Published : 01 Oct 2011, 10:20 PM
আজকে কোনো সংখ্যা দিয়ে, তথ্য দিয়ে, বা যুক্তি দিয়ে কিছু বলার তাগিদ অনুভব করছি না | আজকে অধিকার থেকে কিছু বলার তাগিদ অনুভব করছি | আজকে যখন লিখছি তখন শাহবাগ থানায় জীবনে প্রথমবারের মত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু ছাত্র জেলখানার বারান্দায় রাত কাটিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে পরবর্তী ভোগান্তির সামনে দাড়ানোর | ভোগান্তি ছাড়া এখন কি আছে তাদের? যেই সমাজ ব্যবস্থায় বড় হয়েছে এই ছাত্ররা সেই সমাজ তাদের শিখিয়েছে পড়ালেখা করতে হবে, নাহলে কর্মসংস্থান নাই | আর পড়ালেখা করতে হলে এখন টাকা লাগবে, নাহলে পড়ালেখা হবে না | কারণ আর সব ভোগ্য পণ্যের মতই শিক্ষা এখন একটি পণ্য | যে শিক্ষা কিনতে পারবে শুধু সেই এখন পড়তে পারবে | এর বাইরে কেউ কিছু চাইলে তাকে যেতে হবে জেলখানায় |
জন্ম থেকেই শুনে আসছি সরকারের ফান্ডের ক্রাইসিস | টাকা নাই, টাকা নাই, কোথাও টাকা নাই | জনগণও সরকারের দারিদ্রের কথা শুনতে শুনতে সরকারের প্রতি দয়াশীল হয়ে সব কিছু মেনে নিচ্ছে | কিন্তু সবধরনের মানুষকে কিন্তু শুনতে হয় না সরকারের টাকা নাই | বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে কখনোই ফান্ডের ক্রাইসিস থাকে না | বা থাকলেও জনগনের কাছ থেকে আদায় করে সেই ক্রাইসিস মেটাতে হয় | যেমন সামরিক খাতে, যেমন বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে বেশি দামে জালানি কিনতে, যেমন বিমান বন্দরের নাম পরিবর্তন করার মত অনুৎপাদনশীল খাতে, যেমন একটি বিমান বন্দর থাকা সত্তেও আরেকটি বিমান বন্দর তৈরি করতে, যেমন সেনাবাহিনীর জন্য আবাসন প্রকল্প নির্মাণে |
২০০৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর "জাতীয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, আধুনিক জ্ঞানচর্চা ও পঠন-পাঠনের সুযোগ সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ"-এর উদ্দেশ্যে "জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন"-এর মাধ্যমে সরকারি জগন্নাথ কলেজ ক্যাম্পাসে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আশ্বাস প্রদান করা হয় | সেই সময় আর্টিক্যাল ৫ এ "ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জন্মস্থান এবং শ্রেণীর কারণে কাহারও প্রতি কোন বৈষম্য করা যাইবে না" লিখা হলেও ঐ আইনেরই আর্টিক্যাল ২৭(৪) এ বলা হয়: "বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প বাস্তবায়িত হইবার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পৌনঃপুনিক ব্যয় যোগানে সরকার কর্তৃক প্রদেয় অর্থ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাইবে এবং পঞ্চম বত্সর হইতে উক্ত ব্যয়ের শতভাগ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় ও উত্স হইতে বহন করিতে হইবে৷"।
নিম্নবিত্ত ছাত্ররা এই ব্যয় কীভাবে বহন করবে আর কীভাবেই বা এই শিক্ষাব্যাবস্থা কে বৈষম্যহীন বলা যেতে পারে?
জগন্নাথ বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্রদের সবার একি বক্তব্য শিক্ষা তাদের অধিকার, শিক্ষা বানিজ্যিক পন্য নয় | তারা সবাই বর্ধিত বেতনের ভুক্তভোগী | তাদের সবার মুখে একই অভিব্যাক্তি – মিছিল ছাড়া কোথায় দাঁড়াবে তারা ?
পরশু সকালে ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম | সেখানে দেখলাম একটি সাইনবোর্ডে লেখা বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য শিক্ষা ঋণ দেওয়া হয় | মনে পরে গেল লন্ডনে পড়তে যাওয়া এক ছাত্রের কথা। ছেলেটি আমার পাশে বসে লন্ডন থেকে ঢাকা আসছিল। লম্বা পথ তার সাথে গল্প করতে করতে জানতে পারলাম কি ভাবে ঋণ নিয়ে পড়তে যেয়ে বাংলাদেশী ছাত্ররা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে ইংল্যান্ডে। অনেক ছাত্র আছে যারা ঠিক মত ইংরেজি শেখার সুযোগ পায়নি কখনো কিন্তু মাদ্রাসা থেকে পাশ করে ইংল্যান্ডে গেছে সুশিক্ষার আশায়। তারা সেখানে যেয়ে বিনা পয়সায় বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টে কাজ করছে শুধুমাত্র একটু থাকার যায়গা ও খাবার পাওয়ার জন্য। এই সুযোগ তাদের জন্য অনেক বড় একটি সুযোগ। কারন এই সুযোগটুকুও এখন দুর্লভ হয়ে গেছে। ইংল্যান্ডের শ্রমবাজারে এত বেশি ছাত্র বেড়ে গেছে যে এখন এইটুকু সুযোগও কেউ পাচ্ছে না। কিন্তু যদি ধরে নেই যে এই কষ্ট করে আসা ছাত্রটি দেশে এসে খুব ভাল একটা চাকরী পাবে তাহলে সমস্যা ছিল না। এই মানের একটি ছাত্র শেষ পর্যন্ত এসে তার বহু আকাংক্ষিত চাকরিটি পাচ্ছে কি? যেই আশা আকাঙ্খা নিয়ে সে অজানা পথ পাড়ি দেয় তার বেশিরভাগ তার ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। তাহলে কিসের জন্য এত কষ্ট। কে তাদের এই স্বপ্ন দেখায়?
