Published : 19 Oct 2013, 01:21 PM
প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণ শেষ না হতেই আমার এক সাংবাদিক বন্ধু ফোন করলেন রংপুর থেকে। ফোনের শুরুতেই বললেন, প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণে তাঁর ছোট ভাই রাসেলের হত্যার প্রসঙ্গটি টানলেন কেন? আমি বললাম, এটা টানতেই পারেন।
আজ যে ওর জন্মদিন। জন্মদিনে ভাইয়ের কথা মনে পড়বে বোনের এটাই তো স্বাভাবিক নয় কি? তাও আবার সব থেকে ছোট ভাইটি বড় বোনের। যাকে একাত্তরের পরাজিত শক্তির শক্তিতে বলীয়ান কাপুরুষোচিত অন্ধকার কায়েমী এক স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছিল মুক্ত বাংলাদেশের মাত্র চার বছরের মাথায়। শুধু কি তাই, সেই হত্যাকাণ্ড নির্মমভাবে খুন করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের অনন্য এক রাজনৈতিক উচ্চতাকে।
যাহোক, আমার বন্ধুর দ্বিতীয় বাক্যটি ছিল, 'কী বুঝলেন ভাষণে?' তৎক্ষণাৎ আমি বললাম, এ তো পুরনো কথা, এতে নতুন আর কী? কেননা এমনতর কথা তো ময়দানের সভা-সমাবেশে, আলোচনায়-সেমিনারে, সরকার ও দেশ নিয়ে যারা ভাবেন তাদের দিক থেকে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে হলেও এসেছে অনেকবার।
তবে কিনা বলতেই হয়, দেশের প্রধান নির্বাহী হিসেবে এই প্রথম জাতির কাছে দেওয়া ভাষণে সংকট সমাধানে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়ে সংকট স্বীকার করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি হয়তো এর আগে ঠিক এমনটা না বললেও এর কাছাকাছি প্রস্তাবনা দিয়েছেন বিরোধী দলের প্রতি।
তাই বলছি, প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণে নতুনত্ব আছে বৈকি। আর সেই নতুনত্ব হচ্ছে তার গোটা ভাষণটিতেই রয়েছে 'পজেটিভিটি'। যা নির্বাচনী সরকার কাঠামো নিয়ে দেশের দুই রাজনৈতিক দলের সৃষ্ট সংকট সমাধানের পথে অনেকটাই এগিয়ে দিল দেশকে।
বিশ মিনিট ধরে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণকে আমি দেখছি অবশ্যই পুঁজিতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রেক্ষিত থেকেই। কেননা আমি কোনোভাবেই আওয়ামী লীগকে সর্বতোভাবে জনগণের নিরঙ্কুশ স্বার্থরক্ষাকারী দল মনে করি না।
যদিও এই দলটির নেতৃত্বে বদ্বীপ আকৃতির পাললিক এই ভূখণ্ডের মানুষ পেয়েছে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র। পেয়েছে লাল রক্তে কেনা সবুজ ঘাসে ঋদ্ধ একটি পতাকা। যার জমিনে মাথা রেখে দু'দণ্ড শান্তিতে ঘুমোতে চায় এদেশের সাধারণ মানুষ।
বলবেন শুধুই সাধারণ মানুষ কেন, যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়েছেন সেই ধনীক গোষ্ঠী নয় কেন? তার সোজা উত্তর হচ্ছে, তারা তো এদেশে লাল-সবুজের জমিনে মাথা রাখতে চান না। তারা শুধু এদেশের মানুষের রক্তে, শ্রমে আর ঘামের বিনিময়ে সৃষ্ট মুনাফা নিয়ে উড়াল দিতে চান বিদেশি কোনো মাটিতে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেছেন, আর নয় এক-এগারোর ধারক তত্বাবধায়ক সরকার নামের যন্ত্রণাকর অধ্যায়। যার শিকার হয়েছিল দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ। তিনি অবশ্যই বিশেষ সেই তত্বাবধায়ক সরকারের আগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের 'জনবিরোধী' কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি।
