Published : 22 Sep 2016, 09:57 AM
কীভাবে যেন পাল্টে গেছে আমাদের দেশ। কোন মন্ত্রে কোন বুদ্ধিতে কোন উস্কানিতে জানি না, বাংলাদেশ এখন আর আগের জায়গায় নাই। তার গায়ে উন্নয়নের হাওয়া যেমন লেগেছে তেমনি এর শরীরে এখন যন্ত্রণার দাগও কম নয়। এত মারামারি এত হানাহানি এত অপরাধ আগে দেখিনি আমরা। এত মিডিয়া এত প্রচার এত শোরগোল, মানুষ কোনটা রেখে কোনটা নেবে সে ভাবনায় অস্থির!
না, আজ কোনো রাজনীতির কথা বলতে আসিনি। রাজনীতির বদদোষ বা ধারাবাহিক অপরাধপ্রবণতা নিয়ে বলার কিছু নেই। ওগুলো এ জীবনে শোধরাবার নয়। আমি বলব এমন এক অপরাধের কথা যা সমাজজীবন আর সম্পর্কের বারোটা বাজিয়ে জাতিকে পঙ্গু করে ফেলবে একদিন।
কত কত খবরের ভীড়ে চাপা পড়ে-যাওয়া একটি খবর, অসহায় মা-বাবার নিদারুণ করুণ পরিণতির এই খবর সহজভাবে নিলে চলবে না। এটা এক অশনি সংকেত। আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাংলাদেশ যত উন্নতি করুক, যত সামনে যাক, তার চারিত্র্য এখনও সরলতায়। এখানকার জীবন এখানকার মানুষ রাতারাতি বদলে যাবার নয়। তারা হয়তো ভালো থাকার জন্য পাশ্চাত্যের অনেক কিছু নেয়, তাদের জীবনে পোশাকে আহারে নানা দেশের ছাপ পড়ে বটে, কিন্তু তাদের মন বদলায় না।
এদেশে আসেনি এমন শক্তি বা সামন্তের সংখ্যা হাতেগোনা। ইংরেজ পর্তুগিজ ফরাসী জার্মান পাকিস্তানি, সবাই এসেছিল। আছে হিন্দির আধিপত্য। কিন্তু দিনশেষে আমরা সবাই মা ও মাটির টানে বাংলাদেশি। আর কোন দেশে মা ও ভাষা একাকার?
দেশ ও জননীকে এভাবে একত্রিত করে ভালোবাসে না কেউ। এদেশের সংস্কৃতিতে মা-বাবার সম্মান, মা-বাবার প্রতি সন্তানের টান কিংবদন্তীতুল্য। আমাদের সিনেমায় নাটকে গানে শিল্পে মায়ের জয়জয়কার। শুনতে ভালো লাগুক আর নাই লাগুক, 'মাগো মা ওগো মা আমারে বানাইলি তুই দিওয়ানা' গানের মতো পাগল-করা ভালোবাসায় মাকে মাথার ওপর রাখি আমরা। বাবা সংসারে এমন একজন মানুষ যিনি শুধু অর্থের যোগানদাতা নন, আমাদের আকাশ। একজন আমাদের নিঃশ্বাস বাতাস আর জীবন বাঁচান, আর একজন মাথার ওপর না থাকলে রোদে-জলে ভিজে বাঁচার কোনো উপায় থাকত না। সে মা-বাবার জায়গাটাই এখন নড়বড়ে!
সেদিন একজন লিখেছেন, সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্ক নাকি এখন দেওয়া-নেওয়ার ওপর নির্ভরশীল– যে মা-বাবা যত বেশি গিফট দিতে পারেন তারাই নাকি তত প্রিয় সন্তানের কাছে! লেনদেনের এই সম্পর্ক কবে থেকে শুরু হল? আমরা কি মা-বাবার কাছ থেকে উপহার নিতাম না? নিতাম শুধু নয়, কান্নাকাটি বায়না রাগ করে বাড়ি ছেড়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য পালিয়ে গিয়েও আমরা প্রাপ্য আদায় করতাম।
তার মানে এই নয় যে, আমরা তাদের সমস্যা বুঝতে পারতাম না। বাবার অসহায় মুখ আমাদের পীড়িত করত। মা যখন অধোবদনে পারবেন না বলতেন, বুক ভেঙ্গে গেলেও আমরা তা মেনে নিতাম। কারণ আমাদের সময় গানে বলা হত, 'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই'।
সে মোটা কাপড় আর মোটা আহারের জীবন ছিল সুন্দরতম। আমরা দেখতাম, বাবা আসতেন কর্মক্লান্ত হয়ে। তাঁকে বসার ছোট চৌকি বা চেয়ার পেতে দিয়ে মা লেগে যেতেন রান্নায়। সে কী মধুর সম্পর্ক! একজন সারা দিনের ঘটনা বলে চলেছেন আর একজন রান্না করে করে পাতে তুলে দিচ্ছেন। এর নাম যদি ভালোবাসা না হয়তো কার নাম ভালোবাসা? তাদের সন্তানরা তো মায়ার জগতেই বড় হবে। তারা শিখবে মা-বাবার মতো একে অন্যকে ভালোবাসাই হচ্ছে জীবন।
গতি ও প্রগতির তফাৎ বুঝতে পারছে না আজকের প্রজন্ম। তারা ভাবছে জীবন মানে কিছু দামি জিনিস। যারা এগুলোর পেছনে ছুটছে তাদের দোষ দিয়ে লাভ হবে না। আগে চিন্তা করে দেখুন সমাজকে আমরা কোথায় নামিয়ে এনেছি। একটা সময় ছিল যখন জীবন মানে 'প্লেইন লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং'। পরে সেটা হল, 'হাই লিভিং অ্যান্ড প্লেইন থিংকিং'। আর এখন তা 'হাই লিভিং অ্যান্ড নো থিংকিং'।
