Published : 31 May 2011, 08:10 PM
সমাজে পুঁজিপতিদের অবস্থানের সাথে বৈদ্যুতিক গ্রিডের কী সম্পর্ক?
আসুন আমার ব্যক্তিগত কথা দিয়ে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। ২০০৩ সালের আগস্ট মাসে গরমের দিনের কোনো এক বিকেলবেলা। আমি তখন ক্যানাডার অন্টারিও প্রদেশের একটি মাঝারিমাপের শহর হ্যামিল্টনে বাস করি এবং ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির একজন পিএইচডি ছাত্র। সেই বছর জুলাই মাসের দিকে সদ্যকেনা নতুন ঝকঝকে মলিকুলার-বিম-এপিট্যাক্সি (এম.বি.ই) মেশিনটি আমাদের ল্যাবে এসেছে। আমার কাজ হবে ঐ মেশিনটি ব্যবহার করে কিছু ইন্টারেস্টিং অর্ধপরিবাহী স্তর তৈরি করা যা দিয়ে একটা মজার অপ্টোইলেক্ট্রনিক ডিভাইস তৈরি করা। সারাদিন ল্যাবে খুব হুড়োহুড়ি– এই কনেকশন দিচ্ছি, ঐ কনেকশন দিচ্ছি, বিদ্যুৎ সংযোগের ইন্সপেক্টর এসে সব দেখে গেল সবকিছু ঠিক-ঠাক আছে কি-না। যাদের জানা নেই তাদের জন্য বলি, মলিকুলার-বিম-এপিট্যাক্সি মেশিন এমন এক মেশিন যা দিয়ে আর্শ্চয সূক্ষ্মতায় খুব মিহি সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী পদার্থের স্তর তৈরি করা যায়। এর জন্য অত্যন্ত উচ্চমাত্রার ভ্যাকুয়াম সৃষ্টি করতে হয়। পৃথিবীতে সার্নের কণা-ত্বরক যন্ত্র ছাড়া আর কোথাও এতো উচ্চমাত্রার শূন্যস্থান সৃষ্টি করা হয় না। স্বাভাবিক বায়ুচাপের দশ বিলিয়ন ভাগের একভাগ চাপ-বিশিষ্ট ভ্যাকুয়াম তৈরি করা হয় এম.বি.ই মেশিনে।
মেশিনটিকে যদি কোনো কারণে খোলা হয়, তবে পাম্প করে এর ভেতরের সব বাতাস বের করে ভ্যাকুয়ামে নিতে প্রায় এক হপ্তা সময় লাগে। আমার মনে আছে, সেদিন ছিল ১৪ই আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর হত্যাদিবস। বিকাল সোয়া-চারটার দিকে হঠাৎ আমাদের বিদ্যুৎ চলে যায়। খুবই অবাক ঘটনা, কারণ ক্যানাডায় আমি কোনোদিন বিদ্যুৎ যেতে দেখিনি। কাজ থেকে আকস্মিক ছুটি মেলায় আমি ল্যাবের পাশের একটুকরো খোলা জমিতে ঘাসের ওপর গিয়ে বসি, সাথে পশ্চিম বঙ্গের তিন বঙ্গসন্তান– কোলকাতার কল্যাণ ভট্টাচার্যি (আমার 'গুরু', একই ল্যাবের সহকর্মী), এক উড়িয়া-দাদা এবং প্রিন্সটন থেকে পোস্ট-ডক করতে আসা আরেক দাদা (নামটা ভুলে গেছি)। মনে আছে, সেদিন আমরা ভারতীয় জনতা পার্টি নিয়ে বঙ্গদেশীয় আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম। পনেরো মিনিটের মাথায় খরব এলো আরো বেশ কয়েকটি শহরসহ টরন্টোতেও বিদ্যুৎ চলে গেছে।
পশ্চিমের দেশে বিদ্যুৎ চলে যাওয়া মানে সর্বনাশা কথা। বাড়িতে চুলো জ্বলবে না, রান্নার অপরিহার্য মাইক্রোওয়েভ অচল, গগনস্পর্শী বিল্ডিংগুলোর এলিভেটর অচল, ট্রাফিক বাতি বন্ধ, রাস্তায় তুমুল জ্যাম, মেট্রোরেল বন্ধ, অতএব ঘরমুখো মানুষের নিরন্তর হন্টন। সেই রাতে বাড়ি ফিরে মোমবাতি জ্বালিয়ে শুকনো পাউরুটি ও কলা ভক্ষণ করে ডিনার সারতে হয়েছিল। বাড়ির সামনে আমরা বিরাট আড্ডায় মেতে উঠলাম, আমার হাউজমেট ছিল ঢা.বি'র রতন। আশপাশের শ্বেতাঙ্গিনী পড়শিদের ম্যাচ চাইতে বাড়ি আসা, যা কখনোই হয় না। তখন মনে হয়েছিল এই বুঝি কোনো রসায়ন জন্মাবে; কিন্তু না, কিছুই কখনো হয়নি, হয়না। যা-হোক আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ এসেছিল রাত বারোটায়। ততক্ষণে আমরা জেনে গেছিলাম ভয়াবহ বিদ্যুৎ-বিপর্যয়ের কথা। রেডিওতে শুনছিলাম নিউইয়র্কের অন্ধকার রাস্তার কথা।
বাংলাদেশে জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় দেখা দিলেও পশ্চিমা বিশ্বে তা কদাচিৎ ঘটে। আমাদের দেশে গ্রিড বিপর্যয় বিরল না হলেও, সেসবের বিশ্লেষণ কখনো চোখে পড়েনি। পত্রিকায় খবর বেরোয় অমুক-তমুকের চাকরি গেছে, ব্যাস। কিন্তু ২০০৩ সালের ১৪ই আগস্টেও বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনাবলির পঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ হয়েছে। দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ওহায়ো অঙ্গরাজ্যে সংঘটিত অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটনার সময়োগযোগী সংশোধন না হওয়ায় একটা বিশাল অঞ্চলব্যাপী বিদ্যুৎ-ব্যবস্থার অকস্মাৎ পতন ঘটে। নর্থ অ্যামেরিকান ইলেক্ট্রিক রিলায়েবিলিট কাউন্সিল (এন.