সম্প্রতি ঢাকা বোর্ডের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় এক সৃজনশীল প্রশ্নে অভূতপূর্ব এক উদ্দীপক ব্যবহৃত হয়েছে। বড় ভাই গোপালের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধের এক পর্যায়ে ছোটভাই নেপাল পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটার অংশবিশেষ আবদুলের কাছে বিক্রি করে দেয়। মুসলমান আবদুল সেখানে নিজের ঘর তুলে বসবাস শুরু করার পর গরু কোরবানি দিলে মনের দুঃখে নেপাল ভারতে চলে যায়।
চট্টগ্রামে একটি প্রবাদ আছে: ‘গোয়াল্যা গাথা খোঁড়ে পড়ি মইত্ত গাই। হেই গাতাত পড়ি মরে গোয়াইল্যার ভাই।’ অর্থাৎ ‘গোপাল পরের গাইগরুকে আছাড় খাইয়ে মারার জন্য গর্ত খুঁড়েছিল। সেই গর্তে পড়ে মরেছে গোপালের নিজেরই ভাই।’ উদ্দীপকের গল্পেও গোপালের ভাই গর্তে পড়েছে, তবে গোপালের নয়, নিজেরই খনন করা গর্তে সে নিজেই পড়েছে।
প্রশ্নকারীর উদ্দেশ্য ছিল, পরীক্ষার্থীরা নেপালের সঙ্গে পলাশির যুদ্ধের বিশ্বাসঘাতক ভিলেন মীর জাফরের মিল খুঁজে পাবে। নবাব সিরাজদৌলার নিকটাত্মীয় মীর জাফর নবাবের প্রতি অসূয়াবশত ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। এর ফলে লাভের চেয়ে মীরজাফরের ক্ষতিই বেশি হয়েছিল। ‘মীরজাফর’ নামটিকে বাংলার ইতিহাস এমনভাবে অবমূল্যায়ন করেছে যে সন্তানের ‘জাফর’ নাম রাখার আগে যে কোনো মীর বাড়ির লোক দু বার ভাববে।
অনেকে বলছেন, উপরোক্ত প্রশ্নে সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করা হয়েছে। দেখা যাক, এই দাবি কতটা সত্য। উদ্দীপকে কমপক্ষে চারটি ঘটনার ঘনঘটা হয়েছে: ১.নেপালের সঙ্গে গোপালের ঝগড়া, ২. মুসলমান আবদুলের কাছে নেপালের জমি বিক্রি, ৩. আবদুলের গরু কোরবানি দেওয়া, এবং ৪. বাংলাদেশ ছেড়ে নেপালের ভারতে চলে যাওয়া। দুই হিন্দু ভাইয়ের ঝগড়া প্রথমেই বাদ। মুসলমানের কাছে জমি বিক্রি বাংলাদেশে অতি স্বাভাবিক ঘটনা। আমার নিজের গ্রামে হিন্দুর শতকরা নিরানব্বই ভাগ জমি মুসলমানেরা কিনে আসছে আমার জন্মেরও আগে থেকে। হিন্দু সাধারণত জমি কিনতে চায় না, কারণ সে ভাবে, ‘আগে-পরে জীবন যেখানে নিরাপদ’ নয়, সেখানে জমি কিনে কী লাভ? অনেক ক্ষেত্রে হিন্দু উপযুক্ত দাম দিতে চায় না, সামর্থের অভাবে, কিংবা এই ভেবে যে দেশ ছেড়ে যাওয়া হিন্দু হয়তো কম দামেও জাত ভাইয়ের কাছে জমি বেঁচতে রাজি হয়ে যাবে।