সংসারজীবনে কোথাও আর আগের মতো নিয়ম-নীতি চলে না। চলে না আদর্শ বা ন্যায়ের কথা। যেসব তরুণ-তরুণী পথভ্রষ্ট, যারা জীবনটা ভোগের বস্তু মনে করে, তাদের কাছে উপভোগ বিষয়টা তুলে ধরেনি সমাজ। ভোগের এই প্লাবনে তারুণ্য যে পথ হারাবে সেটাই তো স্বাভাবিক। সমাজবিজ্ঞানী বা সমাজ সংস্কারকদের দিকে তাকানো যায় না। তারা আছেন তাদের নিজস্ব বিষয় নিয়ে। কারও চোখে সিংহাসনের স্বপ্ন। কারও চোখে নগদ লাভের। কার কারও আছে রাজনৈতিক দলকানা স্বভাব। এখন মানুষ আর তাদের বিশ্বাস করে না। বিশ্বাসের জায়গাটা এভাবে আগে কখনও টোল খায়নি।
সে নড়বড়ে জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে তারুণ্য যে যা খুশি তা-ই করবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়? সে কারণে এখন মা-বাবাও সন্তানের কাছে নিরাপদ নয়। নিরাপদ যে নয় তার প্রমাণ পেলাম এক সন্তানের আচরণে। মোটর সাইকেল কিনে দিতে পারেননি বলে মা-বাবার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া সন্তানকে আমরা কী নামে ডাকব? হত্যাকারী, না ঘাতক? না কুসন্তান? যেটাই বলি না কেন আজ এটাই বাস্তবতা!
এককালে সন্তানরা ছিল অনুগত। তাদের স্বভাবে আচরণে ছিল ভদ্রতা বিনয়। বলছি না এখন সবাই অভদ্র আর অবাধ্য। কিন্তু বাধ্যতার সংজ্ঞা আর আগের মতো নেই। পোশাকের মতো, কানে-গোঁজা মোবাইলের হেডফোনের মতো তাদের কান ঠেসে আছে নানা যন্ত্রে। কোনো নীতিকথাই কানে ঢোকে না তাদের। সময় নেই মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার। বাড়িতে কী হয় কী হচ্ছে কার কী লাগছে কার কী লাগবে কেউ জানে না। সবাই শুধু জানে তার কী চাই!
এই চাওয়ার কালো হাত ধরে লোভ আর লালসা ঢুকেছে সমাজে। পরিবারে বন্ধন বলে কিছু নেই। মেকি যত সম্পর্কের খপ্পরে পড়ে মানুষ হয়ে উঠেছে পশুর অধম। কারও চোখে আলো নেই, মনে রোদ নেই, মুখে পড়ে না জোসনার ছায়া। সবাই দিনমান কম্পিউটারে মুখ গুঁজে। রাত কাটে ফেইসবুকে। মোবাইলে।
এভাবে শেকড়হীন হয়ে-ওঠা সন্তান কখন যে নাড়ির টান ছিঁড়ে অচেনা হয়ে পড়ে কেউ জানে না। আজ যারা জঙ্গি, যাদের লাশ নিতে অভিভাবকরা পর্যন্ত যায় না, তারাও এই প্রক্রিয়ার শিকার। তাদের পথটা হিংসা আর উন্মাদনার বলে সবাই তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু যারা সামান্য মোটর সাইকেল বা উপহার না পেয়ে মা-বাবাকে জ্বালিয়ে দেয় তারাও কি এক ধরনের সন্ত্রাসী নয়?
সন্তানের আক্রমণের শিকার মা-বাবার জন্য আহা-উহু করে পাশ ফিরে ঘুমালে সময় কি আমাদের ছেড়ে কথা বলবে? আজ আপনি নিরাপদ বলে ভাববেন না কাল আপনার ঘরে এই ঘটনা ঘটবে না। যেভাবে চলছে দেশ, সমাজ, তাতে এ কথা বলা যাবে না যে, কেউ আসলে নিরাপদ।
এই যে উগ্রতা এর পেছনে কি রাজনীতির ইন্ধন নেই? এদেশে এই সেদিনও একদল আরেক দলের ওপর রাগ করে মানুষ জ্বালিয়ে দিয়েছিল। হাসপাতালে সেসব পোড়া মানুষের আহাজারি আমাদের মনে দাগ কাটলেও তরুণ হয়তো ভেবেছে এভাবেও প্রতিশোধ নেওয়া যায়। সরকারি দলও কম যায় না। প্রকাশ্য দিবালোকে তারা এক দর্জিকে কুপিয়ে মেরে দেখিয়েছে কীভাবে খুন করতে হয়। এমন সমাজে একজন তরুণ তার মা-বাবাকে পুড়িয়ে মারতে চাইলে সব দোষ কি আসলে তার?
জীবনের চারদিকে অন্ধকার, বই নেই, পাঠ নেই, ভালো সিনেমা নেই, ছবি নেই। কতদিন একটা মনকাড়া কবিতা হয় না। শুধু লাইক-কমেন্ট অার খাওয়া-দাওয়া। মনে হয় হোটেল অার ধর্মপালনের জন্য জন্মেছি আমরা। এই দুঃসময়ে ধর্মের বাণীও নীরব।
যে তরুণ মা-বাবার জীবনের চেয়ে একটি মোটর সাইকেলই বড় মনে করে তাদের পুড়িয়ে দিয়েছে, সে অাগুন এখন সমাজের সবখানে। কে এর বিচার করবে? কোথায় এর সমাধান।
গভীরভাবে ভাবার এখনই সময়।