Published : 31 May 2010, 12:21 AM
বন্ধ করে দেবার পর ফেইসবুক নিয়ে যত আলোচনা আর অনুসন্ধিৎসা দেখা যাচ্ছে তামাম 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' সংক্রান্ত প্রপাগান্ডা কালেও সেরকম উদ্দীপনা কিংবা আস্থা লক্ষ্য করা যায়নি। 'গণ'জোয়ারের এই হিসেবে 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' কায়েম করবার জন্য এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী আইটি কিংবা যোগাযোগ-প্রযুক্তিকেন্দ্রিক পদক্ষেপ বলা চলে এটাকে। অবশ্যই তুলনা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ আর একটা মাত্র পদক্ষেপই পাওয়া সম্ভব। ইউটিউব-এর একটি ভিডিওফুটেজ প্রচারকে কেন্দ্র করে তা বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা সেটা। পাশ্চাত্যে বসবাসকারী, ফলে অনায়াসে উৎকৃষ্ট প্রযুক্তি-সুবিধায় থাকা, বাংলাদেশী নাগরিকেরা কৌতুক বোধ করছেন খুব। ইমেইল যোগে জানতে চাইছেন, মন্তব্য করছেন এবং টীপ্পনি কাটছেন। এবং অবশ্যই আরেক দল মানুষ রাজনৈতিক লয়্যালটির কারণে বিব্রতভাবে খোঁজখবর নিচ্ছেন। পরিস্থিতিটা মজার, কিন্তু একই সঙ্গে ভাবনাচিন্তা খরচ করবার মতো।
ফেইসঅফ নামের ছায়াছবিটা দেখেছিলাম অকস্মাৎ। গুছিয়ে-গাছিয়ে পছন্দনীয় ছায়াছবির নাম ও ডিভিডি সংগ্রহ করে যাঁরা দেখেন তাঁদের কাতারে আমি নেই। ফলে বাসায় একটা টেলিভিশন যখন থাকে, তখন চ্যানেল টেপাটেপি করতে গিয়ে চোখে কোনো ছবি আটকে পড়লে আধখানা কিংবা তিনপোয়া ছবি দেখা হয় আমার। এভাবেই ফেইসঅফ চোখে পড়ে। এবং এরপর খেয়াল করে করে বিভিন্ন চ্যানেলে বার তিনেক ছবিটা আমি দেখি। গুরুতর কিছু নয়। কিন্তু গল্পটায় একটা চমক আছে। তবে জন ট্রাভলটা'র প্রতি আমার কিছু প্রশ্রয় থাকাতেই বারবার দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। গল্পে চমক আছে এই অর্থে যে এখানে দুজনের চেহারা বদলে যায় এবং 'খারাপ' লোকটা কারসাজি করে 'ভাল' লোকের চেহারা নিয়ে নানান রকম প্যাঁচ লাগাতে থাকে। বিপরীতে 'ভাল' লোকটারও 'খারাপ' লোকের চেহারা নিয়ে ল্যাবরেটরি থেকে বেরোনো ছাড়া কোনো পথ থাকে না। ইত্যাদি। যতই চমক থাকুক বাংলা অঞ্চলের রূপকথায় গর্দানের উপর মুণ্ডু বদলে যাবার কল্পনাটা আচানক কোনো বিষয় নয়। ছবিটার কৃতিত্ব, অন্য অনেক হলিউডি ছবির মতোই, রুদ্ধশ্বাস সব ঘটনা আর প্রতিপক্ষতার কারণে।
"
'ধর্মীয় এবং সামাজিক মূল্যবোধ'। এই দুই কিংবা এই দুয়ের প্যাকেজ ইদানীংকালের বছরগুলোতে পুনঃ পুনঃ ব্যবহৃত হয়ে ঝোলের লাউ অম্বলের কদুতে পরিণত হয়েছে।… ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ বলতে আসলে কী বোঝায় এবং এ দুয়ের মধ্যে ফারাক কী, আদৌ আছে কিনা—এগুলো সরকারী ভাষ্যে বরাবর দুর্বোধ্য এবং প্রায়শই পাঠক-মনে কোনো কৌতূহল তৈরি করে না। তবে মূল্যবোধের দোহাই কখন দেয়া হয়, আর বিশেষভাবে কখন কখন দেয়া হয় না সেগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌতূহলোদ্দীপক।
"
