একটা এক্সপ্রেসওয়ে বানাতে যখন প্রবীণ বৃক্ষদের মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ, তখন বাধ্য হয়ে বলতে হয় ‘আবারো’ উন্নয়নের প্রশ্নহীন কোপ পড়তে যাচ্ছে গাছের শরীরেই।
Published : 03 Apr 2024, 08:11 PM
‘আবারো’ শব্দটিকে নিদারুণভাবে ভয়াবহ করে তোলা হচ্ছে। শব্দটি শুনলেই যেন সামনে হাজির হয় সহস্র অমীমাংসিত হাহাকার। প্রতিদিন ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ, দগ্ধ, বেদনার্ত হয়ে লিখতে হয় ‘আবারো’। ‘আবারো বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ’, ‘আবারো আগুনে অঙ্গার’, ‘আবারো ফসলের বিষে মরল পাখি’, ‘আবারো পাহাড় কাটা’ কিংবা ‘আবারো উন্নয়নের করাতে প্রাণ গেল গাছের’।
এর বাইরে ‘আবারো’ শব্দটি কোনো আশা জাগানিয়া স্বপ্নময়তার সাহস নিয়ে পালক মেলে না আজকাল। ২১ মার্চ বিশ্ব বনদিবসের আওয়াজ মেলাতে না মেলাতেই খবর এল এক্সপ্রেসওয়ের স্থাপনা নির্মাণের জন্য এখন গাছ কাটতে চায় ‘চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)’। প্রতিষ্ঠানটি সংক্ষেপে সিডিএ (চট্টগ্রাম ডেভলপমেন্ট অথরিটি) নামে পরিচিত হওয়ায় চলতি লেখায় সিডিএ নামটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
একটা এক্সপ্রেসওয়ে বানাতে যখন প্রবীণ বৃক্ষদের মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ, তখন বাধ্য হয়ে বলতেই হয় ‘আবারো’। আবারো উন্নয়নের প্রশ্নহীন কোপ পড়তে যাচ্ছে গাছের শরীরেই। বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা পাবলিক পরিসর সর্বত্র আমরা দেখছি নতুন ভবন নির্মাণ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে প্রথম খুন হয় সেখানকার গাছপালা, তরুলতা, গুল্ম। উন্নয়নের বিজ্ঞাপনকে সামনে রেখে এলোপাথারি জখম হয় গাছ।
সিডিএ চট্টগ্রামের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে। ২০১৯ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করেন। প্রায় ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ের এই এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি ওঠানামার জন্য প্রায় ১৪টি র্যাম্প রাখা হয়েছে। এর ভেতর দুটি নগরের সবুজবলয় টাইগারপাসে। টাইগারপাস থেকে পলোগ্রাউন্ড পর্যন্ত মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী সড়কে গাড়ি ওঠার জন্য একটি র্যাম্প হবে এবং নিচে আরেকটি। এছাড়া একটি জিইসি মোড়ে, চারটি আগ্রাবাদে, একটি ফকিরহাটে, দুটি নিমতলায়, দুটি সিইপিজেডে এবং দুটি কেইপিজেডে। গাড়ি ওঠানামার এই র্যাম্প তৈরি করতে হলে কাটতে হবে চট্টগ্রামের এই গুরুত্বপূর্ণ সবুজবলয়ের বহু গাছগাছালি। বিনষ্ট হবে এই বাস্তুতন্ত্র। বহু বুনোপ্রাণ হারাবে বাসস্থান ও বিচরণস্থল।
ইতোমধ্যেই প্রায় ৫০টি গাছের শরীরে লালকালির মৃত্যুদণ্ড আঁকা হয়েছে। গাছকাটা বিষয়ে সিডিএ প্রধান প্রকৌশলী গণমাধ্যমকে জানান, উন্নয়ন কাজ করতে গেলে কিছু গাছ কাটা পড়ে। তিনি আরো জানান, আউটার রিং রোডে ২০ হাজার গাছ কাটা পড়েছিল কিন্তু পরে লাগানো হয়েছে ৫ লাখ। গণমাধ্যমসূত্রে জানা যায়, জমি ব্যবহারের জন্য রেলের অনুমতির পাশাপাশি বনবিভাগের কাছে গাছ কাটার অনুমতিও চেয়েছে সিডিএ। আশা করি রাষ্ট্র পরিবেশবাদী, গবেষক, পেশাজীবীসহ নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব দেবে। ব্রিটিশ উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিবহ চট্টগ্রামের উল্লিখিত সবুজবলয়ের গাছ কাটা বন্ধ রাখবে। গাছ না কেটে এক্সপ্রেসওয়ে ও উন্নয়নকাজ সমাপ্ত করবে।
কীভাবে করবে? সর্বজনের মতামত ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে। প্রকৌশলী, নগর পরিকল্পনাবিদ, রাজনৈতিক, পরিবেশকর্মী এবং নগরবাসীদের গাছ বাঁচিয়ে রাস্তা ও র্যাম্প বানানোর পরিকল্পনা করতে হবে। নতুন চিন্তা, নতুন উদ্ভাবনকে গুরুত্ব দিতে হবে। বৃক্ষবান্ধব অবকাঠামোগত উন্নয়নচিন্তা ও নগরপরিকল্পনাকে সক্রিয় করতে হবে। ‘সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের’ ব্যানারে গাছ জড়িয়ে ধরে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ। গাছের জীবন বাঁচাতে চট্টগ্রামের নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত বাতিল করে দ্রুত চট্টগ্রাম নগরীর সবুজবলয়ের নিরাপত্তা সুরক্ষার দাবি জানাই।