তিনি এও বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের 'অপকর্মে'র ফলেই এক-এগারোর জন্ম হয়েছিল। একথা তো সত্যি যে, সে সময়টাতে সরকারের ভেতরের আরেক সরকার হয়ে উঠেছিল 'হাওয়া ভবন' খ্যাত একটি গোষ্ঠী। কায়েমী সেই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে ছিলেন বিএনপির বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান ও এদেশের তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে জোট সরকার ও তত্বাবধায়ক সরকারের কাজকর্মের নিন্দায় ঝড় তুললেও নিজের সরকারের এবং সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় সংঘটিত কোনো একটি 'অপ-কাজের' জন্য 'সরি' হননি জনগণের কাছে।
শেয়ারবাজারে বেপরোয়া ধনিক শ্রেণির লুটপাটের শিকার হয়ে যখন দেশের স্বল্পপুঁজির লাখো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হন, তখন সরকারের মন্ত্রিসভার সর্বজ্যেষ্ঠ মন্ত্রী তাকে বলেন 'রাবিশ'। আর তাতে তো সেই মানুষগুলোকেই অপমান করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তো সরকারের এই শেষ সময়ে এসে পারলেও পারতেন না কি তাদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইতে।
রাজধানী ঢাকার দর্জিশ্রমিক বিশ্বজিৎকে দিনের আলোয় সাধারণের সামনে কুপিয়ে হত্যা করেছিল প্রধানমন্ত্রীর অভিভাবকত্বে পরিচালিত সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীরা। দেশের প্রচলিত আইনেই সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার চলছে সেকথা ঠিক।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তো পারতেন বিশেষ আদালতে সেই হত্যার দ্রুত বিচার করিয়ে দলের প্রতি নয়, বরং জনগণের প্রতি তার দায়বদ্ধতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। তাই বলছি, আজকে তার ভাষণে সেই সুযোগও ছিল বিশ্বজিতের বাবা-মা তথা দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইবার।
আজকে প্রধানমন্ত্রী তো বলতে পারতেন, রামপাল নয়, বরং দেশের পূর্বাঞ্চলের কোনো এক স্থানে ভারত-বাংলা বিদ্যুত কেন্দ্র করা হবে। যে বিদ্যুত কেন্দ্র করা হলে– একেবারে সাদা চোখে বলা যায়– ধ্বংস হয়ে যাবে প্রকৃতিসৃষ্ট রক্ষাকবচ সুন্দরবন। বাস্তুচ্যুত হবেন হাজারও মানুষ।
শুক্রবার সন্ধ্যায় দেওয়া ভাষণে এমন আরও অনেক কিছুতেই জনগণের কাছে দায়মুক্ত হতে পারতেন প্রধানমন্ত্রী। আর এমনিতর দায়মুক্ত হওয়ার ঔদার্যে সাধারণের কাছে প্রধানমন্ত্রী, তার দল আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ত বৈ কমত না। আর প্রধানমন্ত্রী নিজে আসীন হতেন অনন্য এক উচ্চতায়।
তবে হ্যাঁ, প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণে দেশের মানুষের বিশেষ একটি চাওয়া ছিল। আর তা হচ্ছে সার্বিকভাবে সংকটগ্রস্ত শাসকশ্রেণির ক্ষমতায় যাওয়ার পথ বিনির্মাণের সংকট সমাধানের উপায় সম্পর্কে পথনির্দেশনা। যে নির্দেশনার পরিক্রমায় কিছুটা হলেও এগিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে। আর এটাই ছিল জনসাধারণের একান্ত কাম্য।