ই.আর.সি) এই ঘটনার প্রতিটি মিনিটের বিশ্লেষণ করেছে। দেখা গেছে, ঐ দিন ছিল অস্বাভাবিক গরম। ফলে প্রতিটি ঘর, অফিস, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানসহ সমস্ত জায়গায় প্রচুর এসি চলছিল। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের ওহায়ো-পেনসিলভানিয়া-নিউ জার্সি অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বিতরণ প্রতিষ্ঠান ফার্স্টএনার্জি কর্পোরেশনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থতাও এই ঘটনার জন্য দায়ী। ফার্স্টএনার্জির অন্তর্ভুক্ত বৈদ্যুতিক সিস্টেমের ক্ষমতা ছিল এগারো হাজার পাঁচশো কিলোমিটার সঞ্চালন বা ট্রান্সমিশন লাইন এবং তা ছত্রিশ হাজার বর্গকিলোমিটার অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত। ঐ সিজনে এই বিশাল অঞ্চলে কোম্পানিটি যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করেনি, বিশেষ করে উঁচু বৃক্ষাদির ডালপালা নিয়মিত কাটা হয়নি। সঞ্চালন লাইনে বেশি কারেন্ট গেলে তাদের তাপীয় প্রসারণ ঘটে, ফলে ঝোলা-তারের ঝুল বা স্যাগ বেড়ে যায়। এই পর্যায়ে এইসব তার যদি উঁচু গাছের ডালপালা স্পর্শ করে তাহলে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তখন ঐ সঞ্চালন লাইনগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায় বা 'ট্রিপ' করে। তাই গ্রীষ্ম মৌসুমে সঞ্চালন লাইনের ঠিক নিচে থাকা উঁচু গাছপালা নিয়মিত কাটা দরকার। আমাদের দেশের বিতরণ বা ডিস্ট্রিবিউশন লাইনেও একই ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ চলে। কিন্তু ২০০৩ সালে ফার্স্টএনার্জি কর্পোরেশন তাদের এই কাজটি ঠিকমতো করেনি। তাছাড়া মনিটরিং যন্ত্রাদির ত্রুটির কারণে সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের অপারেটররা ছিল সম্পূর্ণ অন্ধকারে। এছাড়া আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় রিলায়েবিলিটি অপারেটরদের (যারা পুরো সিস্টেমের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পুরো সিস্টেমকে চালু রাখে) মধ্যে সমঝোতার অভাব, সময়মত যোগাযোগের অপ্রতুলতা, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে অনিশ্চয়তা ও অপারগতা ইত্যাদিও দায়ী। বিশেষ করে, ওহায়ো অঞ্চলে সৃষ্ট অনাকাঙ্খিত ঘটনাবলিকে সময়মতো সংশোধন না করাতেই এক বিশাল অঞ্চলে বিদ্যুৎ চলে যায়। এনইআরসি'র রিপোর্ট মোতাবেক "ওহায়ো, মিশিগান, নিউ ইয়র্ক, পেনসিলভানিয়া, নিউ জার্সি, কানেকটিকাট, ম্যাসাচুসেট্স, ভেরমন এবং ক্যানাডায় অন্টারিও ও কোবেক প্রদেশসমূহের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ এই ব্ল্যাক-আউট দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।" ১৪ই আগস্ট ২০০৩ বিকাল সোয়া চারটা নাগাদ এই ঘটনাটি ঘটে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঐ দিন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জেনারেটর পূর্বপরিকল্পনা মাফিক বন্ধ ছিল। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিদ্যুৎ-উৎপাদন কেন্দ্র কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখতে হয়। তখন নানা মেরামতের কাজ চলে। ঐ দিন কয়েকটি জেনারেটর তাই পরিকল্পনামাফিক বন্ধ ছিল। কিন্তু ঐ দিন খুব গরম পড়ায় (৭৯ থেকে ১০০ ফারেনহাইট) সিস্টেমের উপর অত্যধিক চাপ পড়ে। দুপুর প্রায় সোয়া-একটা থেকেই এই চাপ অসহনীয় হয়ে ওঠে। তাই সেইসময় থেকেই ফার্স্টএনার্জির অপারেটররা বিভিন্ন বিদ্যুৎ-উৎপাদন কেন্দ্রকে উৎপাদন বাড়াতে অনুরোধ জানায়। এদের মধ্যে লেক এরি'র ধার ঘেষে পশ্চিম ক্লিভল্যান্ডের ইস্টলেক ইউনিট-৫ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি একটি উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এর ক্ষমতা ৫৯৭ মেগাওয়াট। ঐ দিন দুপুর ১টা ১৬ মিনিটে ফার্স্টএনার্জির অপারেটর ও ইস্টলেক-৫ ইউনিটের পরিচালকের মধ্যে নিম্নোক্ত কথা-বার্তা হয়।
"ফার্স্টএনার্জি: হেই, তুমি কি আমার ৩৪৫ (কিলো)ভোল্টেজে একটু সাহায্য দেবে?
