Published : 27 Apr 2008, 02:06 PM
১৭৬৫ সাল | ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে বছর মোঘল সম্রাট-এর কাছ থেকে বাংলা বিহার উড়িষ্যা তথা সুবে বাংলার দেওয়ানী অধিকার গ্রহণ করে, সে বছরটিকে আমরা এখনো স্মরণ করি একটি পরাজয়ের বছর হিসাবে। এই বছর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজস্ব আদায়ের অধিকার জমিদারদের কাছ থেকে নিয়ে, দিয়ে দেয়া হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে| ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুঁজি পুঞ্জিভূত করার একটি কৌশল হিসাবে জোর দিতে থাকে রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে | যেহেতু ওই সময় ভূমি রাজস্ব ছিল সরকারী আয়ের প্রধান উৎস, প্রথম পরিবর্তনটি আসে লর্ড কর্নওয়ালিশের ১৭৯৩ সনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার মধ্য দিয়ে। যেই কৃষকেরা আবহমান কাল ধরে ছিল জমির প্রকৃত মালিক, সেই কৃষকেরা এই নতুন বন্দোবস্তের কারণে তাদের চিরকালের অধিকার হারায়। জমির সামাজিক বা গোষ্ঠী মালিকানা বিলুপ্ত হয়ে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা কায়েম হয়| জমি পরিণত হয় পণ্যে।
আজকের অর্থনৈতিক অবকাঠামো বিশ্লেষণে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কেন প্রাসঙ্গিক? এটা কি শুধুই কৃষকদের অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার মধ্যেই সীমিত ছিল? পুঁজিপতিদের পুঁজি সরবরাহ নিশ্চিত করার মধ্যে দিয়ে এই বন্দোবস্ত তো আসলে গণতান্ত্রিক চর্চাকেই সীমিত করেছিল | একবিংশ শতাব্দীতে আমরা ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমি দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি | সেই সময় থেকে প্রায় আড়াই শ' বছর পরে আমরা আজকে জমির মত আমাদের মৌলিক অধিকারগুলোকেও পণ্য হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি| গনতন্ত্র চর্চার সাথে এই পণ্য হয়ে যাওয়ার বিষয়টি এখনো আমরা ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছি না | একবার অগণতান্ত্রিক চর্চাকে দোষারোপ করি, তো আরেকবার অশিক্ষাকে | আমরা যেন এক জটিল ধুম্রজালে পাক খাচ্ছি প্রতিনিয়ত | গনতন্ত্র গনতন্ত্র বলে গলা শুকিয়ে ফেলছি কিন্তু ভেবে দেখছি না গণতান্ত্রিক চর্চা আসলে ঠিক কোথায় বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে |
আমাদের এই আধুনিক অর্থনৈতিক কাঠামো তথা মুক্তবাজার অর্থনীতি কি গণতন্ত্রের পথে অন্তরায়? এ জন্য আমাদের যেতে হবে ৩০ বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৮০ সনে | একদিকে যুক্তরাষ্ট্রে রিগান, অন্য দিকে যুক্তরাজ্যে থ্যাচার গ্রহণ করলেন উদারীকরণ নীতি – বেসরকারিকরণ, বানিজ্য উদারীকরণ, পুঁজিবাজার উদারীকরণ, ও সেবাখাত উদারীকরণ | নব্য উদারতাবাদ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের গন্ডি পেরিয়ে হয়ে গেল বিশ্বের নীতি | যুক্তি একটাই, বানিজ্যিকমুখী না করা হলে সেবাখাতের উন্নয়ন সম্ভব নয় | বিশ্ব ব্যাংকই বা কেন ঋণ দেবে যদি উন্নয়নশীল দেশগুলি ঋণ পরিশোধ করতে না পারে | উদারতাবাদের পক্ষে যুক্তিগুলো আমাদের মগজ ও মননকে আচ্ছন্ন করে ফেলল| যেই রাষ্ট্র নাগরিককে সুবিধা দেয়ার জন্য রাজস্ব আয় বাড়াতে চায় সেই রাষ্ট্রকে সামাজিক