লেখাটি যখন শেষ করেছি, তখনি, সিডিএর সঙ্গে চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ সাক্ষাৎ করে গাছ না কাটার বিষয়ে আলোচনা করেন। ওই আলোচনার পর সিডিএ জানিয়েছে আপাতত গাছকাটার বিষয়টি তারা স্থগিত করেছেন এবং র্যাম্পের পুনঃনকশা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপাতত উল্লিখিত সড়কে র্যাম্প না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিডিএ। গাছ কাটার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য সিডিএকে ধন্যবাদ। একইসঙ্গে পুনঃনকশা এবং সেই নকশা সর্বজনের জন্য উন্মুক্ত করে সকলের মতামত গ্রহণের মাধ্যমে চূড়ান্তকরণের সিদ্ধান্তটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রামের এই সাম্প্রতিক ঘটনা আমাদের কাছে স্পষ্ট করে যে, এক্সপ্রেসওয়ের এই উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং নকশা আগে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি। পূর্বের নকশার ক্ষেত্রে মানুষের মতামত গ্রহণ করা হয়নি। আর তাই গাছ কাটার সর্বনাশী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সিডিএ। এই ঘটনা একই সঙ্গে সিডিএকে আরো বেশি জনবান্ধব এবং পরিবেশমুখী হওয়ার বার্তা দেয়। জনমতকে গুরুত্ব দিয়ে সিডিএর গাছ বাঁচানোর এই সিদ্ধান্ত ও দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে বহু অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।
আমাদের সামনে পরিবেশবান্ধব গাছমুখী উন্নয়নের দৃষ্টান্ত হাজির করে। এখনো দেশব্যাপী যত রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রকল্প এলাকার গাছ, জলা, জমি, পাহাড়, জঙ্গল ও প্রাণবৈচিত্র্য বিনষ্ট করছে সেইসব প্রকল্প সিডিএর এই গাছ না কাটার সিদ্ধান্ত থেকে তালিম নিতে পারে। দম নিতে পারে। আমরা যত বেশি প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা করে জনমতকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়নপ্রকল্প বাস্তবায়ন করব, আমাদের উন্নয়নের ময়দান তত বেশি সবুজ ও মায়াময় হয়ে ওঠবে।
প্রায় সব বৃহৎ অবকাঠামোগত প্রকল্প ও স্থাপনা তৈরির ক্ষেত্রে যারা এসব প্রকল্প নকশা এবং বাস্তবায়ন করেন তারা গাছ কাটা ও বাস্তুতন্ত্র বিনষ্টের সিদ্ধান্ত নেন, একতরফাভাবে, এলাকার প্রকৃতি ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা গুরুত্ব না দিয়ে। এ যেন দেশজুড়ে চলছে। আবার যখন গাছ বাঁচাতে, পরিবেশ সুরক্ষা প্রশ্নে জনআন্দোলন তৈরি হয় তখন বহু প্রকল্প গাছ কাটা ও পরিবেশ ধ্বংসের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। দেখা গেছে সেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় গাছকাটা ছাড়াই। তাহলে প্রশ্ন হলো প্রথমেই কেন গাছ কাটা এবং পরিবেশ বিনষ্টের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়? যেসব নকশাবিদ, প্রকৌশলী, স্থাপত্যবিদ কিংবা নগর পরিকল্পনাবিদ এমন প্রকল্পে জড়িত থাকেন এবং গাছকাটার সিদ্ধান্ত নেন তাদের নাম পরিচয় পাবলিক পরিসরে প্রকাশ করা জরুরি। কারণ একজন প্রকৌশলী বা নকশাবিদের গাছহত্যার সিদ্ধান্ত কেন রাষ্ট্র বা সরকার বহন করবে? যখন উন্নয়নপ্রকল্পে গাছ ও পরিবেশ বিপন্নতার বিষয়গুলো আসে তখন সর্বজনতা বিষয়টিকে কোনো ব্যক্তি প্রকৌশলী বা নকশাবিদের দায়িত্বহীনতা বা বাণিজ্য হিসেবে দেখে না, পাঠ করে রাষ্ট্রের বাহাদুরি হিসেবে।