ইস্টলেক-৫: দোস্ত, দাঁড়াও, আমি তোমাকে আমার সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিচ্ছি। এতে অবশ্য তোমার দিকে সামান্যই লাভ হবে।
ফার্স্টএনার্জি: ওতেই হবে।"
উৎপাদন সামান্য বাড়াতে গিয়ে ঐ জেনারেটরটির কারিগরী সমস্যা (এক্সসাইটেশন ফেইলিয়র) দেখা দেয় এবং ইউনিটটি বন্ধ করে দিতে হয়। এতে করে ৬১২ মেগাওয়াট ও ৪০০ মেগাভার পরিমাণ শক্তি সিস্টেম থেকে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ৩১৪ কিলোভোল্ট সঞ্চালন লাইনে ভোল্টেজের ঘাটতি মেটাতে বাইরে থেকে ফার্স্টএনার্জি পাওয়ার আনতে বাধ্য হয়। ফলে একাধিক লাইন ওভারলোড হয়ে যায়। ঠিক এই ঘটনাটি যদিও ব্ল্যাক-আউটের মূল কারণ নয়, কিন্তু এটা না ঘটলে হয়ত ব্ল্যাক-আউটটি এড়ানো যেত। আরো কিছু ঘটনা এরপর ঘটে। সেইসব এমার্জেন্সি ঘটনা সামাল দেবার মতো যথেষ্ট স্বাধীনতা ও ক্ষমতা অপারেটরদের ছিলো না।
দুপুর ২টা ১৪ মিনিটের পর ফার্স্টএনার্জি অপারেটরদের অ্যালার্ম সিস্টেম নষ্ট হয়ে য়ায়। ফলে বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে কোনো ধারণাই ঐ কোম্পানির অপারেটররা পাচ্ছিল না। কাজেই দুপুর ২টা ২৭ মিনিটে যখন একটি ৩৪৫-কিলোভোল্ট লাইন একবার বন্ধ হয়ে পুনরায় চালু হয়ে গেলো সেটা তারা জানতেও পারেনি। কিন্তু আঞ্চলিক রেগুলেটররা সেটা দেখতে পেলেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। দুপুর ৩টা ৫ মিনিট থেকে ৩টা ৪২ মিনিটের মধ্যে ক্লিভল্যান্ড-অ্যাক্রন অঞ্চলের তিনটি ৩৪৫-কেভি সঞ্চালন লাইন ট্রিপ করে। অতিরিক্ত গরমে প্রচুর কারেন্ট বহন করায় এই লাইনের তারগুলোর প্রসারণ হয়। ফলে তারের ঝুল বেড়ে গিয়ে নিচের গাছপালা ও অন্যান্য বিতরণ লাইনের সংস্পর্শে এসে এগুলো বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এই সমস্যাগুলো ফার্স্টএনার্জির অপারেটররা টেরই পায়নি। ওহায়োর উত্তরাঞ্চলে আরো দুটো ৩৪৫-কেভি লাইন গাছের সংস্পর্শে এসে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে বিদ্যুৎ শক্তি (পাওয়ার-ফ্লো) নিম্ন ভোল্টেজের ১৩৮-কেভি সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে প্রবাহিত হতে থাকে। কিন্তু এই লাইনগুলো চটজলদি ওভারলোডেড হয়ে যায়। তাই ৩টা ৩৯ মিনিট থেকে ৪টা ০৯ মিনিট– এই ত্রিশ মিনিটে ষোলটি ১৩৮-কেভি লাইন একের-পর-এক বন্ধ হয়ে যায়। এদের ক্ষমতার অনেক বেশি শক্তি এরা সরবরাহ করছিল। স্বাভাবিক কারণেই একটি উচ্চক্ষমতার লাইন বন্ধ হয়ে গেলে তার সমান্তরাল অন্যান্য