Published : 01 Jun 2010, 09:10 PM
আমি বেশ ক'বছর ধরেই ক্রমসম্প্রসারণশীল রাজধানীর কিছুটা বাইরে বিমানবন্দর ও টঙ্গী শিল্পাঞ্চল লাগোয়া আবাসিক এলাকা উত্তরায় বসবাস করি। ঢাকার অন্য সকল আবাসিক এলাকার মতই উত্তরায় শুধু যে মানুষ বেড়ে যাচ্ছে তা নয়, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মানুষের চাহিদা মেটানোর অন্য সকল উপকরণ। এর মাঝে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে বাড়ি নির্মাণের হিড়িক। আর চোখে পড়ে আবাসিক এলাকাটির বাণিজ্যিক এলাকা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। আমি যে বাড়িটিতে থাকি তার সমুখের খেলার মাঠটিকেও প্রায়শই দেখি জামদানি মেলাঅলাদের হাতে গুঁজে দিতে, ফলে সঙ্কুচিত হয়ে আসে শিশু ও বয়স্কদের হাঁটা ও খেলার স্পেস। পোশাকি নামে 'মডেল টাউন' হলেও ঐ ধানমণ্ডি বা গুলশানের মত একদার নিরিবিলি টাউনটি আর নিরিবিলি থাকে না, থাকে না এর আবাসিক চরিত্রটিও।
আমি যখন রিকশায় করে এক সেক্টর থেকে আরেক সেক্টরে যাই, তখন আরেকটি জিনিস খুব চোখে পড়ে, সেটি হল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও কিন্ডারগার্টেন। স্কুল বলতে আমাদের যে সাধারণ ধারণা, চোখে যে ছবি ভেসে ওঠে, এসব স্কুল, সেসবের সাথে মেলে না। আবাসিক সব ভবনে, বেশিরভাগই নিচতলাটি ভাড়া নিয়ে, এসব স্কুলের গড়ে ওঠা। মাঠ বলতে সমুখের একচিলতে জায়গা, কোনো কোনোটির আবার তাও নেই। ভেতরে গিয়ে দেখেছি শয়নকক্ষগুলো সব শ্রেণীকক্ষে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় ঘরটি (ড্রইং রুম) দেয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি ছাত্র-ছাত্রী যে ক্লাসের সেই ক্লাসটিকে, সাধারণতঃ যা স্কুলের সবচেয়ে নিচু ক্লাসটি হয় (প্লে গ্রুপ)। যতই উপরের শ্রেণীর দিকে যাওয়া যায়, এসব বিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা ততই কমতে থাকে। আলয়গুলো সব বিদ্যালয় হয়ে যাচ্ছে — দেখে বেশ মজা পাই। ঘরে ঘরে বিদ্যালয় — মন্ত্রের মত শোনালেও এসব স্কুলের ক্ষুদ্র আয়তন আমাদের শিশুদের মনের জগৎকে ক্ষুদ্রকায় করে ফেলে, যারা এখন সকল প্রকার উন্মুক্ত স্থানের অধিকার থেকেই বঞ্চিত।
"
অর্থনীতি যেখানে বাজারমুখী, সেখানে যে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হবে সেটা আশ্চর্যের কিছু নয়। আশ্চর্য হচ্ছে স্কুলগুলোর নিয়ন্ত্রণহীন বেতনবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরার কেউ নেই। তেমনি লাগাম টানা প্রয়োজন কোচিং সেন্টারগুলোর ভর্তিবাণিজ্য ও শিক্ষকদের প্রাইভেট কোচিং অভিমুখী হওয়ার। শিক্ষা বাণিজ্য নয় — এটা সব পক্ষকেই বুঝতে হবে।
কয়েক বছর আগে আমার ছেলেদের এমনি একটি স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে গেলে আমাকে যে কক্ষটিতে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে স্কুলের প্রিন্সিপাল বসেন। ভদ্রলোক নিমগ্ন হয়ে পাশে রাখা কম্পিউটারে কী যেন করছিলেন, অনেকক্ষণ পরে আমার দিকে তার খেয়াল হল। পরে জেনেছি তার নিজের শিক্ষকতার কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তার স্ত্রী একটি স্কুলের ইংরেজীর শিক্ষিকা ছিলেন, স্কুল খোলার আইডিয়াটি তারই এবং (স্বামীর) পদাধিকার বলে তিনি প্রিন্সিপাল হয়েছেন । তিনি দীর্ঘদিন কর্মহীন ছিলেন, এখন এই স্কুল তাকে সক্রিয় রেখেছে। স্কুলটি মূলতঃ তার স্ত্রীই চালান। অন্য একটি স্কুলের কথা জানি যেটা খুলেছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, তিনিও কর্মজীবনে শিশুদের শিক্ষাদানের মত একটি প্রক্রিয়ার সাথে সুদূরতমভাবেও সংযুক্ত ছিলেন না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে শিক্ষালয় হচ্ছে এমন একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যা বেকার বা অবসরপ্রাপ্তদের জন্য নতুন কর্মের সংস্থান করে, স্কুল দাঁড়িয়ে গেলে লাভের দিকটাও মন্দ নয়। এই উত্তরাতেই আছে বেশ কয়েকটি নামি-দামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। তাদের ব্যাবসায়িক সাফল্যে ঈর্ষান্বিত না হয়ে উপায় নেই। