যে দিকে চোখ রাখবেন খালি ভাঙ্গা আর ভাঙ্গা । পথ ভাঙ্গছে রাজনীতি ভাঙ্গছে সমাজ ভাঙ্গছে। এমন কি যে ঐক্য গড়ে স্বৈরাচার হটানো হলো, তাও নাকি ভাঙ্গতে শুরু করেছে।
Published : 05 Oct 2024, 05:23 PM
‘খেলা ভাঙ্গার খেলা খেলবি আয়’– রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী। কী বলতে চেয়েছিলেন তিনি? খেলা ভেঙ্গে দেওয়ার খেলা খেলার ডাক না খেলা ভাঙ্গা রোধের খেলা। সে জানিনা তবে ভাঙ্গা ভাঙ্গি বেশ ভালোই চলছে। না ভাববেন না আমি খালি মূর্তি ভাঙ্গার গল্প বলছি। ওটা এখন গা সওয়া ব্যাপার। সামাজিক মিডিয়ায় কারা যেন উপদেশ দিচ্ছেন সামনের বার থেকে দু সেট করে প্রতিমা বানাতে । এক সেট যখন ভাঙ্গবেই নিশ্চিত বাকি সেট দিয়ে পূজা হবে । মন্দ নয় পরামর্শ। এই ভাঙ্গার পাশাপাশি চলছে আরো অনেক ভাঙ্গাভাঙ্গি।
মন ভাঙ্গার কথাই বলি। সাকিব আল হাসান তো একজনই হয় বলে জানি। কেমন করে বলি, সাকিবের দলটি যখন খেলতে মাঠে নামে, তখন বলা হয় সাকিবরা খেলতে নেমেছে। আমি যে শহরে, যে দেশটিতে বাস করি, সেই সিডনি বা অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিকেট দারুণ জনপ্রিয় খেলা। যদিও তার জায়গা তিনে । তার আগে আছে এএফএল, রাগবি এসব । এই খেলা মানে ক্রিকেট ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশের মানুষদের জন্য কবে যে নাম্বার ওয়ান হয়ে গেছে বলা যায় না। এই নাম্বার ওয়ান হবার খেলাটিতে বাংলাদেশের এগারজনের নামই সাকিব আল হাসান। কেন এমনটা বললাম, এরই মধ্যে বলেছি। অনেক সাদা কালো মানুষদের বলতে শুনেছি সাকিবরা খেলছে বা খেলবে। সাকিব দেশে এখন অভিযুক্ত একজন মানুষ, অন্তত বিচার না হ ওয়া পর্যন্ত। যেন-তেন না গুরুতর অপরাধের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। যে কারণে তার মাদার বা ক্রিকেট বোর্ডও তাকে নিরাপত্তা দিতে পারবে না বলে দিয়েছে। এই সাকিব আল হাসান উপমহাদেশে জনপ্রিয় ক্রিকেটার হলেও তাকে এখন আমেরিকায় যেতে হয়েছে। আর কবে কখন খেলবে কে জানে? এই কারণে মন ভাঙ্গা বাঙালির সংখ্যা কম নয়। খুশিও হয়েছে কেউ কেউ।
তা ছাড়া কার পোশাক কেমন হবে কি ধরণের কাপড় পরবে নারী হলে কিভাবে চলবে এটা নিয়েও চলছে ভাঙ্গা । এক নারীর গাড়ির কাচে থু থু দিতে থাকা মানুষটিকে দেখে অবাক লাগছিল। ভদ্রলোক ভালো করে চোখে দেখেন কি না কে জানে। তারপর ওই গাড়ির ভেতর বসে থাকা নারীর পোশাক তার ভালো লাগেনি। তাকে উপদেশ দিতে দিতে একসময় কাচে থু থু আর এমন সব গালাগালি দিয়েছে যে সে নারীতো বটেই তাবৎ নারীদের মন ভাঙ্গা কাচের মতো টুকরো হবার পথে।
যে দিকে চোখ রাখবেন খালি ভাঙ্গা আর ভাঙ্গা । পথ ভাঙ্গছে রাজনীতি ভাঙ্গছে সমাজ ভাঙ্গছে। এমন কি যে ঐক্য গড়ে স্বৈরাচার হটানো হলো, তাও নাকি ভাঙ্গতে শুরু করেছে। অথচ আমরা আশা করেছিলাম এবার ভাঙ্গার বিপরীতে গড়ার কিছু হবেই। সে স্বপ্ন যদি ভাঙ্গে তো উপায়?
কথা হচ্ছে এসব বন্ধে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে ? গুজবের মুখে তালা লাগাবে কে? কোথায় আমাদের সেই সব স্বপ্নবাজ? শেষে যেন ঠগ বাছতে গাঁ তথা দেশ উজাড় না হয়ে যায় ।
এ বিষয়ে সৌভিকের গল্পটি দারুণ:
রাজা মশাইয়ের কাছে খবর আছে, কারা যেন বেশি বেশি খায়। রাজা মশায় পাত্র-মিত্র-সভাসদ আদি সক্কলরে ডাকেন আর প্রশ্ন করেন– তোমরা জানো কে কে বেশি খায়? পাত্র-মিত্র-সভাসদ আদি কেউ বলল, হ্যাঁ, কেউ বলল, না। রাজা বললেন, তা তোমরা তাদের আটকাতে পারো না? সব্বাই সাথে সাথে রে রে করে চীৎকার করে উঠে বলল, পারি না...পারি না...পারি না...
