Published : 16 May 2014, 04:46 PM
এলিট ফোর্স হিসেবে তৈরি করা 'র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান' বা র্যাবের বিলুপ্তি বা সংস্কার নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো র্যাবের জন্মের সময়ই এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে বিএনপি সরাসরি এই বাহিনীর বিলুপ্তি চাচ্ছে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ বাহিনীটির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নানান ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো মন্ত্রী র্যাবের গুণগান গেয়ে জনসংযোগ বিভাগের কাজটিও করে দিচ্ছেন!
র্যাবের সৃষ্টি কিন্তু চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। বাহিনীটি তৈরি হয়েছে ২০০৪ সালে। এর পেছনে রয়েছে 'অপারেশন ক্লিন হার্ট' নামে সেনা অভিযানে নির্বিচারে মানুষ হত্যা। ২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করার তিন মাস পরই (অক্টোবর ১৬ থেকে ৯ জানুয়ারি, ২০০৩), অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য সারাদেশে অভিযান চালানো হয়।
মূলত সেনাবাহিনী এসব অভিযান পরিচালনা করত। তখনকার সংবাদপত্র ঘাঁটলে দেখা যায়, সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর ৫৪ জন তাদের হেফাজতে মারা গেছেন। বিনা বিচারে এই মৃত্যু 'জায়েজ' করার চেষ্টা করা হয়েছে 'হার্ট অ্যাটাক' নামের গল্প দিয়ে– যে রকমভাবে আজ ক্রসফায়ারে হত্যার পর তথাকথিত 'বন্দুক যুদ্ধের' গল্প আমরা শুনে আসছি।
সমস্যা হল, এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ইনডেমনিটিও আছে। পত্রপত্রিকার হিসাবে, অপারেশন ক্লিন হার্টে সেনাবাহিনীর হেফাজতে ৫৪ জন মারা গেলেও, সরকার স্বীকার করেছিল মাত্র ১২ জনের মৃত্যুর কথা। এই ১২ জনের কারও পরিবারও কিন্তু হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইতে পারবেন না। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কেউ যেন আদালতে যেতে না পারেন সে জন্য ইনডেমনিটি জারি করা হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০০৩।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ইনডেমনিটি জারির এটা দ্বিতীয় ঘটনা। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাসভবনে সপরিবারে হত্যা করার পর তাঁর খুনিদের বাঁচানোর জন্য এ রকম আদেশ জারি করা হয়েছিল।
দেশের মানবাধিকার সংস্থা, গণমাধ্যম, আন্তর্জাতিক দাতা সম্প্রদায়ের ব্যাপক সমালোচনার মুখে জোট সরকার 'অপারেশন ক্লিন হার্ট' বন্ধ করে দিলেও, তারা এ ধরনের অভিযান অন্য কী উপায়ে চালু রাখা যায় সে পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। ৯ জানুয়ারি অপারেশন ক্লিন হার্টের অভিযান বন্ধ করার দু'সপ্তাহ পর, অর্থাৎ ২০০৩ সালের ২৫ জানুয়ারি 'র্যাপিড অ্যাকশন টিম' বা র্যাট প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ জন্য সেনাবাহিনী থেকে কমান্ডো প্রশিক্ষণ নেওয়া পুলিশ সদস্যদের বেছে নেওয়া হয়।
এরই মধ্যে সরকার অনুভব করে যে, সেনাপ্রশিক্ষণ নয়, সেনাসদস্যদের দিয়েই বাহিনীটি গড়ে তুলতে হবে। পরের বছরই তাই র্যাটের আকার ও কর্মপরিধি বাড়িয়ে 'র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান' বা র্যাব বানানো হয়। এই বাহিনীতে পুলিশের ৪০ শতাংশ, সশস্ত্র বাহিনীর ৪০ শতাংশ আর অন্যান্য বাহিনীর ২০ শতাংশ সদস্য রয়েছেন। বিভিন্ন বাহিনীর বাছাই করা সদস্যদের দিয়ে তৈরি র্যাবের কাছে আছে সকল আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। পাশাপাশি, তাদের বেতনও ৭০ শতাংশ বেশি এবং পুলিশের চেয়ে তাদের সোর্স মানি অনেক বেশি।
তাদের মূল কাজ অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক এবং এ ধরনের ক্ষতিকারক দ্রব্য উদ্ধার, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার এবং দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় অন্যান্য বাহিনীকে সহায়তা করা। যে কোনো অপরাধ সংঘটন ও অপরাধীদের সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য প্রদান করাও তাদের কাজ।
বাস্তবে দেখা যায়, এ সব কাজের চেয়ে ক্রসফায়ারের গল্প চালু করে র্যাব আলোচনায় চলে এসেছে। এরই ধারাবাহিকতায়, পরবর্তীতে র্যাবের বিরুদ্ধে গুম করার মতো গুরুতর অভিযোগও উঠছে, আলোচিত হচ্ছে।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে সাত ব্যক্তি অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় র্যাবের কজন কর্মকর্তার জড়িত থাকার অভিযোগের পর, বিএনপির পক্ষ থেকে র্যাব বিলুপ্ত করার দাবি তোলা হয়েছে। আর মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, র্যাবের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কোনো ধরনের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নেই বলে এবং এ বাহিনীর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে আজ এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, র্যাব নামের বাহিনীটি বিলুপ্ত করলেই কি হত্যা, গুম, অপহরণ, ক্রসফায়ার সব বন্ধ হয়ে যাবে? আমার বিশ্বাস, এগুলো আরও বাড়বে। তাই এই বাহিনী বিলুপ্ত না করে যদি একে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায় তাহলে কাজের কাজ কিছু হতে পারে।
এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, র্যাব জবাবদিহিতার আওতায় আসবে কী করে? এই বাহিনীটি আগাগোড়াই সেনাবাহিনী-নিয়ন্ত্রিত, যদিও কাগজে-কলমে এটি পুলিশের একটি বিভাগ, কার্যত এ বাহিনীর ওপর পুলিশপ্রধানের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
র্যাবের বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সংস্থাটির মহাপরিচালক পুলিশ বাহিনী থেকে নিয়োগ পান। অতিরিক্ত মহাপরিচালক, অপারেশন ও পরিচালক, অপারেশন সশস্ত্র বাহিনী থেকে আসেন। অর্থাৎ র্যাবের যে মূল কাজ, অপারেশন, তার নেতৃ্ত্ব আছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা।
মাঠ পর্যায়ে যারা নেতৃত্ব দেন তারা হলেন ব্যাটালিয়ান প্রধান। র্যাবের ব্যাটালিয়ানের সংখ্যা এখন ১৪। এর মধ্যে ১১ টিতেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন সশন্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। প্রতিটি ব্যাটালিয়ানের সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড সশস্ত্র বাহিনীর হাতে। আবার প্রতিটি ব্যাটালিয়ানে একাধিক কোম্পানি রয়েছে। সবগুলো কোম্পানির কমান্ডার পদে রয়েছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা আসলে এখানে শুধু 'ঢাল নাই তলোয়ার নাই, নিধিরাম সর্দার' হয়ে আছেন!
এমনকি র্যাবের গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান বরাবরই সশস্ত্র বাহিনী থেকে নিয়োগ পাচ্ছেন। গণমাধ্যম ও আইন শাখার পরিচালকও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য।
কথা উঠতে পারে যে, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এসব কাজ করলে সমস্যা কোথায়?
সমস্যা হল, তারা প্রচলিত আইন-কানুন সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন না। একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক করতে হলে যিনি আটক করবেন তার নিজের পেনাল কোড, ফৌজদারি কার্যবিধি ও পুলিশ রেগুলেশন সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা থাকতে হবে। অভিযুক্তকে ধরার কর্তৃত্ব তার আছে কিনা, থাকলে কোন আইনে তাকে ধরা হবে, কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে– এসব বিষয়ে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। তাই প্রায়ই দেখা যায় যে, তারা ভুল করে ফেলছেন।
তাছাড়া পুলিশ বিভাগের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় কার্যত তাদের কেউ কেউ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠেন– যে কারণে চট্রগামে দরবারের সোনা লুট বা নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মতো অভিযোগের দায় তাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
র্যাবকে এসব অভিযোগ থেকে মুক্ত করতে হলে অবশ্যই বাহিনীটির সংস্কার করতে হবে। মনে রাখা দরকার, পুলিশের কাজ সেনাবাহিনী দিয়ে হবে না। কিন্তু সরকার কি এটা মনে রাখবে? এই দেশে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে সামরিক সরকারগুলো রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা শুরু করেছে পঁচাত্তরের পর থেকেই। আর সেটা করেছে তাদের অস্তিত্বের স্বার্থে। রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারে এসে সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে।
বর্তমান বাস্তবতায় র্যাবকে কি সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত করা সম্ভব? আমরা মনে করি, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অবশ্যই তা হতে পারে। সে সঙ্গে এটিও মনে রাখতে হবে যে, শুধু র্যাবের সংস্কার স্থায়ী সমাধান আনবে না। পুলিশের দক্ষতা না বাড়ালে বা তাদের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা না দিলে সমস্যা রয়েই যাবে। পাশাপাশি, পুলিশের নৈতিক মনোবলও বাড়াতে হবে।
এসব কাজের সঙ্গে জরুরি আরও কিছু কাজ রয়ে গেছে। বিচার বিভাগকে রাজনীতির উর্ধ্বে রেখে, বিচারিক আদালতের শক্তি বাড়াতে হবে। সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দান অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। বিচারের মাধ্যমে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব।
জায়েদুল আহসান পিন্টু: সাংবাদিক ও গবেষক।