তাদের একজনের নাম ব্রুস উইলসন, অন্যজন ডব্লিউ এস ওডারল্যান্ড। ওডারল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আগ্রহীদের কাছে ব্রুসের তুলনায় অনেক বেশি পরিচিত। তিনি একমাত্র বিদেশি বীরপ্রতীক।
Published : 17 Dec 2023, 05:58 PM
এমন দুজন বিদেশির কথা জানি আমি, যারা আমার সঙ্গে আলাপচারিতায় বাংলাদেশের বিজয়ের দিনটি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, উভয়ের অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠ টের পেয়েছিলাম ফোনে।
তাদের একজনের নাম ব্রুস উইলসন, অন্যজন ডব্লিউ এস ওডারল্যান্ড। ওডারল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আগ্রহীদের কাছে ব্রুসের তুলনায় অনেক বেশি পরিচিত। তিনি একমাত্র বিদেশি বীরপ্রতীক।
আমি যখন ব্রুস উইলসনের কথা জানতে পাই এবং তার সঙ্গে যোগাযোগ করি, তিনি তখন বিলেতের এক হাসপাতালে শয্যাশায়ী। লন্ডনের সঙ্গে সময় মিলিয়ে যখন ফোনে পেয়েছিলাম, তখন ওখানে সকাল।
কী পরিচয় দেব? কী বলব? এসব দ্বিধা দূরে সরিয়ে সরাসরি বলেছিলাম আমি এক গর্বিত বাংলাদেশি। সিডনিতে থাকি। তাকে বলেছিলাম, আমি জানি তিনি একজন অস্ট্রেলিয়ান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস রণাঙ্গনে কাটিয়েছিলেন। মেলবোর্ন এজ পত্রিকার হয়ে নয় মাস যুদ্ধের খবর সংগ্রহের পাশাপাশি তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করার পাশাপাশি তাদের একজন হয়ে ওঠা ব্রুস যে বিজয় দিবসে আত্মসমপর্ণের দিন তখনকার রেসকোর্সে ছিলেন, সে কথাও জানিয়েছিলাম তাকে।
ব্যস, তাতেই কাজ হলো। ব্রুস উইলসন শুরুতেই আমাকে চমকে দিয়েছিলেন জন্মগত পরিচয় এবং গোত্র-বর্ণ বিষয়ে তথ্য দিয়ে। আমি যে হিন্দু পরিবারে জন্মেছি, তা আমার নাম ও পদবিতে বোঝা কঠিন নয়; কিন্তু একজন বিদেশি কতটুকু জানলে বলে দিতে পারেন, আমি বৈদ্য সম্প্রদায় নামে পরিচিত বর্ণের কেউ। তাছাড়া সব কথাতেই আমি বারবার টের পেয়েছিলাম, বাংলাদেশের রাস্তাঘাট, এমনকী জনজীবন বিষয়েও অনেক কিছু তার নখদর্পণে।
হাসপাতালের বিছানায় শায়িত ব্রুস ১৬ ডিসেম্বর সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ওসমানী বা সেই মাপের কেউ সেদিন উপস্থিত না থাকাটা তাদের মতো বিদেশি সাংবাদিকদেরও ভালো লাগেনি। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীনের অনুপস্থিতিও পীড়া দিয়েছিল তাকে। তার ধারণায় পাকিস্তানি বাহিনী চায়নি এমন কিছু। আর ভারত তখন তাড়াতাড়ি আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া সারতে ব্যস্ত। তাদের মাথায় তখনো আমেরিকা-চীনের কথা ঘুরছিল। কারণ পাকিদের জন্য এ দুই পরাশক্তি কোনো আক্রমণ শানালে বা যে কোনো কিছু করলে এমন প্রক্রিয়া ভেস্তে যেতে পারে। তাদের অনুমান যে মিথ্যা নয়, তার প্রমাণ বঙ্গোপসাগরে আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের আনাগোনা। যদিও পরে তারা মাছ ধরার জন্য এসেছিল—এমন ফালতু হাস্যকর অজুহাত দিয়ে চলে গিয়েছিল।
ব্রুস মনে করতেন, আত্মসমর্পনের সময় যদি সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনের মতো কেউ থাকতেন, তবে ইতিহাস আরও গতি পেত। অন্য রকম হতো। এত ইতিহাস বিকৃতির শিকার হতো না দেশ। ইতিহাস ও বিজয় দিবস—এ দুই বিষয়ে তার পরিষ্কার ধারণা আর অভিমত আমরা জানলে বা মানলে দেশ ও সমাজেরই উপকার হতো। ব্রুস উইলসন বাংলাদেশি না হয়েও বুঝেছিলেন, আমাদের দুর্বলতার সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে, অনৈক্য আর বিভেদ। তার মতে, এ বিভেদের মূল কারণগুলোর একটি হচ্ছে, বিজয় দিবসের প্রতি যথাযথ মনোযোগ আর ধ্যানের অভাব। ব্রুস বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অন্যায় আর অবিচারের পাশাপাশি অবহেলা তার বুকে দাগ কেটেছিল। তিনি তখনই বলেছিলেন, একমাত্র বিজয় দিবসের তাৎপর্য আর উদ্ভাসই পারে মুক্তিযুদ্ধের সম্মান বাঁচাতে। একাত্তরের পর মাত্র একবার গিয়েছিলেন বাংলাদেশে। কিন্তু তখন মুক্তিযুদ্ধের সরকার দেশশাসনে না থাকায় তিনি ফিরেছিলেন হতাশ হয়ে। তার সঙ্গে আলাপচারিতার শেষ অংশটুকু অনেকদিন মনে থাকবে আমার। বারবার বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের এ দেশ যদি বিজয় দিবস এবং ইতিহাসমুখী না হয়, তা হলে এর চারিত্র্য যেমন সঠিক থাকবে না, তেমনি দেশও থাকবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত। এখন ফিরে তাকালে আসন্ন ডিসেম্বরের আগে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা স্বদেশ যেন ব্রুস উইলসনের কথামতো সে পথে এগোচ্ছে।