লাইনগুলি বিদ্যুৎ বহন করতে থাকে। ফলে তারা প্রত্যেকেই বহন-ক্ষমতার অধিক কারেন্ট বহন করতে থাকে। মনে রাখতে হবে, সেদিন ছিল অত্যধিক গরম। কাজেই তারাও ধারাবাহিকভাবে ট্রিপ করা শুরু করে। এভাবে দুপুর ৪টা ৫মি. ৫৭ সেকেন্ডে একটি গুরুত্বপূর্ণ ৩৪৫-কেভি লাইন (স্যামিস-স্টার লাইন) ওভারলোড হয়ে ট্রিপ করে। এই ঘটনাটি পরবর্তী ক্যাসকেড প্রক্রিয়ার সূচনা করে। উত্তর-পূর্ব ওহায়োর মতো একটি ছোট আঞ্চলিক সঞ্চালন-ব্যবস্থার ত্রুটি কীভাবে একটা বিরাট অঞ্চলের বিদ্যুৎ-ব্যবস্থাকে পুরো ধসিয়ে দিতে সক্ষম সেটা সত্যিই অভাবনীয়! ঐ লাইনটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাছাকাছি কনেক্টেড অন্যান্য লাইন মারাত্মকভাবে ওভারলোড হয়ে যায়। এর ফলে সঞ্চালন লাইনে ভোল্টেজের যে নিয়ন্ত্রণহীন ওঠা-নামা শুরু হয় সেটা প্রথমে পশ্চিম ও উত্তরমুখে প্রবাহিত হতে থাকে এবং এর চলার পথের সকল লাইন একে একে বন্ধ করতে থাকে। তারপর এই আন্দোলনটি পূর্বাভিমুখে অগ্রসর হয়। এভাবে একটা বিশাল বৈদ্যুতিক শক্তি একবার এক দিকে তার পর মুহূর্তে আরেক দিকে প্রবাহিত হয়। ফলশ্রুতিতে চলার প্রতিটি পথে বিদ্যুৎ-বহনকারী লাইনগুলো বন্ধ হতে থাকে। আঞ্চলিক ও প্রাদেশিক বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনগুলি ইন্টারকনেক্টেড থাকায় কোনো এক পথে বাধাপ্রাপ্ত হলে ওই পাওয়ার প্রবাহিত হবার পথ খুঁজতে থাকে। এভাবে কয়েকটি অসিলেশন বা আন্দোলন দিয়ে গ্রিড সংলগ্ন সকল বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী স্টেশনকে একে একে বন্ধ করে দেয়। কারণ জেনারেটরের প্রান্তে ভোল্টেজ ও ফ্রিকোয়েন্সির ওঠা-নামা অনিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে চলে গেলে ক্ষতি এড়াতে এরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেদের বন্ধ করে দেয়।
তাছাড়া কেন্দ্রীয় রেগুলেটিং এজেন্সিগুলোও যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। একটি আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় রেগুলেটিং অপারেটরের কথাবার্তা শুনুন (দুপুর ৩:৩৫ এর পরে)
"আঞ্চলিক: হ্যাঁ, ওটা ওপেন হয়ে গেছে, সাউথ ক্যান্টন স্টার লাইন বন্ধ দেখাচ্ছে …
কেন্দ্রীয়: সাউথ ক্যান্টন-স্টার লাইন বন্ধ । টোরি-ক্লাভারডেলের খবর কী ?
আঞ্চলিক: হায় আল্লাহ, দেখো এতোসব লাইন ওপেন হয়ে যাচ্ছে … উফ, আরো খারাপ হচ্ছে, আরো কয়েকটা লাইন ট্রিপ করল । ইস্ট লিমা ও নিউ লিবার্টি লাইন ট্রিপ করল, দেখ। আমাদের অবস্থা তো খুবই…..
