Published : 10 Feb 2016, 01:58 PM
'শ্যাল' শব্দটি যে আমলযোগ্য বাধ্যবাধকতা দেয় এর পরিবর্তে 'শুড' শব্দটি ব্যবহার করলে তা অনেকটাই 'ইচ্ছামূলক' হয়ে যায়। 'শ্যাল' বা 'শুড' শব্দদ্বয়ের এই বিভাজনেই বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তিটি প্রায় আটকে গিয়েছিল। চুক্তি চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে আমেরিকা চৌকস সব আইনজীবী পাঠিয়েছিল। এর ঠিক আগে ৪ নং আর্টিকেল নিয়ে তারা আপত্তি তোলে। সেখানে বলা হয়েছে, 'গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনতে ধনী দেশগুলো তাদের সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করবে।' এতে 'শ্যাল' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল।
এর আগের চুক্তিতে বলা হয়েছিল, 'গ্রিন হাউস গ্যাস কমিয়ে আনতে সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা উচিত ধনী দেশগুলোর।' সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল 'শুড' শব্দটি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি তার দেশের (আদতে অন্যান্য ধনী দেশগুলোর) পক্ষে ওকালতি করে বলেন, '৪ নং আর্টিকেলের পরিবর্তন না হলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে চুক্তিটি সমর্থন করা সম্ভব নয়।'
তাদের খুশি করতে 'শ্যাল' শব্দটির বদলে এল 'শুড'। শব্দের ধাঁধা, শব্দের বাধা ধার কমিয়ে দিয়েছে প্যারিস চুক্তির।
বুলেটিন অব ম্যাথমেটিকস বায়োলজি নামের সাময়িকীতে সম্প্রতি প্রকাশিত নিবন্ধে জানা গেল, তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বাড়লে বিশ্বে অক্সিজেনের পরিমাণ অনেকটা কমে যাবে। এর প্রভাবে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণি ব্যাপকভাবে মারা যেতে পারে। যুক্তরাজ্যের লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে এমনটা দাবি করা হয়েছে। আরও বলা হচ্ছে যে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেনের স্বল্পতা মানুষের বেঁচে থাকার বেলায় বড় হুমকি হয়ে উঠবে। মহাসাগরগুলোর পানির তাপমাত্রা প্রায় ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। ২১০০ সাল নাগাদ এ অবস্থা হতে পারে বলে কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন। এর প্রভাবে সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়ে ছোট উদ্ভিদ থেকে অক্সিজেন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যাবে।
গবেষণায় অধ্যাপক সারগেই পেত্রোভস্কি বলেন, বৈজ্ঞানিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বৈশ্বিক উষ্ণতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে গত দুদশক ধরে। অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে বিশ্বের বেশিরভাগ এলাকা চলে যাবে পানির নিচে। তবে নতুন গবেষণা বলছে, এটি মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি নয়। তার চেয়ে বড় হুমকি অক্সিজেনের ঘাটতি। অক্সিজেনের দুই-তৃতীয়াংশ যোগানদাতা সামুদ্রিক অণুজীব উদ্ভিদ বিনষ্ট হলে বিশ্বে অক্সিজেনের মাত্রা ব্যাপকভাবে কমে যাবে। এতে মারা পড়বে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণি। বিপদাপন্ন হবে সভ্যতা।
ব্রাজিলের রিও শহরে ১৯৯২ সালে প্রথম অধিবেশনে বসে পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্র্। সে সময়কার হিসাব বলে, পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিকারী গ্যাস মূলত নির্গত হত উন্নত দেশগুলির কর্মকাণ্ডে। মাথাপিছু কার্বন ডাই-অক্সাইড বিবেচনায় নিলে এ ক্ষেত্রে চীন ও ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভূমিকা বিশেষ ছিল না তখন।