কেননা রাষ্ট্রের যিনি স্টিয়ারিং সিটে বসে আছেন, তাও আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের 'অনুমতি' নিয়ে, তাকেই তো এগিয়ে আসতে হবে। আর এবারেও সেটাই করলেন প্রধানমন্ত্রী। যা তার প্রাজ্ঞতারই পরিচয় বহন করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনের সময়ে সরকারের যে মন্ত্রিসভা রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিচালনা করবেন তা হবে 'সর্বদলীয়'। আর সেই মন্ত্রিসভার অংশ হতে বিরোধী দলের প্রতি তাদের সংসদ সদস্যদের নাম দেওয়ারও অনুরোধ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেছেন,"আমরা সকল দলকে সঙ্গে নিয়েই জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চাই। বিরোধী দলের কাছে আমার প্রস্তাব, নির্বাচনকালীন সময়ে আমরা সকল দলের সমন্বয়ে সরকার গঠন করতে পারি। আমাদের লক্ষ্য অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন। শান্তিপুর্ণ নির্বাচন।''
এ বিষয়ে বিরোধী দলের কাছে পরামর্শও চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সরকার প্রধান এ-ও বলেছেন, "বিরোধী দলের নেতাকে অনুরোধ করছি যে, তিনি আমার এই ডাকে সাড়া দিবেন। আমার এ অনুরোধ তিনি রক্ষা করবেন এবং আমাদের যে সদিচ্ছা সেই সদিচ্ছার মূল্য তিনি দেবেন।"
প্রিয় পাঠক, আমার মনে হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে নির্বাচন সময়ের সরকারে অংশ নিতে বিরোধী দলের প্রতি শুধু আহ্বানই জানাননি, তিনি এই সরকার কীভাবে হবে সে বিষয়েও পরামর্শ করতে চেয়েছেন বিরোধী দলের সঙ্গে।
নব্বই দিনের মধ্যে যাতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেজন্য সকল দলের সঙ্গে, বিশেষ করে মহাজোটের সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতিকে যথাসময়ে লিখিত পরামর্শ দেওয়ার কথা জানিয়ে সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা বলেন, ''এ ক্ষেত্রে আমি বিরোধী দলের কাছেও পরামর্শ আশা করি।''
আবার তিনি তার সবশেষ এই অবস্থানকে স্বাগত জানাতে অনুরোধও করেছেন। একবার নয় এই অনুরোধ তিনি করেছেন দু-দুবার। বিরোধী দলের প্রতি তার এমনিতর 'আহ্বান' ও 'অনুরোধ' কে তার ও তার দলের 'সদিচ্ছা' বলে অভিহিতও করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
সরকার প্রধানের এই ভাষণে আরেকটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে আমার কাছে। আর তা হল গিয়ে, সংকট বলে যে কিছু একটা দেশের মানুষের ওপর চেপে বসেছে তা তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন। আর সেই সংকটের দায় কিছুটা হলেও নিজেদের কাঁধেও নিয়েছেন। তাই তো তিনি সংকট সমাধানে পথ বের করবার শুরুটা করলেন বিরোধীদের প্রতি 'আহ্বান', 'অনুরোধ', 'সদিচ্ছা' এবং বিশেষ আরেকটি শব্দ 'পরামর্শ' ব্যবহার করবার মধ্য দিয়ে।
আর 'পরামর্শ' অভিধার এই শব্দটিই হয়তো দরকষাকষির বাকিটা। যা প্রধানমন্ত্রী রেখে দিয়েছেন আলোচনার টেবিলের জন্য। আমি আমার রংপুর থেকে করা বন্ধুর ফোনের জবাবে তেমনটাই বলেছি। কেননা প্রস্তাবনার সবটাই যদি শুরুতেই বলে দেন একটি পক্ষ, তাও আবার স্টিয়ারিং সিটে বসে, তাহলে তো আর দরকষাকষির টেবিলের জন্য অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
তাই সেই 'অবশিষ্ট' বাস্তবায়ন করতে প্রধানমন্ত্রীর এই এগিয়ে যাওয়াকে অবশ্যই স্বাগত জানাবে বিরোধী দল। কেননা সংকট নিরসনে এটাও হতে পারে জনগণের কাছে বিরাট এক পাওয়া। যাদের ভোট সমর্থনের কল্যাণে প্রতি পাঁচ বছরের জন্য 'পাওয়ার-প্রিভিলেজ' এনজয় করেন দেশের দুই প্রধান বিরোধী দল ও তাদের মিত্ররা।
তাই বলছি এই আমরা তথা আমজনতাকে কেন শুধু কষ্ট দেওয়া? কোন অপরাধ করেছে তারা? সে কি এদেশে জন্ম নিয়ে, না কি আপনাদের মতো রাজনীতিকদের জনপ্রতিনিধি করবার এখতিয়ার নিয়ে?
সেলিম খান : সংবাদকর্মী।