আবদুল যেহেতু মুসলমান, নিজের ধর্ম সে পালন করবে, সেটাই স্বাভাবিক। গরু কোরবানি দেওয়া কোনো মতেই আবদুলের দিক থেকে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার পরিচায়ক হতে পারে না। আবদুল বা আবদুলরা এমন একটা কিছু করবে জেনেইতো নেপাল কিংবা নেপালরা তার বা তাদের কাছে জমি বিক্রি করে। আবদুল যদি গরু কোরবানি না দেয়, কিংবা (মাইকেল মধুসূদন এবং তার ইয়ং বেঙ্গল বন্ধুদের মতো) গোমাংস খেয়ে তার হাঁড় পাশের ব্রাহ্মণ বাড়ির চালে ছুঁড়ে না মারে, তবে আবদুলের কাছে জমি বিক্রি করা মজাটাইতো মাঠে মারা গেলো! তবে অন্য অনেক হিন্দুর মতো নেপালও হয়তো ভ্রাতৃবধে সমধিক উৎসাহী হয়েও অবলা গো-বধে কষ্ট পায়। আরেকটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে দুষ্ট নেপাল দেশত্যাগ করেছে বটে, শিষ্ট গোপাল কিন্তু দেশেই রয়ে গেছে, গোবধ যদিও তার বাড়ির সামনেও হয়েছে।
‘লড়াইয়ের মাঠে এক জেহাদী ৫ জন কাফেরকে বন্দি করিল, ৩ জন কাফেরকে হত্যা করিল। সব মিলিয়ে মোট কতজন কাফের তাহার হাত হইতে রক্ষা পাইল না?’ বাংলাদেশের ধর্মীয় বিদ্যালয়ে ব্যবহৃত অংক বইয়ে এ ধরনের প্রশ্ন আছে দেখিয়ে এই শিক্ষাব্যবস্থাকে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী কিংবা স্রেফ হাস্যকর প্রমাণ করার অসৎ চেষ্টা করা হয়। এর প্রতিবাদে কিংবা কোনো প্রকার ভারসাম্য আনার জন্য স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় সমজাতীয় প্রশ্ন করে কেউ কি সাধারণ/সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে? অনেকটা যেমন, দাদাও যেহেতু ফেল, আমি ছোটভাই আর কী পাশ করবো!
সত্য বটে, মুসলমান আবদুল এবং ইংরেজকে এই প্রশ্নে ‘খাল কেটে আনা’ কুমির বলা হয়েছে। উদ্দীপকের প্রতিবেশ বা কনটেক্সটে এটা ঠিকই আছে। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার হিন্দু-মুসলমানের পুরুষ ৯৯ দশমিক ৯৯ ভাগ ভারতীয়, তবু এই অঞ্চলের অনেক হিন্দুতো বটেই, অনেক মুসলমানও বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করতে গৌরববোধ করে যে মুসলমানদের পূর্বপুরুষ ইরান-আরব থেকে এসেছে, কাটা খালা দিয়ে না হোক, খাইবার পাস দিয়ে। ইন্দো-ইউরোপীয় বহিরাগমন তত্ত্বে হিন্দুদের অন্যতম পূর্বপুরুষ আর্যরাও এই একই পথে বিদেশ থেকে ভারতবর্ষে এসেছিল বলে দাবি করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে এই উদ্দীপক বা প্রশ্ন সাম্প্রদায়িকতার রসে জারিত, সেটা প্রমাণ করা মুশকিল। তাহলে কী এমন আছে এই প্রশ্নে যে বাংলাদেশের সিংহভাগ বুদ্ধিজীবী প্রশ্নটা পছন্দ করছেন না, স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীকে পর্যন্ত এই প্রশ্নের জন্য দুঃখপ্রকাশ করতে হয়েছে? প্রশ্নটা অনেকেরই গাত্রদাহের কারণ হয়েছে, কারণ এতে কোনো না কোনওভাবে ‘আঁতে ঘা লাগা’ একটি চরম সত্য প্রকাশ পেয়েছে। কী সেই সত্য?