ওই অধিবেশনে এটি স্বীকৃত হয় যে, পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি কমানোর দায়িত্ব সকল দেশের হলেও, উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলোর দায়িত্ব সমান নয়। বরং এতে সিংহভাগ দায়িত্বই উন্নত দেশগুলোর। ভারতীয় পরিবেশবিদ অনিল অগ্রবাল ও সুনীতা নারায়ণ ১৯৯১ সালে একটি গবেষণাপত্রে এই নীতির কথা তুলে ধরেন। তাদের প্রণীত নীতি রিও শহরের সেই অধিবেশনে গৃহীত হয়।
১৯৯৭ সালের কিয়োটো পরিবেশ সম্মেলনেও নীতিটি বহাল থাকে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা রাজি না হওয়ায় এটি তখন গ্রহণ করা যায়নি। যদিও আমেরিকার প্রতিনিধি স্বীকার করেন যে, উন্নত দেশগুলি জলবায়ু পরিবর্তন করে এমন গ্যাস ছড়িয়েছে, কিন্তু এর প্রতিবিধান করতে কোনো অপনোদনকারী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি, যাতে চীন ও ভারতের বিশেষ ভূমিকা পাশ কাটিয়ে যাওয়া না হয়। আমেরিকাকে চীন ও ভারতের সঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দি করার ওজরে নিজেদের দায়মুক্তি আদায় করে নেয় ওরা। বিশ্লেষকরা ধারণা করেছিলেন, উন্নতির রোডম্যাপে এই দেশ দুটি এক সময় 'দূষণকারী' দেশ হিসেবেই গণ্য হবে। এখন হয়েছেও তাই।
পৃথিবীর গড় উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে রাখাই শ্রেয় ও সকলের কর্তব্য বলে রিওএর অধিবেশনে উপস্থিত প্রতিনিধিরা স্থির করেন। ১৯৯৭ সালে যে ১৯৩টি দেশ 'কিয়োটো প্রোটোকল' সই করে, তারাও লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে এই '২ ডিগ্রি' গ্রহণ করে। কিন্তু শুরু থেকেই একটি বিষয়ে মতানৈক্য থেকে যায়। আর তা হল, লক্ষ্যে পৌঁছুতে কার দায়িত্ব কতটা।
ভারতের বক্তব্য, দায়িত্বের সিংহভাগ ঐতিহাসিক কারণেই উন্নত দেশগুলির। সদ্য শেষ হওয়া সম্মেলনের চুক্তিতে বাধ্যবাধকতা না থাকায় হাঁপ ছেড়ে এক টুইট বার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, 'প্যারিস চুক্তির বিজয়ী বা পরাজিত পক্ষ বলে কেউ নেই। এখানে জলবায়ুর ন্যায়বিচারের জয় হয়েছে। আমরা অধিকতর সবুজ ভবিষ্যতের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।'
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই মতে সায় দিলেও আমেরিকা নারাজ। প্যারিস চুক্তিটিতে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জাতিগুলোর অধিকার উপেক্ষিত হয়েছে চরমভাবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ ও বাসযোগ্য জলবায়ু নিশ্চিত করার প্রায় কোনো বাধ্যবাধকতাই রাখা হয়নি। ভয়ানক বিষয় এটাই যে, এর পরও একে একটি 'সাফল্য' হিসেবে জাহির করা হচ্ছে।
কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা এবং নিয়মিত অগ্রগতি পর্যালোচনার বিষয়ে দেশগুলো নিজেরা বাধ্যবাধকতা আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে প্রতিশ্রুতি পূরণে দেশগুলোর ওপর কোনো রকম আইনি বাধ্যবাধকতা প্যারিস চুক্তিতে রাখা হয়নি। চুক্তিটির গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো হল:
এক. বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা;
দুই. গাছ, মাটি ও সমুদ্র প্রাকৃতিকভাবে যতটা শোষণ করতে পারে, ২০৫০ থেকে ২১০০ সালের মধ্যে কৃত্রিমভাবে গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ সেই পর্যায়ে নামিয়ে আনা;
তিন. প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণ রোধে প্রতিটি দেশের ভূমিকা পর্যালোচনা করা;
চার. জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করতে গরিব দেশগুলোকে ধনী দেশগুলোর 'জলবায়ু তহবিল' দিয়ে সাহায্য করা। এর আওতায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ২০২০ সালের মধ্যে 'জলবায়ু সুরক্ষা খাতে' বছরে ন্যূনতম ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার অনুদান দিতে হবে। প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণে কাজ এগুলে ২০২৫ সালে আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হবে। মোটা দাগে এগুলিই প্যারিস চুক্তির প্রধান দিক।
খসড়ায় কার্বন নিঃসরণকারী শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলার যে বিধান ছিল, চূড়ান্ত প্যারিস চুক্তি থেকে তা তুলে দেওয়া হয়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রির বেশি বাড়তে না দেওয়াসহ চুক্তিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি বা লস অ্যান্ড ড্যামেজের বিষয়টি যেন যুক্ত করা হয়, এই দাবি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার করা হয়েছে। তবে সবুজ জলবায়ু তহবিল থেকে সরাসরি অর্থ চাওয়াসহ বাংলাদেশের বেশ কিছু দাবি খসড়া চুক্তিতে যোগ করা হয়নি।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি বা লস অ্যান্ড ড্যামেজ বিষয়টি চুক্তিতে যোগ করা হলেও, কার্বন নিঃসরণকারী রাষ্ট্রের বিরুুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করার বিষয়টি ছিল। তবে আমাদের মতো চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর প্রত্যাশা পায়ে দলে ওই শর্ত উঠিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য বীমা করতে পারে এবং বীমা কোম্পানিগুলো প্রমাণ সাপেক্ষে ওই ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধ করবে। এ বিধান রাখার মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণকারী রাষ্ট্রগুলো তাদের দায় এড়ানোর সুযোগ পেল।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় তারা কী ধরনের অবদান রাখতে চায় তার বিবরণ দিয়ে প্যারিস সম্মেলনের আগে ইউএনএফসিসিসির উন্নত ও অনুন্নত সব সদস্য দেশ 'ইন্টেন্ডেড ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন' বা আইএনডিসি প্রণয়ন ও জমা দিয়েছিল। সদস্য দেশগুলো নিজ থেকেই প্রকাশ্য ঘোষণা সংবলিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এই স্ব-নির্ধারণী নিঃসরণ মাত্রা বাংলাদেশও জমা দিয়েছে। যদিও গ্রিন হাউস গ্যাস উদগীরণ কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা খুবই নগণ্য।
আইএনডিসিতে বলেছে, জ্বালানি, পরিবহন ও শিল্প তিনটি খাতে প্রচলিত অবস্থা থেকে ২০৩০ সাল নাগাদ ৫ শতাংশ গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো হবে। আর যথাযথ আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পেলে কোনো মতেই উন্নয়নশীল দেশের গড় মাত্রার বেশি গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ করবে না।
কপ ২১এ অংশগ্রহণকারীরা এক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করতে সম্মত হয়ে একদিকে অর্জনের গরিমায় আপ্লুত হচ্ছে, অন্যদিকে রাস্তায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতির শিকারদের প্রতিবাদ এটা বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের রাশ টানতে হলে আরও অনেক কিছু করতে হবে।
ফোকাস অন দ্য গ্লোবাল সাউথ নামক একটি সংগঠনের কর্মী ও ফিলিপাইন থেকে আসা জোসেফ পুরুগানান বলেন, ''কপ ২১ আমাদের পছন্দ হয়নি। আমরা এই খবর দিতে এসেছি যে, আসল সমাধান জনগণের তরফ থেকেই আসবে। কপের বয়স তো বিশ বছর হল, কিন্তু দেখুন, আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি।''
শেষেও সেই শব্দের ধাঁধা– আন্তর্জাতিকভাবে সর্বোচ্চ বাধ্যবাধকতামূলক চুক্তি হচ্ছে প্র্রটোকল। প্যারিসে প্রটোকল নয়, স্বাক্ষরিত হয়েছে 'এগ্রিমেন্ট' যেটি পাঁচ বছর পরপর পর্যালোচিত হবে শর্তসহ। জলবায়ু চুক্তিটি হবে ১৫ বছর মেয়াদী। এতে বলা হয়েছে যে, যে কোনো দেশ অনুসমর্থন বা রেটিফিকেশনের তিন বছর পর চাইলে চুক্তি থেকে বের হয়ে যেতে পারবে। এই ধারা উন্নত দেশের জন্য অ্যাসকেপ রুট, যদিও বাংলাদেশ চেয়েছিল চুক্তি থেকে বের হয়ে যেতে বরং কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। কিছু না হওয়ার চাইতে কিছু হওয়ার সান্তনা নিয়েই থাকতে হচ্ছে আপাতত।