কেন্দ্রীয়: আমাদের দুজনের অবস্থাই শোচনীয়, ভাই শোনেন, কিছু লাগলে আমাকে জানান।
আঞ্চলিক: ওরেব্বাস্, আরেকটা লাইন বন্ধ হলো। কী সংঘাতিক সব ঘটছে দেখি।"
স্যামিস-স্টার লাইন বন্ধ হয়ে যাওয়াই এই ক্যাসকেড ফেইলিয়ারের মূল সূচনা বিন্দু। অর্থাৎ ওহায়োয় (দুপুর ৩টা ৫মি.) একটি লাইন ট্রিপ করায় অন্যান্য সমান্তরাল লাইনগুলোও ওভারলোডেড হয়ে যায়। এর সম্মিলিত প্রভাবে দুপুর ৪টা ৫ মিনিটে একটা গুরুত্বপূর্ণ লাইন ট্রিপ করে। এর ফলশ্রুতিতে সঞ্চালন লাইনগুলোতে যে অনিয়ন্ত্রিত অসিলেশন তৈরি হয় তাতে পরবর্তী সাত মিনিটে ( দুপুর ৪টা ১৩মি নাগাদ) ৫০৮টি জেনারেটর বন্ধ হয়ে যায়। এই ক্যাসকেড প্রক্রিয়াটি রিয়্যাক্টিভ পাওয়ার ঘাটতির কারণে ঘটেনি, ঘটেছে সঞ্চালন লাইনে ভোল্টেজের ঘাটতি এবং ওভারলোডেড থাকার ফলে এবং বেশ কিছু লাইন বন্ধ হওয়ার তাৎক্ষণিক যে ট্রানজিয়েন্ট এফেক্টটির সৃষ্টি হয় তার কারণে। এমনকি হাই-ভোল্টেজ লাইনগুলোর প্রটেকশন ইকুইপমেন্টগুলোও ব্যর্থ হয়। তাই এই সকল কাকতালের মিলিত কারণে ১৪ই আগষ্ট ২০০৩ এর ব্ল্যাক-আউটটি ঘটে যার ফলে চার থেকে ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়। একই বছর, অর্থাৎ ২০০৩ সালে একই রকম বড়সড় বিদ্যুৎ-বিভ্রাট এবং গ্রিড-বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে ডেনমার্ক, ইটালি ও যুক্তরাজ্য। এমনকি ১৯৯৬ সালেও যুক্তরাষ্ট্রেরই অনুরূপ গ্রিড-বিপর্যয় ঘটে।
কিন্তু ধারাবাহিক গ্রিড-বিপর্যয়ের কারণ কী? গণিতবিদ এবং প্রকৌশলীরা দেখিয়েছেন, ভৌত ও অন্যান্য কারণ ছাড়াও ইন্টারকনেক্টেড সিস্টেমের কিছু নিজস্ব গুণাবলি থাকে যার কারণে এসব সিস্টেম বিফল হতে বাধ্য। তাই দেখা যায় ১৯৮৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বৈদ্যুতিক গ্রিডের জটিলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে গ্রিড-বিপর্যয়ের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ১৯৮৪ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে ১১টি বিপর্যয় ঘটেছে যাতে ৪,০০০ মেগাওয়াটের বেশি লোড ঝুঁকির মুখে পড়ে। ১৯৮০'র দশকে জটিল নন-লিনিয়ার সিস্টেম, যাদের আচরণ ব্যাখ্যা করে বিজড়িত বা কাপল্ড ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশন, বা ডায়নামিক সিস্টেমের প্রতি আগ্রহ বাড়তে দেখা যায়। তৈরি হয় 'কেওস' নামের এক নতুন বিদ্যার যা জটিল গতিময় সিস্টেমের সার্বিক আচরণ ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। যেমন আবহাওয়া, স্টক-মার্কেট বা পুঁজি-বাজার, বিক্ষুব্ধ ফ্লুয়িড থেকে গ্রহ-গতি বিজ্ঞান ইত্যাদি সবই গতিময় সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৮২ সালে ন্যান্সি কোপেল ও রবার্ট ওয়াশবার্ন দেখাতে সক্ষম হলেন যে একটি পাওয়ার সিস্টেম বা গ্রিড-ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত সমীকরণগুলো (যা 'সুইং ইকুয়েশন' নামে পরিচিত) এই কেওস তত্ত্ব অনুসরণ করে, ফলে দেখা যায় যে গ্রিডের ছোট্ট কোনো উপাংশের সামান্য ত্রুটি একটা জটিল কনেক্টেড সিস্টেমে বড়সড় ধাক্কার সৃষ্টির করে। এটাই কেওস তত্ত্বের মূল কথা, সেন্সিটিভ ডিপেন্ডেন্স অন ইনিশিয়াল কন্ডিশন, অর্থাৎ প্রান্তিক শর্তের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা। এর ফলেই দক্ষিণ আমেরিকার আমাজান জঙ্গলে একটি প্রজাপতির ডানা ঝটপটানি উপযুক্ত পজিটিভ ফিডব্যাকের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি করতে পারে।এটাই সেই তথাকথিত বাটারফ্লাই ইফেক্ট। এই পথে এগিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখলেন যে বিপর্যয়ের উপযুক্ত শর্তের অধীনে বৈদ্যুতিক সিস্টেমেও ঠিক এমনি ঘটনা দেখা যায়। বেঞ্জামিন কারেরাস, ডেভিড নিউম্যান ও ইয়ান ডবসন দেখিয়েছেন যে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট বা গ্রিড-বিপযর্য়ের সম্ভাবনা একটা সূচকীয় বিধি অনুসরণ করে, যার ফলে খুব বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্ভাবনা, আগে যেমন মনে করা হতো তার থেকে, অনেক বেশি বলে প্রতীয়মান হয়। এসবই নন-লিনিয়ার কেওটিক সিস্টেমের প্রকৃতির অনুরূপ।