বাংলাদেশের বেশিরভাগ গ্রামে হিন্দু আর মুসলমান যে সাধারণত আলাদা পাড়ায় থাকে, সে কথাটাতো মিথ্যা নয়। শহরে শুনেছি, অনেক মুসলমান বাড়িওয়ালা হিন্দুদের বাড়িভাড়া দিতে চায় না, ভারতেও অনেক হিন্দু যেমন মুসলমানদের বাড়িভাড়া দিতে নারাজ। বাংলাদেশের অন্তত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অদ্যাবধি হিন্দু আর মুসলিম হল আছে। প্রশ্নকর্তার মতে, ভাইকে কষ্ট দিতে গিয়ে বিধর্মী মুসলমানের কাছে ভিটের অংশ বিক্রি করে মহা এক অপরাধ করেছে নেপাল। পাশ্চাত্যে জমির ক্রেতা বা বিক্রেতার ধর্ম কোনো ব্যাপার নয়, অন্ততপক্ষে প্রকাশ্যে নয়। এর মানে হচ্ছে, বাংলাদেশ কিংবা পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় যেখানে এখনও ঠিকমতো জাতিগঠনই হয়নি, সেখানে দস্তুরমতো তিন-তিনটি জাতিরাষ্ট্র। ফরাসি লেখক ও বুদ্ধিজীবী ব্যার্নার অঁরি লেভি এই ঘটনাকে ‘ঘোড়ার আগে গাড়িজোতা’ বলেছেন, যার ফলে ঘোড়া বা গাড়ি কোনোটাই এগোতে পারছে না।
যেকোনো সরকার দেখাতে চায়, দেশে সুনসান, পরম শান্তি বিরাজ করছে। বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণের একাংশ দাবি করে, হিন্দু গোপাল ও মুসলমান আবদুল এক বৃন্তে দুটি ফুল হয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছে। এক আধটু সমস্যা যদি হয়েও থাকে, তবে তার জন্য আবদুল মোটেই দায়ী নয়, প্রকৃত দোষী হচ্ছে কিছু দুষ্ট নেপাল, চুন থেকে পান খসলেই যারা সোনার বাংলা ছেড়ে ভারতে চলে যায় এবং ইহজীবনে আর এমুখো হয় না। উপরোক্ত সৃজনশীল প্রশ্ন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করার অলীক দাবিকে নিঃসন্দেহে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
জনগণের একটি অংশের দেশত্যাগ রাষ্ট্র কিংবা সরকারের অকার্যকারতার কিছুটা প্রমাণতো বটেই। সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ সম্পর্কিত লেখালেখি প্রকাশে বুনিয়াদি মিডিয়াতেই যেখানে অনীহা আছে, সেখানে এক বা একাধিক প্রশ্নকর্তা শিক্ষক দেশের এমন একটি তিক্ত বাস্তবতা কোমলমতি শিশুদের সামনে তুলে ধরাতে সরকার কিংবা জনগণের একাংশের অস্বস্তি হওয়াটা স্বাভাবিক।
বার্ট্রান্ড রাসেল লিখেছিলেন, বেশির ভাগ সরকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মিথ্যা ইতিহাস শেখায়। জনগণও চায় না, শিশুরা সত্য জানুক। চীনা জনগণের উপর জাপানের অত্যাচারের কথা জাপানের পাঠ্যপুস্তকে নেই। পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকেও ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির উপর অত্যাচারের কথা লেখা নেই। পাকিস্তানের শিক্ষিত জনগণের সিংহভাগ মনে করে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে শুধু হিন্দুদের হত্যা করেছে, কারণ পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা ছিল সব ভারতের দালাল। তুরস্কতো স্বীকারই করে না যে আর্মেনীয়দের ওপর আদৌ তারা কোনও অত্যাচার করেছে। কালোদের ওপর সাদাদের অত্যাচারের কথাও আমেরিকার পাঠ্যপুস্তকে কিছুদিন আগেও ছিল না।
পৃথিবীর সব ধর্মেই মিথ্যাকে পাপ বলা হয়েছে। সত্য লুকানোও পাপই বটে। পাপ রোগের মতো, গোপন করাতে বাড়ে, স্বীকার করাতে কমে। যত লুকানো হয়, রোগ জিনিসটা ততই ছড়াতে পারে। কেউ কেউ দাবি করে, কোভিড সংক্রমণের একেবারে প্রথম দিকে চীন সরকার করোনা রোগটা লুকাতে চেষ্টা করার কারণেই নাকি কোভিড মহামারীতে রূপ নিয়েছিল।