একটা সড়কের জন্য পঞ্চাশটি গাছ খুন হলে মানুষ বিষয়টিকে দেখে সরকারের ‘পরিবেশবিনাশী’ দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে। এভাবে সরকার, রাষ্ট্র এবং সর্বজনতার ভেতর প্রাণ-প্রকৃতি প্রশ্নে দীর্ঘ দূরত্ব ও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, জটিল হয়ে ওঠে। যে কোনো উন্নয়নপ্রকল্প পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে রাষ্ট্রকে এসব বিবেচনা করতে হবে। প্রকৃতি ও জনতার বিরুদ্ধে গিয়ে আর যাই হোক কোনো উন্নয়ন হয় না। এ ঘটনাটি বুঝতে যশোর রোডে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়তি গাছদের রক্ষা আন্দোলন এবং ঢাকার ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কের গাছ রক্ষা আন্দোলনের উদাহরণকে আমরা স্মরণ করতে পারি।
যশোর-খুলনা মহাসড়কে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত প্রায় পাঁচ হাজার গাছের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে দুটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল সড়ক ও জনপথ বিভাগ। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে অনুমোদিত হয়। গাছ রক্ষায় তুমুল নাগরিক আন্দোলনের মুখে ২০১৭ সালের ১৩ জুলাই গাছ না কেটে সড়ক সংস্কারের ঘোষণা দেয় সরকার। কিন্তু সেই ঘোষণাকে গুরুত্ব না দিয়ে ২০১৭ সালের ১৭ অগাস্ট দরপত্র আহবান করে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি যশোর জেলা প্রশাসনের সভাকক্ষে ‘যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক যথাযথ মানে ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্পের আওতায় রাস্তার দুই পাশের গাছসমূহ অপসারণ’ শীর্ষক সভায় গাছ কেটে সড়ক উন্নয়ন পরিকল্পনা গৃহীত হয়। আদালত গাছ না কাটার ক্ষেত্রে ৬ মাসের নিষেধাজ্ঞাও জারি করে। কিন্তু পরবর্তীতে নানাভাবে গাছ কাটা হয়, অপসারণ হয়, কিছু গাছ রেখে দেয়া হয়। ধানমন্ডি সাতমসজিদ সড়কে সড়ক-বিভাজক সম্প্রসারণের জন্য ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকেই গাছ কাটা শুরু হয়। প্রতিরাতে ট্রাকে করে হারিয়ে যায় গাছের নিথর শরীর। গাছ হত্যা করে সাতমসজিদ সড়কে সিটি করপোরে্পোরেশন বসাতে থাকে বালুভর্তি লোহা আর কংক্রিটের বিভাজক। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয় ‘সাতমসজিদ রোড গাছ রক্ষা আন্দোলন’। আন্দোলনের মুখে কিছুদিন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কিছুদিন গাছ কাটা বন্ধ রাখলেও পরবর্তীতে গাছ হত্যা করেই তারা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে।
যে দেশের বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু গাছের জীবনরহস্য আবিষ্কার করেছিলেন, সেই দেশে এখন রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ, প্রকৌশলী, নকশাবিদ কিংবা উন্নয়নবিদদের কী আমাদের আবারো শেখাতে হবে গাছের গুরুত্ব। ২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠক ‘বৃক্ষসংরক্ষণ আইন ২০১৬’ নীতিগতভাবে অনুমোদন করে। জাতিসংঘের আন্তজার্তিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ ১৯৯২ এবং ২০২১ সালে গ্লাসগো সম্মেলনে গৃহীত বিশ্বের বৃক্ষ ও বন সুরক্ষা নীতি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ বৃক্ষ রক্ষায় বৈশ্বিক অঙ্গীকার করেছে। সংবিধানের ১৮(ক) ধারায় উল্লেখ আছে, “রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বহুবার বৃক্ষরোপণ এবং বৃক্ষ সুরক্ষায় জোর দিয়েছেন। তাহলে আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পক আর প্রকৌশলীরা কীভাবে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবার আগে প্রাণ-প্রকৃতি হত্যা করতে চান?
২০২১ সালে করোনা মহামারীর ভেতর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে চট্টগ্রামের সিআরবিতে হাসপাতাল তৈরির অনুমোদন দেয়া হলেও আন্দোলনের মুখে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। আমরা বিশ্বাস করি সিডিএ গাছ ও সবুজবলয় সুরক্ষা করে এক্সপ্রেসওয়ের পুনঃনকশা করবে। গাছ কাটার মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা থেকে সমূহে বাতিল হবে।