সুবিধা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমিয়ে নাগরিককে এইসব সুবিধা দিতে প্রেস্ক্রিপশন দেয়া হল | প্রত্যেকটি প্রেসক্রিপশনই ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে যৌক্তিক | ঠিক এরকমই যৌক্তিক মনে হয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রস্তাব মোঘল সম্রাটের কাছে | একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় রাষ্ট্র আবার আড়াই শ' বছর আগে যেভাবে জমির অধিকার কৃষকের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে, দিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে, ঠিক সেভাবেই আবার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি, বিদ্যুত, পরিবহন সব কিছুকে ব্যবসার পণ্য করে দিয়ে দিচ্ছে পুঁজিপতিদের দখলে | এর প্রমান মেলে বিশ্বব্যান্ক ও IMF-এর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি, বিদ্যুত, ও পরিবহন সংক্রান্ত কৌশল পত্রগুলিতে |
এবার আসা যাক গণতন্ত্র প্রসঙ্গে | নব্য উদারিকরনের সাথে গণতন্ত্র চর্চার কী সম্পর্ক? আমরা গণতন্ত্র চর্চা বলতে কীসের গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তিত? এটা কি শুধুই জাতীয় নির্বাচন? নাকি এই গণতন্ত্র সার্বিক অর্থে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা? যদি বলি দুইই, তাহলে আমরা আসলে ঠিক কোথায় আছি? আমাদের গণতান্ত্রিক সরকার তাহলে কেন বারবার ব্যর্থ হচ্ছে নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার পূরণ করতে? এই প্রশ্নের উত্তরটা খুব সহজ | উত্তরটি হচ্ছে নব্য উদারীকরণ নীতির সাথে গণতন্ত্রের সম্পর্কটি নদী ও কুলের সম্পর্কের মত | অর্থাৎ নদী বাড়লে কুল ভাঙবে, আর কুল প্রশস্ত হলে নদী সংকুচিত হবে |
বেসরকারিকরণ করতে যেয়ে যখন মুনাফা মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে পরে তখন আমাদের শিল্প শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা হয়ে দাড়ায় গৌন | পুঁজিপতির স্বার্থতাড়িত উন্নয়ন ধারণাকে তখন মহাসমারোহে জনপ্রিয় করে তোলা হয় | নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী সরকার যখন উদার উন্নয়ন ধারণার পক্ষে দাড়াতে বাধ্য হয় তখন পাট শ্রমিক, গার্মেন্ট শ্রমিক, চিংড়ি শ্রমিক, সেবাখাতে নিয়োজিত শ্রমিক হারাতে থাকে অধিকার | লুপ্ত হয় প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা | দুর্বল হয় শ্রমিক ইউনিয়ন | আমাদের ভাবতে শেখানো হয় পানি, বিদ্যুত, গ্যাস, গণপরিবহনের মত নিত্য প্রয়োজনীয় সেবাখাতগুলি কলা, সবজি, আনারস, আপেল থেকে ভিন্ন কিছু নয় | কাজেই এই সব ব্যবসায় লাভ করতে হবে | শুধু তাই নয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মত মৌলিক অধিকারগুলিকেও পণ্য হিসাবে বিবেচনা করতে হবে | এই সব খাতে বরাদ্দ বাজেট কমাতে হবে অথবা কঠোর নীতির মাধ্যমে সরকারী অর্থ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে | দুর্ভাগ্যবশত এত কিছুর পরও গণতান্ত্রিক সরকার ব্যর্থ হচ্ছে অঙ্গীকার পূরণে, ব্যর্থ হচ্ছে গণতন্ত্র।