সাম্প্রদায়িক অত্যাচার দক্ষিণ এশিয়ার একটি সামাজিক ব্যাধি। একাধারে দুরারোগ্য, বংশগত ও সংক্রামক এই ব্যাধির কারণে আফগানিস্তান-পাকিস্তানে অমুসলমানের সংখ্যা শতকরা এক ভাগের নিচে নেমে এসেছে। ভারতে/পশ্চিমবঙ্গে অহিন্দু, বিশেষত মুসলমানেরা ভালো নেই বলে দাবি করা হয় হিন্দুদেরই লেখা বইতে। তসলিমা নাসরিন আজ থেকে তিন দশক আগে ‘লজ্জা’ উপন্যাস লিখে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছিলেন।
সাম্প্রদায়িক অত্যাচারের কারণে সংখ্যালঘুহীন হয়ে যাওয়া পাকিস্তান-আফগানিস্তানের জনবৈচিত্রের জন্য শুভফল বয়ে আনবে না। বাংলাদেশও একই পথে হাঁটছে বলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বুদ্ধিজীবীরা সরকার ও জনগণকে সতর্ক করছেন। সংখ্যালঘুর ওপর হামলাকারীর বিচার ও শাস্তি না হওয়াতে ভরসাহীন হয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ থেকে শুরু করে আহমদীয়াসহ সব সংখ্যালঘুই বাংলাদেশ ছেড়ে দেশান্তরে চলে যাচ্ছে। ইসমাইলিয়া মুসলমান পরিবার বাংলাদেশে বিরল হয়ে গেছে। বাংলাদেশে দুর্গাপূজার সংখ্যা বছর বছর বাড়ছে, কিন্তু পূজারী হিন্দুর সংখ্যা কমছে দিন দিন। যে কোনো অভিবাসন আখেরে আগমনবিন্দুর জন্যে সুখবর, কিন্তু প্রস্থানবিন্দুর জন্য কঠিন দুঃসংবাদ।
যুগে যুগে, দেশে দেশে বিচিত্র সব দুরারোগ্য ও সংক্রামক সামাজিক ব্যাধি দেখা গেছে। প্রাচীন রোমে দুই ধরনের সন্তান ছিল: পুয়েরি ও লিবেরি। দুই মুক্ত নারীপুরুষের সন্তান লিবেরি ভোট দিতে পারতো। মাতাপিতার একজন যদি দাস হতো, তবে তাদের সন্তান ‘বেডি বা বেডার পুত’ পুয়েরির ভোটাধিকার ছিল না। গত শতকের গোড়ার দিকে আমেরিকায় যখন সিনেমা নির্মাণ শুরু হয়, সাদা অভিনেতারা কালোদের সঙ্গে এক দৃশ্যে আসতে চাইতো না। কোনো সাদা নারীকে কালো পুরুষের সঙ্গে মিশতে দেখা গেলে সেই পুরুষকে শ খানেক বছর আগেই জেলের তালা ভেঙে বের করে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে আমেরিকায়। ঘৃণার মাত্রটা একবার কল্পনা করে দেখুন। দক্ষিণ ভারতের কোথাও নাকি গরীব মেয়েদের স্তনকর দিতে হতো, যার প্রতিবাদে নিজের স্তনচ্ছেদ করেছিল এক মহিলা। ময়মনসিংহ গীতিকায় পড়েছিলাম, বাংলা অঞ্চলে ‘নজর-মরিচা’ নামে একটি প্রথা ছিল, যাতে নববধু তার প্রথম রাত কাটাতো স্বামীর সঙ্গে নয়, এলাকার ভূস্বামীর সঙ্গে। ইতালিতেও এমন প্রথা ছিল, মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত।
ইসলামী আইনে কোনো মুসলমানকে হত্যা আর কোনো অমুসলমানকে হত্যার শাস্তি এক নয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় কালো আর সাদারা ট্রেনের এক কম্পার্টমেন্টে ভ্রমণ করতে পারতেন না, যার প্রমাণ, কৃষ্ণবর্ণের গান্ধী-কে ট্রেনের প্রথম শ্রেণি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কারণ প্রথম শ্রেণিতে স্রেফ সাদা মানুষের চড়ার অধিকার ছিল। বাংলাদেশে অনেক বাড়িতেই ঘরের লোক যে চালের ভাত খায়, চাকর-বুয়াদের সেই চালের ভাত খেতে দেওয়া হয় না। গত মাসেই সম্ভবত বাঁশফোর সম্প্রদায়ের এক যুবক (সম্ভবত) কুষ্টিয়ায় এক রেস্টুরেন্টে চা খেতে গিয়ে অপমানিত হয়েছিলেন। ‘আর কখনও রেস্টুরেন্টে ঢুকবো না’- এই মর্মে মুচলেকা দিতে বাধ্য করা হয়েছিল তাকে। সামাজিক গণমাধ্যমে জানাজানি হওয়াতে পুলিশ গিয়ে ব্যাপারটা মিটমাট করেছিল।