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা স্কুলগুলো খোলার পেছনে তারাই বড় অনুপ্রেরণা। অনেকটা আলু-পেঁয়াজ ব্যাবসায়ীদের ফিল্ম বানানোর মত। সিনেমাও তো একটা ব্যবসা, নাকি? তাহলে এডুকেশন কী দোষ করল? তাদের যুক্তি অনেকটা ওইরূপ। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর পালে জোর হাওয়া লাগল যখন দেশে বিশ্বায়নের জোয়ার বইতে লাগল আর মাতম উঠল ইংরেজীর। রাতারাতি অখ্যাত স্কুলগুলো হয়ে উঠল নামি-দামি।
বিপদ হয়েছে পিতা-মাতাদের যাদের সংসারে ডালপালার মত শিশুবাহিনী বাড়ছে আর পিতা-মাতাদের প্রধান স্বপ্ন তাদের সন্তানদের 'মানুষ' করে তোলা। সরকারী স্কুলে 'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই' অবস্থা বহুদিনের। এমতাবস্থায় তাদের পরিত্রাণ ঐ বেসরকারী বিদ্যালয়গুলো যাদের না আছে পর্যাপ্ত স্পেস, না আছে পর্যাপ্ত শিক্ষক। বেশিরভাগ স্কুলের শিক্ষকই হচ্ছেন নারী, যারা মূলতঃ মা ও সংসারী (ইংরেজীতে এখন যাদের কায়দা করে বলা হয় homemaker), এবং যারা মূলতঃ প্রতিবেশী। বেশিরভাগ স্বল্প আয়ের স্কুলে এত কম টাকা বেতন হিসেবে দেয়া হয় যে দূর থেকে এসে বেতনের টাকায়, এমনকি যাতায়াত-ভাড়াও কুলানো যাবে না। অনেক মা-শিক্ষকই যে স্কুলে তার বাচ্চা পড়ে, সেখানেই পড়ান। এতে সময় ও খরচ দুটোরই সাশ্রয় হয়। তবে অনেকেই, এদের বেশিরভাগই পুরুষ, স্কুলে পড়াতে আসেন ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে। বিশেষ করে তারা যদি উপরের ক্লাসের শিক্ষক হন এবং বিজ্ঞানের বা বাণিজ্যের কোনো বিষয় ভাল পড়ান, তবে স্কুল হয়ে ওঠে তার বা তাদের প্রাইভেট কোচিং সেন্টারের ছাত্র-ছাত্রী পাবার সুবর্ণ জায়গা। ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে নিজস্ব কোচিং সেন্টারে পড়াতেই এদের বেশি আগ্রহ এবং তারা ছাত্রদের উদ্দীপিত করেন কোচিং সেন্টারে আসতে। ছোট স্কুল দিয়ে শুরু করলেও তারা ক্রমশঃ এগুতে থাকেন নামি-দামি স্কুলের দিকে এবং একটা সময় আসে যখন তাদের কোচিং-এ এত বেশি ছাত্র-ছাত্রী জুটে যায়, যে তারা তাদের মূল কাণ্ডটি অর্থাৎ স্কুলের চাকুরিটি ছেড়ে দেন এবং রাত-দিন ব্যাচের পর ব্যচ ছাত্র পড়িয়ে চলেন। সারা বছর ধরেই এই কোচিং বাণিজ্য চলে তবে ও-লেভেল বা এ-লেভেল পরীক্ষা মৌসুমে তা তুঙ্গে ওঠে। এ সকল এক্সপার্ট শিক্ষকদের বার্ষিক আয়ের কথা শুনলে অনেকেরই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবে এবং ট্যাক্সেস ডিপার্টমেন্টের লোকদের জন্য তা লোভনীয় খবর হবে।
ইংরেজী শিক্ষার প্রতি আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অভিবাবকদের যে দুর্দমনীয় আকর্ষণ, অপ্রতিরোধ্য টান, চাকুরিবাজারে ইংরেজীর যে বিপুল কদর, বহির্বিশ্বে বাঙালির ছড়িয়ে পড়া, ইত্যাদিই এসব ইংরেজী মাধ্যম স্কুলগুলোর কপাল খুলে দিয়েছে। আমি একটি নামি ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনি, যেটি স্কুলের উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে খুলে বসেছে একাধিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, স্কুলটি হয়ে উঠেছে একটি কর্পোরেট হাউজ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এদের অধিকাংশ ব্যাবসাই লোকসান করে, ফলে সেগুলোকে রক্ষা করার জন্য স্কুলটিতে আরো ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করতে বাধ্য হন এর কর্তৃপক্ষ, শিক্ষকদের বসার ঘরগুলোও ক্লাসরুমে রূপান্তরিত হয়ে যায়; একেকটি শ্রেণীতে ইংরেজী বর্ণমালায় যতগুলো অক্ষর আছে, ততগুলো সেকশন খোলা হয়, এমনকি সন্তানদের নিতে আসা অভিবাবকদের অপেক্ষার খোলা জায়গাগুলোয় রাতারাতি দেয়াল তুলে শ্রেণীকক্ষ বানানো হয়। স্কুলটি হয়ে ওঠে সত্যিকার অর্থেই একটি Cash Cow।