কী কী কারণে এই অভূতপূর্ব পদক্ষেপ সরকার নিয়ে থাকতে পারেন কিংবা কতদিন পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে তা নিয়ে অনেক আলাপ চায়ের আসরে হচ্ছে। সরকারীভাবে যে কারণ দেখানো হচ্ছে তা বাংলাদেশে নতুন নয়। পত্রিকা-পড়া মানুষজন এটা এখন মুখস্থই করে নিয়েছেন। 'ধর্মীয় এবং সামাজিক মূল্যবোধ'। এই দুই কিংবা এই দুয়ের প্যাকেজ ইদানীংকালের বছরগুলোতে পুনঃ পুনঃ ব্যবহৃত হয়ে ঝোলের লাউ অম্বলের কদুতে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো হরে দরে ব্যবহার করে আসছে। বিস্ময়ের না যে তত্ত্বাবধায়ক ওরফে জরুরি সরকারও তা ব্যবহার করেছে। ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ বলতে আসলে কী বোঝায় এবং এ দুয়ের মধ্যে ফারাক কী, আদৌ আছে কিনা—এগুলো সরকারী ভাষ্যে বরাবর দুর্বোধ্য এবং প্রায়শই পাঠক-মনে কোনো কৌতূহল তৈরি করে না। তবে মূল্যবোধের দোহাই কখন দেয়া হয়, আর বিশেষভাবে কখন কখন দেয়া হয় না সেগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌতূহলোদ্দীপক। একটার পর একটা শপিং মল তৈরি হলে দেয়া হয় না, অহেতু টেলিভিশন চ্যানেল উল্লম্ফনে দেয়া হয় না, রাত্রিকালীন রেস্তোঁরা বৃদ্ধিতে দেয়া হয় না, নানান রকম প্রতিযোগিতাতে দেয়া হয় না; ইত্যাদি। সারাংশে, কর্পোরেট প্রায় কোনো উদ্যোগকেই মূল্যবোধ দিয়ে শাসানোর নজির সরকার কিংবা রাষ্ট্র তরফে নেই বললেই চলে। পক্ষান্তরে, নানান রকম পাবলিক পরিসরকে মূল্যবোধ দিয়ে শাসানোর নজির আকছার বিদ্যমান। ফলে মূল্যবোধের জুজুবুড়িটা কখন কীভাবে হাজির করা হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার।
সাম্প্রতিক ফেইসবুক বন্ধ করার উদ্যোগ একটা ব্যাপার নিশ্চিত করেছে, তা সে সুপরিকল্পিত হোক বা না হোক। বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক হাতিয়ারকে ভোঁতা করে দিয়েছে এই পদক্ষেপ। আন্দোলনের পরিকল্পনা সামাজিকভাবে যতই 'মহৎ' করে দেখানোর সম্ভাবনা থাকুক না কেন, এই মুহূর্তে গণ-জবান বা পাবলিক-ডিসকোর্স সচল আছে ফেইসবুক বন্ধ হয়ে যাওয়া বিষয়ে। সরকার তরফে এই সাফল্য দুর্দান্ত। অনুমান করা যায়, যদি সুচিন্তিত পদক্ষেপ হয়ে থাকে, তাহলে সরকারের থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক দারুণ সব মাথায় ভরা। কিন্তু এই সাফল্যটা সরকারের চড়া দামে কিনতে হয়েছে। হিসেবটা তাঁরা আগে থেকে কষে না রাখলেও দামটা উসুল করতে হচ্ছে। ফেইসবুকের ব্যবহারকারী অবধারিতভাবে নাগরিক এবং সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষজন। তেমন ব্যতিক্রম না থাকলে কিতাবী শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষজনও বটে। যদি যেমনটা বলা হচ্ছে ৮ লক্ষ লোক বাংলাদেশে ফেইসবুকের গ্রাহক হয়ে থাকেন তাহলে তাঁরা রাষ্ট্রীয় পলিসি নির্মাতা ও পরিচালকবর্গের বড় অংশ যোগান দিয়ে আসছেন। অন্তত এঁদের পরিবারের লোকজনই এই গোষ্ঠীর অংশ। এরকম একটা নাগরিক অংশ প্রায় এক লহমায় সরকারের নিন্দুক হয়ে পড়ল, কিংবা ঘোরতর অসন্তুষ্ট–এই বাস্তবতা সরকারের জন্য আরামদায়ক হবার কথা নয়। সম্ভবত, সরকার আশা করছেন ক'দিন পরে যখন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবেন তখন এই পক্ষের পূর্বতন সন্তোষের সিংহভাগই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। এটা ছাড়া সরকারের বিশেষ কোনো পথ খোলা নেই।