প্রতিবাদ বা সতর্কীকরণ হোক বা না হোক, পাপের ঘড়া আগে পরে পূর্ণ হয়, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। মানুষের প্রতি (বোধিসত্তদের মতো) করুণাবশত লেখক-বুদ্ধিজীবীরা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও আগেভাবে মানুষকে সতর্ক করেন, যাতে সময়মতো ব্যবস্থা নিয়ে সরকার ও জনগণ নিজেকে সংশোধন করে নিতে পারে। ভলতেয়ারের ‘জাদিগ’ কিংবা জোনাথন সুইফটের ‘গালিভারের ভ্রমাণকাহিনী’ মূলত সরকারের দমননীতি ও জনগণের মূর্খতার প্রতিবাদ ও সতর্কীকরণ। হ্যারিয়েট বিচার স্টোর ‘আংকেল টমস কেবিন’ কিংবা অ্যালেক্স হেলির ‘রুটস’ কালো মানুষদের উপর আমেরিকার সাদা মানুষের অত্যাচারের বর্ণনা। রাশিয়ায় যখন জনগণের উপর কমিউনিস্ট দমননীতি চলছিল, বরিস পাস্তারনাক ‘ডক্টর জিভাগো’ উপন্যাস লিখে প্রতিবাদ করেছিলেন।
আমার অভিজ্ঞতামতে, পাশ্চাত্যের নাগরিকদের একটি বড় অংশ সেমিটিকদের ঘৃণা করে এবং রুশদের পছন্দ করে না। ইহুদি এবং আরবরা (এবং সেই সূত্রে মুসলমানেরা, যদিও মুসলমানদের মধ্যে আরবেরা সংখ্যালঘু) তাদের পছন্দের লোক নয়। বেশিদিন আগের কথা নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ইহুদীদের কচুকাটা করা হয়েছে তথাকথিত সভ্য ইউরোপে। নেপোলিয়ন ও হিটলার রুশদের নিশ্চিহ্ন করতে শত শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মস্কো গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং গোহারা হেরেছিলেন। সম্প্রতি ইউক্রেইনকে শিখণ্ডি করে রুশদের এক হাত নিতে চেষ্টা করছে মার্কিনরা।
আলফ্রেদ দ্রেফুস (১৮৫৯-১৯৩৫) ছিলেন ফরাসি সেনাবাহিনীর এক অফিসার। ধর্মে ইহুদী হওয়াতে তার বিরুদ্ধে ১৮৯৪ সালে জার্মানদের হয়ে গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগ উঠেছিল। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকের ফ্রান্স চরমভাবে ইহুদী-বিদ্বেষী। সে সময় দ্রেফুসকে সমর্থন করার মতো লোক ফ্রান্সে খুব একটা ছিল না। ঔপন্যাসিক এমিল জোলা (১৮৪০-১৯০২) দ্রেফুসকে সমর্থন করে ১৮৯৮ সালে (মুজতবা আলীর ভাষায়) ‘এক খানা পত্র ঝাড়লেন’ দৈনিক পত্রিকায়, যাতে তিনি লিখলেন: ‘আমি (আমার জাতি এবং সরকারের বিরুদ্ধে) সেমীয়দের প্রতি ঘৃণা এবং অবিচার করে সেনাকর্মকতা দ্রেফুসকে কারারুদ্ধ করার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাচ্ছি’।
জোলার বন্ধুরা প্রায় কেউই তাকে সমর্থন করেননি। ফ্রান্সে জোলার বিরুদ্ধে লেখালেখি-গালাগালি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে আত্মরক্ষার জন্য দেশ ছেড়ে তাকে লন্ডনে পালাতে হয়। পরে বিচারে দ্রেফুসের বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল এবং প্রায় এক দশক পর সেনাবাহিনীতে তিনি স্বপদে বহাল হয়েছিলেন। জোলাও এক সময় স্বেচ্ছানির্বাসন থেকে ফ্রান্সে ফিরে আসেন। যদিও পুলিশ বলেছে, জোলার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, একাধিক প্রমাণ আছে যে বাড়ির ধোঁয়া বের হবার চিমনি বন্ধ করে জোলাকে হত্যা করা হয়েছিল। এক সংখ্যালঘু ইহুদীর সমর্থনে কলম ধরেছিলেন- কিছু ফরাসির কাছে তাদের প্রিয় সাহিত্যিকের এই অপরাধ ছিল অমার্জনীয়।
