Published : 03 Sep 2016, 02:04 PM
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যখন একের পর এক এক জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছেন, গুলশানে জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে যখন দুজন পুলিশ কর্মকর্তাকে জীবন দিতে হয়েছে, তখন জঙ্গি ইস্যুতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য আবারও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। দলটি নিয়ে সামগ্রিক হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি তিনি বলেছেন–
''এই সরকার কথায় কথায় কিছুদিন পরপর জঙ্গির ধোঁয়া তুলে। অমুক জায়গায় এতজন জঙ্গি পাওয়া গেছে। তারপর জঙ্গিগুলোকে ধরে, সত্যিকার জঙ্গি কি না জানি না। কিছু লোক তাদের ধরা থাকে। এগুলোকে না খেয়ে খেয়ে দীর্ঘদিন বন্দী করে রেখে তাদের দাঁড়ি-চুল বড় করে, বিদঘুটে চেহারা হয়ে যায়। তারপর তাদের জঙ্গি বলে সামনে নিয়ে আসে। আর কতগুলো পুলিশ আছে, অস্ত্রশস্ত্র সাজিয়ে বলে এরা জঙ্গি, হরকাতুল জেহাদ, এদের ধরেছি। তার কিছুদিন পর দেখা যায়, লোকগুলোকে ধরে, তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়। কেন গুলি করে মেরে ফেলা হয়? দেশে আইন আছে, আদালত আছে, জিজ্ঞাসাবাদ করবে। এগুলো দুঃখজনক ঘটনা।''
দেশের একজন দায়িত্বশীল নেত্রীর মুখ থেকে এমন বিভ্রান্তিকর মন্তব্য সচেতন মহলকে নির্বাক করেছে।
বেগম জিয়ার উল্লিখিত মন্তব্যের প্রতিউত্তরে এক আওয়ামী লীগ নেতা যথার্থই বলেছেন, ''জঙ্গিদের লাশ যেখানে তাদের পরিবার নিতে চাইছে না, এমনকি পরিচয় পর্যন্ত দিতে চাইছে না, সেখানে খালেদা জিয়া জঙ্গিদের কেন মারা হল তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যখন গোটা দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তখন তাদের (জঙ্গিদের) জন্য বেগম জিয়ার এ মায়াকান্নাই প্রমাণ করে দেয় যে, জঙ্গিদের আশ্রয়দাতা ও পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন তিনি।'
বেগম খালেদা জিয়া এই অভিযোগের কী জবাব দেবেন?
বেগম জিয়া যা বলেছেন, এটা অত্যন্ত গুরুতর একটা অপবাদ পুলিশের নামে। তাঁর কাছে যদি তথ্য-প্রমাণ থাকে তাহলে সেগুলো উপস্থাপন করা উচিত। তাঁর অভিযোগ যদি সত্য হয়, তবে অভিযুক্ত পুলিশের বিচার হওয়া উচিত। আর যদি কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই তিনি এসব কথা বলে থাকেন, তবে সে বিষয়ে তাঁর জবাবদিহি করা উচিত। জঙ্গিবাদের মতো একটা স্পর্শকাতর ইস্যুতে কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়া এ জাতীয় মন্তব্য করা অবশ্যই অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর যে সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গুলশান, শোলাকিয়া, কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জ, সর্বশেষ মিরপুরে জঙ্গিদের ধরতে, নিষ্ক্রিয় করতে, জিম্মি উদ্ধারে অংশগ্রহণ করেছেন এবং অপারেশনের সময় যে সব পুলিশ অফিসার নিহত-আহত হয়েছেন, খালেদা জিয়ার এসব বক্তব্য তাদের প্রতি চরম অবজ্ঞার শামিল।
জঙ্গিবাদে যুক্ত থাকার অভিযোগে যারা মারা গেছে তাদের বাবা-মা বলছে তাদের ছেলে জঙ্গি, আর বেগম জিয়া এটা কী বলছেন? তিনি কেন জঙ্গিদের জন্য মায়াকান্না কাঁদছেন? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতা বাড়ে, কিন্তু বিএনপি নেত্রী কি উল্টোপথে হাঁটছেন? তিনি কী জঙ্গিবাদের প্রতি ভালোবাসা থেকে এ ধরনের মন্তব্য করেছেন? নাকি কোনো কিছু না ভেবেই বললেন?
তামিমকে নিয়ে কানাডার পত্রিকায় ও আইএসের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে প্রতিবেদন পাওয়া গেছে– এর সবই কি অসত্য? যে পরিবারগুলোর যারা নিখোঁজ হয়েছে, নিহতদের সম্পর্কে পরিবারের সদস্যরা যে সব তথ্য বলছে, তা-ও কি বাতিল করা যায়?
দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বেগম জিয়া বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পদ্মা সেতু নিয়েও অনেক মনগড়া অভিযোগ করেছেন। বাস্তবতা হল, দুই দফা ক্ষমতায় থেকেও তিনি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেননি, পদ্মা সেতুর কথা চিন্তাও করতে পারেননি– বরং তাঁর সরকার দেশটা জঙ্গি উৎপাদনের কারখানা বানিয়েছিল। তাঁর শাসনামলেই জঙ্গিবাদ বিকশিত হয়। শুধু তা-ই নয়, ২১ আগস্টের গণহত্যা ও জজ মিয়া নাটক মঞ্চায়ন করে, হামলার সঙ্গে যুক্ত জঙ্গিদের না ধরে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের শেকড় গাড়ার সুযোগ দেবার জন্য মূলত জামায়াত ও বিএনপি দায়ী। কিন্তু তা বলে আওয়ামী লীগ দায়ী নয় তা বলা যাবে না। তাদের উদাসীনতা এবং ধীর প্রতিক্রিয়া ও প্রস্তুতির জন্য তাদের দায় নিতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে জব্দ করতে ও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে চিহ্নিত জঙ্গি ও রাজাকারের সঙ্গে আওয়ামী নেতাদের আপোষ-রফারও নজির আছে। তবুও সব কিছু এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি ১৬ কোটি মানুষ একসঙ্গে ৩২ কোটি হাত নিয়ে এগিয়ে এলে এসব ভ্রান্ত মতাদর্শ লালনকারী খুনীদের শায়েস্তা করা অসমম্ভব নয়।
বর্তমান সরকারের খুঁতের অভাব নেই, এ কথা সত্য৷ তবে তাদের জঙ্গিপ্রেম, রাজাকারপ্রেম আছে– এ অপবাদ কেউ দিতে পারবে না। দেশের মানুষও এখন জঙ্গি-রাজাকারদের বিরুদ্ধে একাট্টা। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বেগম খালেদা জিয়া যদি রাজাকার ও জঙ্গিদের জন্য মায়াকান্না অব্যাহত রাখেন, তাহলে জনগণের কাছ থেকে তাঁর একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মনে রাখা দরকার যে, বিরোধী দল হিসেবে চরম ব্যর্থতাই আজ ক্ষমতাসীনদের অনেক ক্ষেত্রে বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। গত এক দশকে জাতীয় জীবনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেই খালেদা জিয়ার বিএনপি উপযুক্ত গণমুখী ভূমিকা পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এটাও জনগণের জীবনে নেমে আসা দুর্ভোগের অন্যতম প্রধান কারণ।
বিএনপির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ থেকে বিচ্যুতি। বাংলাদেশের মানুষ এমন বিরোধী দলের প্রতি সমর্থন যোগাবে বলে মনে হয় না। বিরোধী দলকে হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিষ্ঠাশীল, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বিএনপি যে তা নয় সেটা দলটির নেতানেত্রীদের কথায় ও কাজে প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে।
অথচ এই বিএনপিই তো সরকারের বিকল্প। মানুষ সরকারের প্রতি বিরূপ হলে তার বিকল্প হিসেবে বিএনপিকেই ভোট দেবে। এখন দল যদি তৈরি না হয়, নেতানেত্রীরা যদি যোগ্য হয়ে ওঠার তাগিদ বোধ না করেন, তাহলে মানুষ বিকল্প কাকে ভাববে? কাকে ভোট দেওয়ার জন্য নির্বাচন দাবি করবে? শুধু দলবদলের জন্য নিশ্চয়ই মানুষ ভোট চায় না!
বিএনপি নেতৃত্বকে ভেবে দেখতে হবে যে, তারা আওয়ামী লীগের বিকল্প হতে চায়, ক্ষমতায় যেতে চায় কি না। নাকি এভাবে উল্টাপাল্টা কথা বলে, জঙ্গি ও রাজাকারপ্রীতি অব্যাহত রেখে ক্রমেই বিলুপ্ত হতে চায়! এমনিতেই বিএনপি এখন আর মানুষের মনে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশেষ করে গ্রামেগঞ্জে।
প্রতিটি জনপদেই এখনও টেইলারিং শপ আছে। গম ভাঙানোর একটি দোকান আছে। লন্ড্রি পাওয়া যায়। কবিরাজ বসেন এরকম ছোট ক্লিনিক দেখা যায়। পুরানো জামাকাপড় নিয়ে নতুন বাসন দেবে এরকম ফেরিওয়ালারা সংখ্যায় কম হলেও ব্যবসা চালাচ্ছে। পায়ে মোচড় লেগে ফুলে গেলে ঝাঁড়ফুক করে সারিয়ে দেবে এরকম সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। সেলাই শিক্ষার স্কুল এখনও উঠে যায়নি। টেপ রেকর্ডার সারানোর দোকান গ্রাম-গঞ্জে এখনও দেখা যায়। সবই আছে। আজও। শুধু একটু খুঁজে নিতে হয়।
এসব ক্ষেত্রে আমরা স্থানীয় কাউকে জিজ্ঞেস করি 'ভাই, ওই দোকানটা কোথায় পাওয়া যাবে জানেন'– কেউ-না-কেউ ঠিক বলে দেয়। এই ধারায় চলতে থাকলে আগামী দিনে বিএনপিও অনেকটা এরকম দল হয়ে উঠবে। থাকবে। শুধু একটু খুঁজে নিতে হবে। কারণ এরকম অনর্গল বুক ফুলিয়ে ভুল করে যাওয়া দলটিকে সিরিয়াসলি নেওয়ার অর্থ হয় না। তা কেউ নেয়ও না আজকাল। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম।
বিকল্প আইডিয়া না দিয়ে, উদ্ভাবনী শক্তি না দেখিয়ে, আত্মশুদ্ধির চেষ্টা না করে শুধু আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে, দলের সমর্থন বাড়ানো যাবে বলে মনে হয় না।