পুঁজি-বাজার বা ইন্টারনেটের মতো জটিল সিস্টেম এক ধরনের ক্রিটিকাল আচরণ প্রদর্শন করে। সমুদ্রতীরে বালু জড়ো করতে করতে একসময়ে দেখা যায় একপাশ ধসে পড়ে। ঠিক একইভাবে এইসব জটিল সিস্টেম একটা নির্দিষ্ট সংকট দশার পর ভেঙে পড়ার প্রবণতা দেখায়। এভাবে বৈদ্যুতিক গ্রিডে শক্তির প্রবাহ বাড়ালে বা লাইন বাড়ালে বা ইকুইপমেন্টের সংখ্যা ও সূক্ষ্মতা বাড়ালে স্বল্প মেয়াদে ভালো ফল পেলেও দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি প্রবণতা এড়ানো মুশকিল। তাই বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রিড যতো জটিল হবে ততোই তার ঝুঁকি-প্রবণতা বাড়বে। তাই বড় গ্রিড-বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে এবং এর প্রতিরোধ থেকে এই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার পন্থাগুলি বিবেচনা করাই ভালো। এই কথাই বলেছেন সরোষ তালুকদার ও তাঁর সহযোগীরা ('ক্যাসকোডিং ফেইলিয়ার্স: সার্ভাইভাল ভার্সাস প্রিভেন্সন', দ্য ইলেকট্রিসিটি জার্নাল, নভেম্বর ২০০৩)। তাঁরা বলেছেন, ক্যাসকেডিং ফেইলিয়ার বা ধারাবাহিক গ্রিড-বিপর্যয়ের পর্যালোচনা ও ভবিষ্যদ্বাণী (বা প্রেডিক্ট) করায় কিছু অসুবিধা আছে। প্রথমত, এরা হাইব্রিড প্রপঞ্চ, অর্থাৎ সময়ের সাথে এদের বিবর্তন নিরবচ্ছিন্ন হলেও সুইচিংয়ের ফলে এতে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়; দ্বিতীয়ত, নেটওয়ার্কের প্রাথমিক দশার উপর গ্রিডের বিবর্তন বেশিমাত্রায় নির্ভর করে; তৃতীয়ত, বৈদ্যুতিক গ্রিডে অনেক নন-লিনিয়ারিটি কাজ করে (যেমন শক্তির প্রবাহ ও ট্রান্সফর্মারের সম্পৃক্ততা); চতুর্থত, গ্রিড পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে (যান্ত্রিক, মানবিক ইত্যাদি) অন্তর্নিহিত অনিশ্চয়তা। একটা ছোট্ট প্রোটেক্টিভ ডিভাইসের সেট-পয়েন্ট সামান্য কমালে তার প্রভাব গ্রিড-বিপর্যয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। সরোষ ও তাঁর সহযোগীরা বলছেন, "গ্রিডের রক্ষণাবেক্ষণ ও সার্বক্ষণিক পরিচালনে সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি পরবর্তী অবধারিত গ্রিড-বিপর্যয় থেকে সামাজিক ক্ষয়ক্ষতির সুরক্ষাও অতীব জরুরি কিংবা এই ধরনের বিপর্যয় সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা চাই।" না হলে এই ধরনের গ্রিড যেকোনো সাধারণ সন্ত্রাসী হামলাতেও নাজুক পরিস্থিতিতে পড়বে।
এবার আসা যাক যেকোনো নেটওয়ার্ক সিস্টেমে কীভাবে সূচকীয় বিধি বা 'পাওয়ার ল' প্রভাব ফেলে। মজার ব্যাপার হলো, এই ঘটনা একইসাথে বৈদ্যুতিক গ্রিড, সামাজিক নেটওয়ার্ক এবং দেশে ধনীদের সংখ্যা ব্যাখ্যা করে। বৈদ্যুতিক গ্রিড ও ধনীদের সংখ্যার মধ্যে কী মিল আছে? এই দুই সিস্টেমই সূচকীয় বিধি অনুসরণ করে। প্রকৃতিতে অধিকাংশ ঘটনাই নরমাল ডিস্ট্রিবিউশন বা প্রমিত বন্টন অনুসরণ করে। এর ছবি অনেকটা উল্টানো ঘন্টার মতো। ফলে যেকোনো ঘটনার একটা 'গড় মান' থাকে বা ঐ বন্টনের সর্বোচ্চ মান নির্দেশ করে। কিন্তু জটিল সিস্টেমের জন্য সূচকীয় বন্টন আছে যেখানে গড়-মানের কোনো ব্যাপার নেই। ঘটনা ও তার সম্ভাবনার লগ-মানকে প্লট করলে দেখা যাবে প্রমিত বন্টনে ঘটনার সম্ভাবনার একটা 'কাট-অফ' থাকে। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট মান পরে ঘটনার সম্ভাবনার মান দ্রুত পড়ে যায়। কিন্তু সূচকীয় বিধিতে এটা দেখা যায় না। ফলে প্রমিত বন্টনে যেসব ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুব কম থাকে, সূচকীয় বন্টনে সেই সম্ভাবনা অতো কম থাকে না। অর্থাৎ এই রকম বিন্যাসে কম-সম্ভাব্য ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। তাই দেখা যায় গ্রিড-বিপর্যয়ের মতো নিম্ন সম্ভাবনার ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাও বেশি হয়। একইভাবে দেখা যায়, কোনো দেশে কিছু মানুষের হাতে অসম্ভব সম্পদের আধিক্য ঘটে। অর্থাৎ একটা ছোট গ্রুপের মানুষের প্রচুর সম্পদশালী হবার প্রবণতার সম্ভাবনা প্রমিত বন্টনের তুলনায় বেশি থাকে। এটা কেন ?
