবার্য কিছু নয়। আমাদের এই দলগুলো গান্ধীজির কাছ থেকেও শিখতে পারেন। গান্ধীজি যে অহিংস আন্দোলন করেছেন, সেটা অনুসরণীয় হতে পারে। তবে আমি বলব, আমাদের বিরোধী দলগুলোর চরিত্র কী সেটাও দেখতে হবে। তাদের এই চরিত্রের কারণে তারা কিন্তু সত্যিকারের কোনও জনদাবি নিয়ে এগুতে পারছে না। নন-ইস্যু নিয়ে হরতাল করছে। দেশে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করে তারা যে কোনও মূল্যে ক্ষমতায় যেতে চায়।
কিন্তু দেশে তো এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যে দেশ পিছিয়ে যাবে বা এমন কিছু। বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করলে বলতে হয়, দেশ কিন্তু খুঁড়িয়ে হলেও এগিয়ে যাচ্ছে। এখন সরকারকে সময় দিতে হবে। পাঁচটা বছর এ সরকারের সময়। নির্বাচন হবে আগামী বছরে। তার আগেই যদি বিরোধী দল অগণতান্ত্রিক উপায়ে সরকারকে সরিয়ে দিতে চায় তবে সেটা হবে অযৌক্তিক একটা দাবি বা আন্দোলন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকারি দলেরও কি কোনও দায়িত্ব নেই? আছে। তাদের উচিত আত্মসমালোচনা করা। আত্মতুষ্টি থাকা ঠিক নয়। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে তাদের আত্মশক্তি অর্জন করতে হবে। সরকারকে অবশ্যই স্পর্শকাতর হলে চলবে না। দলের নামে যারা বিভিন্ন জায়গায় অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে তাদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে সুষ্ঠু রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, দল যাতে কিছুতেই জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে। একেবারে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত সৎ দক্ষ যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। কর্মীরাই নেতৃত্ব ঠিক করবেন। দলের নেতা বা নেত্রী নন। জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্বের ব্যাপারেও একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। দলের মহাসচিব যিনি হবেন তিনি যেন ফুলটাইম দলনেতা হন। এক্ষেত্রে একজন মন্ত্রীকে দলের মহাসচিব করা হলে দল জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। দলও দুর্বল হয়ে যেতে পারে। একজন মন্ত্রী যদি দলের দায়িত্ব নেন, তবে তিনি কোনটি সামলাবেন, মন্ত্রীত্ব না দল? এসব কারণেই দলকে শক্তিশালী করা জরুরি। পাশাপাশি দলের নেতৃত্বকে ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে পারলেও দল শক্তিশালী হবে। নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে যেমন দেখা গেছে, জাতীয় নেতৃত্বের পছন্দসই প্রার্থীর সঙ্গে জনগণের পছন্দের প্রার্থীর মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব ছিল। এসব বিষয় ঠিক করে দলকে শক্তিশালী করতে হবে।
তার মনে রাখতে হবে নিজেদের দুর্বল রেখে কোনও দল সরকার গঠন করলে শক্তিশালী হতে পারবে না। দলকে সুসংহত করাটাই তাই জরুরি।
সালাউদ্দীন আহমদ: জাতীয় অধ্যাপক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।