রাজার ভুরু কুঁচকালো...বললেন কেন পারো না? সব্বাই আবার হাউমাউ করে উঠে বলল, ওরা নিতান্তই চালাক, দুষ্ট, কূটকৌশলী মহারাজ! আর আমরা নিতান্তই সাদাসিধা, সরল, সৎ চিন্তক, ওদের গুপ্ত গতিবিধির খবর রাখি এমন চতুরতা কি আমাদের সাজে?!
রাজা আবার ভুরু কুঁচকালেন, জিভ কামড়ালেন, বললেন, তবে উপায়?
সব্বাই এ ওর মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগল, সত্যিই তো উপায় কি হবে? আরে চোরে চুরি করবে, ডাকাতে ডাকাতি করবে, ঠগবাজ লোক ঠকাবে, ঘুষখোর ঘুষ খাবে, কালোবাজারী দুনম্বরি করবে...এই তো চিরটাকাল শুনে আসছি...এর আবার কোন উপায় হয় নাকি?...না হতে হয়?!
তবু সভা বসল। রাতারাতি ঠিক হয়ে গেল উপায়। মধ্যরাত্রে ঘোষণা হল...
শোনো শোনো শোনো নগরবাসী...এখন থেকে তোমরা দুদিন আহারাদি করবে না...আর পঞ্চাশদিন অর্ধাহারে থাকবে...তা হলেই যারা বেশি খেয়ে শরীরে বেশি মেদ জমিয়েছে তারা পটপট করে ধরা পড়ে যাবে...
নগরে হুলুস্থুল পড়ে গেল। রাজা বলে কি? যারা বেশি খেয়ে মেদ জমিয়েছে তারা না হয় ধরা পড়ে গেল...যারা খায়নি! হ্যাঁ গো তারা তো দুর্বল হয়ে শয্যা নেবে! আর যারা এমনিতেই খেতে পায় না...তারা তো মৃত্যু শয্যা নেবে গো!
নগরে ছিল কিছু অনেক উঁচুতে বসা জ্ঞানীর দল, যারা সব নগরেই থাকে সব সময়। যাদের পায়ে ধুলোবালি লাগে না। আর তারা এত উঁচুতে থাকে বলে এত দূরের জিনিস দেখতে পায় যা ইতর সাধারণ লোকে দেখতে পায় না।
তো তারা চোখ রাঙিয়ে, মাথায় ঘাড়ে হাত বুলিয়ে বলল, বাছারা ত্যাগ কর। সাহসের সাথে দাঁড়াও রাজার পাশে। বেশি খাওয়া লোকগুলোকে বের করতে দাও...
তখন এক পাগলা অঙ্কের মাস্টার ক্ষেপে গিয়ে বলল, ক্যানো রে পোড়ারমুখো, হাড় হাভাতের দল...আমরা প্রত্যেক মাসে কর দিই না...যাতে করে দেশের সুরক্ষা, আইন, তদন্ত, গোয়েন্দা, শুল্ক ইত্যাদি বিভাগের লোকেরা মাইনে পেয়ে তাদের কাজগুলো ঠিকঠাক করতে পারে? তাতো তোরা পারলি না...এখন নিজেদের সেই ব্যর্থতার বোঝা আমাদের ঘাড়ে চাপাতে চাস কেন?
তা সেই অঙ্কের মাস্টারের কথা কে আর শুনবে? কেউ শুনল না। না জনতা, না জননেতা। নগরে তখন প্রচণ্ড হুলস্থূল বেধে গেছে। সব্বাই বলছে আজ যতটা পারিস খেয়ে নে রে...খেয়ে নে...খেয়ে নে...খেয়ে নে...
শুধু নগরের মূর্খ, দরিদ্রলোকগুলো কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে এর-ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, এরা ছুটলে ওরাও ছুটছে, এরা থামলে ওরাও থামছে...আর মাঝে মাঝেই একে তাকে প্রশ্ন করছে...কই যামু কত্তা...কি খামু কত্তা...কদ্দিনের নিষেধ কত্তা...সব আনাজ ফেলে দিমু...
কেউ শুনছে না...সবাই বলছে সব কালো সাদা হবে...ঘরে আরো ধন হবে...
নিন্দুকেরা বলছে ভোটে ভোটে আর দিন গোনো না...দুর্বৃত্তের ছলের অভাব হয় না...
বলল, এরেই নাকি বলে, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়...
আমরা ভাঙ্গাভাঙ্গি চাই না। আস্ত পুরা একটি সমাজ চাই। চাই আমাদের চমৎকার স্বদেশ। স্বদেশ ভালো না থাকলে কেউ ভালো থাকে না । কেউ বাঁচলেও বাঁচতে পারে না।