কোনো দেশের মানুষের গড় উচ্চতা প্রমিত বন্টন অনুসরণ করে। কারণ আমরা বলতে পারি অমুক দেশের মানুষের গড় উচ্চতা অমুক ফুট তমুক ইঞ্চি। কিন্তু সেই দেশের সম্পদের বন্টনের ক্ষেত্রে দেখা যায় সেটা নরমাল ডিস্ট্রিবিউশন অনুযায়ী ঘটে না। সেখানে সূচকীয় বিধি কাজ করে। ফলে একটা কম-সংখ্যক জনগোষ্ঠীর হাতে বেশি পরিমাণ টাকা জমা হবার সম্ভাবনা প্রমিত বিন্যাসের তুলনায় সূচকীয় বিন্যাসে বেশি থাকে। তাই দেখা যায় যেকোনো দেশে অতি সামান্য সংখ্যক মানুষের হাতে প্রচুর সম্পদ জমা হয়। পৃথিবীর প্রথম একশো ধনীর হাতে সারা পৃথিবীর সম্পদ গচ্ছিত আছে। উনবিংশ শতকের প্রকৌশলী ভিলফ্রেদো প্যারেটো প্রথম এই পর্যবেক্ষণ নথিভুক্ত করেন। তাই এর নাম 'প্যারেটোর নিয়ম' এই নিয়মে দেখা যায়, প্রায় সকল দেশেই গুটিকয়েক মানুষের হাতেই অধিক সম্পদ গচ্ছিত থাকে। এর কারণ হলো কোনো নেটওয়ার্কের যেকোনো নোড-বিন্দুতে সংযোগের সম্ভাবনা যদৃচ্ছ বা র্যান্ডম নয়। অর্থাৎ সকল নোড সমান হারে নতুন সংযোগ সৃষ্টি করে না। সেই সব নোডের নতুন সংযোগ স্থাপনের সম্ভাবনা বেশি থাকে যাদের সংযোগ-সংখ্যা আগে থেকেই বেশি।
অর্থাৎ "এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভুরি ভুরি/ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি"। তাই যার সম্পদ আগে থেকেই তুলনামূলকভাবে বেশি, তার তেজারতেই আরো বেশি সম্পদ জড়ো হবার সম্ভাবনা বেশি। একই ঘটনা এয়ারপোর্টের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। যেসব বড় এয়ারপোর্ট আন্তর্জাতিক 'হাব' হিসেবে কাজ করে, তাদের ক্ষেত্রে নতুন সংযোগ-ফ্লাইট সৃষ্টির সম্ভাবনা বেশি। একটা নতুন এয়ার-রুট হংকং এয়ারপোর্টকে ব্যবহার করবে, ঢাকাকে নয়। এবং আরো দেখা যায় ডায়নামিক সিস্টেমে এইসব সুপারনোডের ঝুঁকি প্রবণতাও বেশি থাকে।
ল্যাসলো বারাবাসি তাঁর ছাত্র রেকা অ্যালবার্ট দেখিয়েছেন যে ইন্টারনেট সুচকীয় বিধি অনুসরণ করে। তাঁরা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন যে অন্য যেকোনো নেটওয়ার্কের তুলনায় (যারা প্রমিত বন্টন বা অনুরূপ বিন্যাস অনুসরণ করে) পাওয়ার-ল বা সূচকীয় নেটওয়ার্কের 'রোবাস্টনেস' বেশি। অর্থাৎ এদের সংযোগ আরো বেশি মজবুত হয়। ফলে এইসব নেটওয়ার্ক সহজে ব্যর্থ বা ফেইল করে না। তার কারণ এইসব নেটওয়ার্কে গুটিকয়েক 'হাব' বা 'সুপাররিচ নোড' থাকে যাদের সংযোগ-সংখ্যা অন্যগুলির তুলনায় অনেক বেশি। এইসব অস্বাভাবিক নোডের সংখ্যা অনেক কম থাকে বলে অন্য নেটওয়ার্কে যেমন র্যান্ডম ফেইলিয়রের বা আকস্মিক ব্যর্থতার সংখ্যা বেশি হয়, এসব নেটওয়ার্কে সেটা কম হয়। তার কারণ র্যান্ডম নেটওয়ার্কে সংযোগশালী নোডের সংখ্যা সূচকীয় নেটওয়ার্কের সুপাররিচ নোডের তুলনায় বেশি থাকে। তাই তাদের র্যান্ডম ফেইলিয়ারের সংখ্যাও বেশি হয়। একারণেই সূচকীয় নেটওয়ার্কের রোবাস্টনেস বেশি থাকে। একই কারণে, এদের ঝুঁকি প্রবণতাও অন্য সাধারণ নেটওয়ার্কের তুলনায় বেশি। যেহেতু এখানে গুটিকয়েক নোডেই অধিকাংশ সংযোগ যুক্ত থাকে, তাই এদের কোনো একটির পতন হলে পুরো নেটওয়ার্ক মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ে। ভেবে দেখুন, হিথ্রো এয়ারপোর্ট আচমকা বন্ধ হয়ে গেলে, পৃথিবী ব্যাপী ফ্লাইট-শিডিউল কেমন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় নবাবী আমলে বেশ কিছু সুবিধাভোগী শ্রেণী তৈরি হয় যাদের মুখপাত্র ছিল জগৎশেঠ পরিবার। এইসব গুটিকয়েক মানুষের হাতে সুবা-বাঙলার অর্থনীতির একটা বড় অংশ নিয়ন্ত্রিত হতো। সিরাজুদ্দৌলার পতনের (১৭৫৭) পর বাংলায় যে সামাজিক ডামাডোলের সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তী নবাব মীর কাসিমের (মৃ. ১৭৭৭) হাতে জগৎশেঠদের মতো বৃহৎ পুঁজিপতিদের মৃত্যু ঘটায়। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক খুঁটি নড়বড়ে হয়ে যায়। এই সুযোগে ইংরেজরা তাদের মনমতো নতুন পুঁজি কাঠামো গড়ে তোলে।
এই একই প্রক্রিয়া বৈদ্যুতিক গ্রিডেও কাজ করে। তাই এয়ারলাইন ট্রাফিক, ইন্টারনেট, বৈদ্যুতিক গ্রিড, সমাজে সম্পদশালীদের অবস্থান একই সূত্রে গাঁথা। এরা প্রত্যেকেই সংযোগের সূচকীয় বিধি ব্যবহার করে। এদের অন্তর্নিহিত শক্তিই আবার এইসব নেটওয়ার্কের ঝুঁকি প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। র্যান্ডম ফেইলারকে ভয় নেই, আসল ভয় হ্যাকার ও সন্ত্রাসী হামলার। নেটওয়ার্কের একটি দুটি 'বটবৃক্ষ' যদি আক্রান্ত হয়, তাহলে পুরো নেটওয়ার্কে ক্যাসকেড ফেইলিয়ার দেখা দেয়।
সমাজে যে কারণে অস্বাভাবিক পুঁজিপতির সৃষ্টি হয়, ঠিক সেই একই প্রক্রিয়ায় জগৎজোড়া অন্তর্জাল 'ইন্টারনেট' কিংবা বৈদ্যুতিক গ্রিডও সংযুক্ত হয়। গ্রিডকে সমুন্নত রাখতে বিভিন্ন কার্যক্রম নেওয়া হলেও সংযোগের অন্তনির্হিত প্রকৃতির কারণেই তারা আবার ঝুঁকির মুখে পড়ে। মজার বিষয় হলো, এইসব ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে গ্রিডকে যদি সবদিক দিয়ে সুরক্ষিত রাখতে হয়, সেক্ষেত্রে তার সংযোগ-জনিত গতিশীলতা ব্যাহত হবে। তাই গ্রিডকে ঝুঁকিহীন সম্পূর্ণভাবে করা মুশকিল। এর শক্তিই এর ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জটিল সিস্টেমের এই এক আশ্চর্য রহস্য যে আপাত-বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন ঘটনাক্রমকে জটিল নেটওয়ার্ক থিওরির কাউন্টার-ইন্টুইটিভ তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।
তথ্যপঞ্জি:
১/ ডানকান ওয়াট্স, 'সিক্স ডিগ্রিস', ২০০৩। ২/ পিটার ফেয়ারলি, "দ্য আনরুলি পাওয়ার গ্রিড", স্পেকট্রাম, আগষ্ট ২০০৪। ৩/ সরোষ তালুকদকদার ও অন্যান্য, "ক্যাসকেডিং ফেইলিয়র্স: সার্ভাইভাল ভার্সাস প্রিভেনশন", ইলেকট্রিসিটি জার্নাল, নভেম্বর ২০০৩।
ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী : বিজ্ঞান গবেষক ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।