সক্রেটিস গ্রিক সমাজের ত্রুটি দেখানোর অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। দার্শনিক সেনেকা রোমান সমাজের বহু অবিচার-অসঙ্গতির সমালোচনা করেছেন। যে গান্ধী আফ্রিকাতে দীর্ঘ দুই দশক দক্ষিণ এশীয়দের অধিকারের জন্য লড়েছেন, মুসলমানদের অধিকারআদায় করতে গিয়ে মৌলবাদী হিন্দুর হাতে খুন হয়েছেন, তাকে আমরা ‘মহাত্মা’ বলি। যে মার্টিন লুথার কিং কৃষ্ণকায়দের অধিকারের জন্য লড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাকেও আমরা মহাপুরুষের কাতারেই ফেলতে চাই। ‘ফরাসিদের একটি বড় অংশ সেমিটিকদ্বেষী- ইহুদি ও মুসলমানদের তারা ঘৃণা করে’- এই কথা সাহস করে বলার জন্য জোলাকে আজ আমরা ধন্যবাদ দিই। সক্রেটিস জোলা, গান্ধী কিংবা লুথার কিং ... এই সব ব্যক্তি তাদের স্থান ও কালের সিংহভাগ পাত্রের এমন কিছু সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন যেগুলো আখেরে জাতি ও মানবজাতির জন্য ক্ষতিকর।
জনগণের সিংহভাগ এবং সরকার সাধারণত চায় না, বুদ্ধিজীবীরা কিংবা যে কেউ সমাজের কোনো অসঙ্গতি তুলে ধরুক। উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে রেখে তারা ভাবে, মরুঝড় থেমে গেছে। যেমনটা আছে, খারাপটা কী, চলুক না আরও কিছু দিন। আমারতো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না! যাদের অসুবিধা হয়, তারাও চুপ থাকে দুই কারণে, প্রথমত, প্রতিবাদ করলে অসুবিধা আরও বাড়তে পারে। সবাই চায় এলাকায় একজন গাজী বা শহীদ থাকুক, কিন্তু নিজের বাড়িতে অবশ্যই নয়। দ্বিতীয়ত, অন্যের প্রতিবাদের ফলে আমার নিজের অসুবিধা যদি এমনিতেই দূর হয়ে যায়, তবে আমি আর কষ্ট করে প্রতিবাদ করার ঝুঁকি নিতে যাই কেন! ঠিক এই মানসিকতা থেকে অনেক শক্তসমর্থ যুবক মুক্তিযুদ্ধে যাননি, যদিও পরে নির্লজ্জের মতো মুক্তিযোদ্ধার সনদ সংগ্রহ করেছেন।
কিছু লোক মনে করে, রোগের কথা বলা উচিত নয়, স্বাস্থ্যের কথাই শুধু বলা উচিত। শেফালি ঘোষ আর শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের গাওয়া চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার একটি গান দিয়ে তাদের কথার আমি উত্তর দিতে চাই। এই গানে শেফালি ঘোষের অনুরোধ: ‘আস্তে ধীরে কইও কথা, মাইনস্যে হুনিবো!’ এর উত্তরে শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব বলেন: ‘ঢোলর বাড়ি কঅরর তলে কদিন থাকিবো?’ প্রমিত বাংলায় অনুবাদ: ‘আস্তে ধীরে কথা বলো, লোকে শুনবে। তাই নাকি? কিন্তু কাপড়ের নিচে চেপে রেখে ঢোলের বাড়ি কদিন লুকানো যাবে?’ অর্থাৎ গোপন কথা, গোপন রোগ আগে পরে প্রকাশ পাবেই।
সংখ্যালঘুর দেশত্যাগে উদ্বিগ্ন হয়ে অনেকেই সাহস করে এ বিষয়ে লিখে যাচ্ছেন বুনিয়াদি ও সামাজিক গণমাধ্যমে। এসব তিক্ত বাস্তবতা লিখতে এমিল জোলার মতো সাহস লাগে, কারণ সমাজ ও সরকার সহজে এই তিক্ত বাস্তবতা স্বীকার করতে চায় না। বুদ্ধিজীবীরা সমাজের যে কোনো অসঙ্গতি যুক্তি সহকারে তুলে ধরেন, কারণ, তারা জানেন, মানুষের যাবতীয় অযৌক্তিক আচরণ মানবজাতির জন্য আগে পরে সমূহ বিপদ ডেকে আনে। সক্রেটিস, সেনেকা, গান্ধী, লুথার কিং, জোলার মতো যারা সমাজের রোগটাকে সবার সামনে নিয়ে এসেছেন, তারা কি সমাজের মঙ্গল, নাকি ক্ষতি করছেন?