সেদিন উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরের মাঝ দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম একটি স্কুলের দেয়ালে একটি ব্যানার ঝুলছে Admission Going On। মনে পড়ল, গত কয়েক মাস ধরেই ঐ ব্যানারটি ঝুলছে। অর্থাৎ সেশন শুরুর কোনো চৈত্র-বৈশাখ নেই, ছাত্র এলেই সেশন শুরু হয়ে যাবে। বুঝি স্কুলটি ছাত্রখরায় ভুগছে। এরকম স্কুল একটি নয়, অনেক। বুঝি সারা বছর ধরেই ওরা ভর্তি-প্রক্রিয়া খোলা রাখে। নামি স্কুলগুলোর চিত্র ঠিক এর উল্টো, সেখানে ভর্তি করানো সহজ নয়। আমাদের অতিরিক্ত জনসংখ্যার কল্যাণেই অনাগত শিশুরাও লাইন ধরে আছে প্রেস্টিজিয়াস সব স্কুলে ভর্তি হবার জন্য। তাদের অতিউৎসাহী পিতারা টাকা (donation) ও ক্ষমতার জোরে সহজেই নিজ নিজ সন্তানদের ভর্তি করিয়ে ফেলেন আর গর্বিতা মায়েদের টেবিলটকের একটি প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায় স্কুলের সামাজিক মর্যাদা। অথচ এসব স্কুলের নিচুতম ক্লাসটির শিক্ষার্থীর মাসিক বেতন বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের মাসিক আয়ের চেয়ে বেশি। যে টাকায় একটি গোটা পরিবার পুরো মাস কালাতিপাত করে তা হচ্ছে একজন ছাত্রের বেতনের সমান। ঢাকার আলাদিনের চেরাগ পেয়ে হঠাৎ ফুলে ওঠা পরিবারগুলোর এই রমরমা অবস্থা এখানে টেনে এনেছে আরো ব্যয়বহুল বিদেশী স্কুল। জমজমাট হয়ে উঠেছে শিক্ষাবাণিজ্য।
আমাদের শৈশব-কৈশোরে গ্রামাঞ্চলে যে সব শিক্ষক আমাদের পড়িয়েছেন তাদের অনেকেই শহরে ভাল চাকুরির লোভনীয় প্রস্তাব দূরে ঠেলে বা চাকুরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে গিয়ে শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেছিলেন। তখন এ পেশা ছিল দেশ ও দশের সেবা করার একটি ব্রত। আজকের দিনেও শিক্ষকদের যে উঁচু সামাজিক মর্যাদা, যে সম্মান তারা সমাজের অপরাপর মানুষদের কাছ থেকে পান তা ওইসব আত্মত্যাগী, সমাজদরদী শিক্ষকেরাই রচনা করেছিলেন।
এখন গ্রামে গেলে একেবারে উল্টো চিত্র দেখি। শিক্ষকদের নিজেদের একাডেমিক রেকর্ডের দিকে তাকালেই এটা বোঝা যায়। যারা নিজেরা শিক্ষাজীবনে ভাল ফলাফল করতে পারেননি, বা খুঁজে পাননি অন্য কোনো মানানসই চাকুরি, তারাই হতাশ হয়ে উৎকোচ বা রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে সরকারী বিদ্যালয়ে- মহাবিদ্যালয়ে নিযুক্তি পেয়ে যাচ্ছেন। মুখস্থবিদ্যার এ শিক্ষাব্যবস্থায় মানসম্পন্ন ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ছাড়া এবং অপ্রতুল কাঠামো ও সুযোগ-সুবিধায় আমাদের ছাত্ররা কতটুকু শেখে সে আরেক প্রশ্ন।
শিক্ষা যে পণ্যে পরিণত হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ একটি দেশে যেখানে সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অপ্রতুল, অর্থনীতি যেখানে বাজারমুখী, সেখানে যে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হবে সেটা আশ্চর্যের কিছু নয়। আশ্চর্য হচ্ছে স্কুলগুলোর নিয়ন্ত্রণহীন বেতনবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরার কেউ নেই। তেমনি লাগাম টানা প্রয়োজন কোচিং সেন্টারগুলোর ভর্তিবাণিজ্য ও শিক্ষকদের প্রাইভেট কোচিং অভিমুখী হওয়ার। শিক্ষা বাণিজ্য নয় — এটা সব পক্ষকেই বুঝতে হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতির চাহিদা বনাম যোগানের শর্ত মেনেও এটা বলতে হবে যে, শিক্ষা যে কোনো শিশুর জন্মগত অধিকার। আর সে অধিকার নিশ্চিত করার প্রাথমিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র ব্যর্থ হলে যে অরাজকতার সৃষ্টি হবে তা থেকে মুক্তি পাবে না কেউ।