বিশ্বায়নের যুগে আমাদের শ্রমিক ইউনিয়নগুলো নামে মাত্র বানিজ্যিকিকরণের বিপক্ষে কথা বলে যাচ্ছেন কিন্তু ঠেকাতে পারছেন না বিশ্বায়নের বৈরী হওয়া | আমাদের রেইলওয়ে, টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুত, পানিসহ সমস্ত সেবাখাত এখন দ্রুত বানিজ্যিকীকরণ প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে | সেবাখাতগুলিকে পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে মুনাফাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে | যুক্তি একটাই, মুনাফা না করলে ব্যবসা টিকবে কী করে | এই সব কিছুই ঘটছে আমাদের জনগনের নির্লিপ্ততার মধ্যে দিয়ে | যেন এটাই স্বাভাবিক, যেন "পানি নাই", "বিদ্যুত নাই", "বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি" এই সব কিছুই সয়ে গেছে | যেন আমরা আমাদের জীবিকা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে গেছি যে নাগরিক হিসাবে আমাদের রাষ্ট্রের কাছে যেই সেবা প্রাপ্য সেটা নিয়ে ভাবনাকেও আমরা আর সময় দিতে প্রস্তুত নই |
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার নির্বাচন করে আমরা যেন সব দায়িত্ব সরকারের হাতে দিয়ে সুখনিদ্রায় আছি | কিন্তু এটা কি গণতন্ত্র চর্চা? কুইক রেন্টাল এর মাধ্যমে বিভিন্ন বিনিয়োগকারীদের যেই বানিজ্যিক সুবিধা দেয়া হচ্ছে আমরা কি খতিয়ে দেখছি এর ভবিষ্যত কী? সরকার কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে এই বিদ্যুতের বাজার? নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে বিদ্যুতের ক্রাইসিসের মুখে যেভাবে সরকার কুইক রেন্টাল প্ল্যান্ট নিয়ন্ত্রণ করছে সেখানে কতটুকু স্বচ্ছতা আছে সেটা নিয়ে আমাদের জনগনের সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন | প্রয়োজন এই বানিজ্যিকিকরণের পরিনামে চড়া বিদ্যুতের দাম নিয়ন্ত্রণ করার সুষ্ঠু পরিকল্পনা | নাহলে বুঝতে হবে আমরা এখনো ১৭৬৫ সালেই আছি| অথবা আরো পিছিয়ে আছি | আমরা যদি জটিল বিদ্যুত সমস্যার মুখোমুখি হয়ে বুঝতে না পাড়ি যে আমাদের সেবা খাত কাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তাহলে বুঝতে হবে আমরা জনগণ হিসাবে আমাদের গনতন্ত্র চর্চা ও আমাদের অধিকারগুলিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতই চিরকালের জন্য বিক্রি করতে বসেছি |
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার নির্বাচিত হচ্ছে কিন্তু নব্য উদারীকরণ নীতি তার স্থানেই আছে | বিভক্ত হয়েছে পিডিবি, বিভক্ত হয়েছে বিটিসিএল, বিভক্ত হয়েছে বেশির ভাগ সেবা খাত | সেবাখাত উন্নয়নের নামে পিডিবিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে, টি এন্ড টিকে ভাগ করা হয়েছে তিন ভাগে | আর তার সাথে সাথে বিভক্ত হয়েছে ট্রেড ইউনিয়নও | যেই ট্রেড ইউনিয়নের কথা ছিল প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চাকে নিশ্চিত করা তারা দিন দিন কোনঠাসা হয়ে পড়ছে | নব্য উদারীকরণ নীতির জয় সুনিশ্চিত হচ্ছে আর আমরা কাঁদছি গণতন্ত্রের মরা কান্না | সরকারী ও বেসরকারী সহযোগিতাকে বা পিপিপিকে উত্সাহিত করার জন্য শুরু হয়েছে নানবিধ পরিকল্পনা | যদিও বলা হচ্ছে এই সব পদ্ধতিতে থাকবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, কিন্তু তা কতটুকু বাস্তবে মেনে চলছে সরকার? এই দুর্মূল্যের দিনে যারা নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের সেবাখাত, তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করবে কে? এগিয়ে আসতে হবে জনগনকেই |