গতকাল এক অবসরে টেলিভিশন দেখার সুযোগ হয়েছিল। খবরে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার্থীদের মায়েদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। সেখানে বেশিরভাগ মায়েরা উদ্বিগ্ন হয়ে একটা কথাই বার বার বলছেন যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুযোগ না পেলে কীভাবে তারা তাদের ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ দেবেন। শঙ্কিত মায়েদের কথা শুনে মনে পরে গেল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মুখ। একটু আগে দেখে এসেছি পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার হতে যেই ছাত্রদের তাদের মায়েদের মুখগুলি দেখতে এখন কেমন?
পুজার ছুটি শুরু হচ্ছে সামনেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদের নানান প্রস্তুতি চলছে। শুক্রবার রাত ১১ টায় যখন শাহবাগ থানার পাশ দিয়ে যাচ্ছি তখন দেখি ছোট ছোট জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন বয়সী যুবক। জানতে পারলাম অনলাইন ব্লগার কমিউনিটি বিকাল থেকে সমাবেশ করছে, এবং রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সব ধরনের, সব বয়সের, সব পেশার মানুষ সারাদিন ধরে জমায়েত হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের পাশে দাঁড়িয়েছে সব ধরনের মানুষ। কোন না কোন ভাবে আমাদের দেশের মানুষ নিরাপত্তাহীনতা বোধ থেকে একত্রিত হচ্ছে এবং এই ধরনের সমস্যাগুলো তাদের ভাবিয়ে তুলেছে।
শিক্ষা বানিজ্যিকিকরনের দুর্ভোগ অনুভব করতে শুরু করেছে সর্বস্তরের মানুষ। সরকারের এক লক্ষ্য যুক্তি থাকতে পারে শিক্ষা ব্যাবস্থা বানিজ্যিকিকরনের পিছনে। বেতন বাড়ানোর পিছনে আজকে সহস্র কারন দেখাতে পারে বিশ্ব ব্যাঙ্ক। এই সরকারের সময়ে শুধু নয়, কোন সরকারের সময়েই বানিজ্যিকিকরনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে দেখা যায়নি কোন সরকারকে। কোন সরকারের কোন যুক্তি, পৃথিবীর কোন দাতা সংস্থার কোন পরামর্শই টিকে থাকতে পারে না দেশের ছাত্রদের ভোগান্তির কাছে।
প্রতিটি শিশু জন্মগ্রহন করে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট ও বৈচিত্র নিয়ে। সামর্থ্য থাকা না থাকা শিক্ষা অর্জনের পূর্বশর্ত হতে পারে না। সব ধরনের লাভ, ক্ষতি, যুক্তি, তর্ক ভেদ করে বিকশিত হয় মানব সত্তা। আর শিক্ষা বানিজ্যিকিকরনের মাধ্যমে মানুষের স্বাভাবিক বিকাশের পথে অন্তরায় তৈরি করে, স্বাভাবিক বৈচিত্র্য নষ্ট করে যেই সভ্যতা সেই সভ্যতা শুধু দাস তৈরি করতে পারে। আর কিছু পারে না। আজকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা সর্বস্তরের মানুষ বুঝতে পারছে তাদের অন্তহীন দাসত্ব কীভাবে তাদের অক্ষম করে দিচ্ছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আজকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এর মানে এই নয় যে তাদের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে গেছে। এর মানে এই নয় যে তাদের দাবী মেনে নেওয়া হয়েছে । শিক্ষা বানিজ্যিকিকরন সম্পর্কিত সব আইন যতদিন বাতিল না হবে ততদিন আজকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলন শুরু হলে, কালকে শুরু হবে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। শুধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সকল ধর্মের, সকল শ্রেণীর ছাত্রদের পাশে দাড়িয়ে এই দেশের মানুষ জানান দিতে চায় যে জনগন এই শিক্ষা বানিজ্যিকিকরন চায় না। মানুষ এই অন্তহীন ভোগান্তি চায় না। মানুষ তার নিজস্ব বিকাশের পথে কোন বাধা দেখতে চায় না। মানুষ সংঘবদ্ধ হতে চায়। মিছিলে ছাড়া কোথায় দাঁড়াবে তারা?