আরেকজন, যিনি বিজয় দিবসের গর্বিত শরিক, তিনি আমাদের একমাত্র বিদেশি বীরপ্রতীক, ডব্লিউ এস ওডারল্যান্ড। মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকার বাটা সু কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। তরুণ যোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। জন্মসূত্রে ছিলেন নেদারল্যান্ডসের নাগরিক। পরে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব নেন। ওডারল্যান্ড থাকতেন পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরে। যখন তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়, তখন তিনি চোখে ভালো দেখতে পেতেন না। স্নায়ুও নিয়ম মেনে চলছিল না। রক্তচাপ ছিল আয়ত্তের বাইরে। ফলে বেশিরভাগ সময় তিনি কাটাতেন বিছানায়। কোনো ধরনের উত্তেজনা বা চাপ নেওয়া ছিল ডাক্তারের বারণ। তবু ‘বাংলাদেশ’ নামটা শুনলেই উত্তেজিত হতেন। মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড আবেগ আর রাগে ফেটে পড়তেন। বারবার চেষ্টার ফলে এক সময় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়।
খুব কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ধীরে ধীরে কথা বলেছিলেন সেদিন। তার কথা ছিল একটাই—যে জাতির জন্য তিনি জান হাতে লড়াই করেছিলেন, তাদের নৈতিক অধঃপতন তার ভালো লাগত না। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও পরে জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। যে কারণে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি এ মুক্তিযোদ্ধা।
বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসকে ভীষণ শ্রদ্ধা করা এ মানুষটি বলেছিলেন, ১৬ ডিসেম্বর যদি ফিকে হয় বা কোনো কারণে অনুজ্জ্বল হয়ে পড়ে, মনে রাখতে হবে, তার বা তার মতো যারা আত্মত্যাগ করেছিলেন, তাদের আত্মার অভিশাপ এড়ানো যাবে না। আমি জানি না, এমন অমোঘ সত্য কথাটি তিনি কেমন করে বলেছিলেন সেদিন।
আমার গর্ব, এই দুই বিদেশি বীরের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলাম। তাদের মতো আরও অনেকেই আছেন আকাশের তারায় তারায়। তাদের কথা যেন বিফলে না যায়। এ দেশ ও মাটি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এখন দায় আমাদের।
একটি জাতি স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে আসার পরও যদি তার ইতিহাস আর অতীতকে ভালোভাবে না জানে তারচেয়ে দুঃখের আর কিছুই হতে পারে না। আজকের প্রজন্ম কিছুই জানে না। এইসব বিদেদিদের কথা শোনেনিও। কারণ আমাদের পাঠ্য বই বা আমাদের লেখাপড়ার কোথাও এদের কথা বলা হয় না। এর দায় আমাদের । যারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে আমাদের মুক্তির জন্য জান দিতে চেয়েছিলেন ঝুঁকি নিয়েছিলেন তাদের কাজ তাঁরা করে গেছেন। কৃতজ্ঞ জাতি হলে সারাজীবন তা মনে রাখতো। আমরা এখন ই ভুলে যেতে বসেছি। তবে কি এঁদের কেউ বেঁচে থাকলে বা তাঁদের উত্তরসূরীরা ধরে নেবেন যে ভুল দেশের ভুল মানুষের জন্য তারা লড়াই করেছিলেন? এর উত্তর আমাদের ইতিহাস। এর জবাব দেবে সরকার। এর দায় নিতে হবে সকলকে। এতোবড় ইতিহাস আর এমন মানুষদের যদি আমরা মনে না রাখি ইতিহাস আমাদের মার্জনা করবে না। যে সব বিদেশি ভালোবেসে ত্যাগ স্বীকার করে সঙ্গে থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়কে ত্বরান্বিত ও সফল করেছিলেন তাঁদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। স্যালুট আপনাদের, হে মহান আত্মার বিদেশি স্বজন।