দোহাই মূল্যবোধের দেয়া হোক কিংবা সমাজের, ইন্টারনেট বাস্তবতায় অভিব্যক্তির শাসন কিছুতেই আর সহজ নেই। প্রিন্ট-দুনিয়ার মতো কিছু এখানে ধুম করে বন্ধ করে দেয়া যায় না। প্রিন্ট দুনিয়ার মতো এখানে কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশও অত কঠিন কিছু নয়। যত বেশি এখানে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হবে ততই নানাবিধ গেরিলা/চোরাই পদ্ধতি মানুষজন খুঁজে পেতে চেষ্টা করবেন, এমনকি উদ্ভাবনের চেষ্টাও। ইন্টারনেট ও কম্প্যুটার মাধ্যমের পাটাতনের মধ্যেই এই উদ্ভাবনী তাগিদটা আছে। রসিক লোকজন কিন্তু ইতোমধ্যেই সরকারকে আবডালে পরামর্শ দিচ্ছেন খোদ নেটের ব্যবহারই বন্ধ করে দিতে। আরও একধাপ এগিয়ে কেউ কেউ আড্ডায় কম্প্যুটার ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ করছেন। এসব আলাপ এখন পর্যন্ত রসিকতার পর্যায়ে। রসিকতার কারণ নিশ্চয়ই ইন্টারনেট ব্যবহারে যেকোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞার অবাস্তব দিকটি। কিন্তু একটা সিরিয়াস ভাবনা হিসেবে একে প্রশ্রয় দিলে গোড়াতেই প্রশ্নটা চলে আসে যে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন কে বা কারা? যদি নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠী নিজেদের অমিত শক্তিধর ভাবেন তাহলে কম্প্যুটার বা অন্ততঃপক্ষে ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করা খুব অসম্ভব প্রস্তাবনা কি? অন্ততঃ পরীক্ষামূলকভাবে? মুদ্রণ দুনিয়ার মতো নেটের দুনিয়ার চালিকা শক্তির খোঁজ-খবর কি আমরা রাখি? কারা কী স্বার্থ নিয়ে এখানে কাজ করছেন এসব জিজ্ঞাসা নিয়ে অনেক অনুসন্ধিৎসা কি দেখা দিয়েছে আমাদের? এমনকি সমাজ-রাজনীতি নিয়ে মনোযোগী এমন নেট-ব্যবহারকারীদেরও?
ফেইসঅফ-এ মুখের আদল বদলালেও চিন্তাশক্তি বা ভাবনা পদ্ধতি বজায় থাকে ধড়ের মালিকের। সেই কারণে দর্শকদের জন্য পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণটা অপেক্ষাকৃত সহজ। তারপরও, দু'জন দক্ষ অভিনেতা প্রায়শই ভেজাল লাগিয়ে দেন যে আসলে আপনি ট্রাভলটার মুখের পিছনে যে মানুষটা দেখছেন সেটা আসলে সেই 'ভাল' মানুষটা যা কিছুক্ষণ আগে নিকোলস কেইজ চালিয়ে নিয়েছিলেন। একটু প্যাঁচ লাগলেও মোটের উপর দর্শক হিসেবে আপনার আকাঙ্ক্ষা কিংবা পক্ষাবলম্বন ঠিকঠাক মতো চালিয়ে নিতে পারেন। ফেইসবুক বন্ধ করার এই ঘটনায় কার ধড় কার মুণ্ডু কোথায় বসছে সেটা নিয়ে পেরেশান হওয়া ছাড়া উপায় নেই। উপরন্তু এটা কেবল অবয়ব বদল নাকি ভাবনা-চিন্তার বদল, কে কোন পক্ষে খেলছেন সমানে বিভ্রান্তিকর। যদি সরকারের ধড়ের উপর 'মূল্যবোধ'ওয়ালা কোনো গোষ্ঠী মুণ্ডু চাপিয়ে দিয়ে থাকে তাহলে বিপদটা কেবল বর্তমান সরকারের জন্য নয়, পাবলিকের জন্য আরও বেশি। ছদ্মবেশী সরকারের থেকে স্বরূপে 'ধর্মীয় মূল্যবোধ'পন্থীদের দেখা অনেক সুবিধাজনক। কিন্তু যদি সরকারের ধড়ের উপর রাষ্ট্রীয় এজেন্সির মাথা চেপে থাকে সেটা রীতিমতো ভয়ানক। এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেবার কোনো কারণ নেই যে কোনো কোনো নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠী আসলে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের শিক্ষিত মানুষজনের যোগাযোগ পদ্ধতি ও তৎপরতাকে স্রেফ গবেষণা হিসেবে নিয়েছে। সরকারের ধড়টা ব্যবহার করে সে তার মনুষ্য-অধ্যয়ন সেরে নিচ্ছে। জরুরি অবস্থাকাল থেকে এধরনের সম্ভাবনা বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে।
সরকার-ঊর্ধ্ব শাসনপ্রণালীর সম্ভাব্য অস্তিত্ব ভীতিকর। সার্জিক্যাল ল্যাবরেটরিটার তাহলে দখল নেবে কে? ফেইসবুক খুলে দিলেই কি নেটের ব্যবহারকারীরা নিয়ন্ত্রকদের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারবেন? ইন্টারনেটকে একটা অভিব্যক্তি-প্রকাশের স্বতস্ফূর্ত মাধ্যম ধরে নিলে এর ব্যবহারকারীদের নিজেদের শক্তিমত্তার পরিচয় দিতে হবে। এবং খুব শিগগিরই।