যে শিক্ষক গোপাল-নেপাল-আবদুলের প্রশ্ন করেছেন এবং অন্য যে শিক্ষকেরা সেই প্রশ্ন নিরীক্ষা করেছেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল, সেটা আমি জানি না। জানি না, কী তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস। খবরে দেখেছি মূল প্রশ্নকর্তার নাম প্রশান্ত কুমার পাল। যে দেশে জজমিয়া কাণ্ড ঘটেছে, সে দেশে কিছুই বিশ্বাস করা কঠিন। যার বাপকে কুমিরে খেয়েছে, ঢেঁকি দেখলে সে ভয় পায়। চুন খেয়ে যার মুখ পুড়েছে, সে সহজে দই মুখে দিতে চায় না। তবে এটা জানি, কোনো একটা সমস্যা যখন মানুষের মনকে অহর্নিশি তাড়িত করে, তখন কোনো না কোনো দুর্বল মুহূর্তে সেই তাড়না তার আচরণে প্রকাশ পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
‘কীভাবে এমন একটা প্রশ্ন হতে পারলো’- এই প্রশ্নের উত্তরে আশির দশকের শুরুতে ব্রেজনেভ যুগের সোভিয়েত রাশিয়ায় ঘটে যাওয়া এক আশ্চর্য ঘটনার কথা বলবো। একদিন ভ্লাদিমির দানচেভ নামে মস্কো রেডিওর এক সাংবাদিক কোনো সুযোগে সম্প্রচার-যন্ত্র জবরদখল করে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সোভিয়েত শাসন, আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন ইত্যাদির জোর সমালোচনা করেছিল। এই অপরাধে ‘অসুস্থ’ (সরকারি ভাষ্যমতে) দানচেভকে অচিরেই ‘হাওয়া বদলের জন্য’ (সরকারি ভাষ্যমতে) সাইবেরিয়ায় পাঠানো হয়েছিল। নোয়াম চমস্কি এই প্রসঙ্গ উল্লেখপূর্বক প্রশ্ন করেছিলেন: ‘রাশিয়ার মতো লৌহকঠিন শাসনের দেশেও একজন দানচেভের জন্ম হতে পারে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো তথাকথিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দেশে এমন একজন দানচেভ সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব। তাই যদি হয়, তবে কোন শাসনব্যবস্থাটি অধিকতর বিপদজনক?’
গত পাঁচশ বছরের বাংলার ইতিহাসে নেপাল-গোপাল-আবদুলের ঘটনা একেবারেই বিরল নয়। কারও পছন্দ হোক বা না হোক, দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্টগুলোতে অমুসলমান সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করছে, কোথাও দ্রুতলয়ে, কোথাও ধীরলয়ে- এটা বাস্তবতা। এই বাস্তবতার কথা পাকিস্তান-আফগানিস্তানের কোনো লেখক যদি না লিখে থাকেন, তবে এই দুই দেশের সমাজকে মানসিকভাবে সুস্থ-সবল মনে করার কোনো কারণ নেই। এই সব দেশের বুদ্ধিজীবীরা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না। বাংলাদেশে এখনও দানচেভের মতো দুই একটি ‘পাগল’ সাংবাদিক বা প্রশ্নকর্তা শিক্ষক যে জন্ম নিচ্ছেন- এই ব্যাপারটাকে গুরু চমস্কির মতো আমি ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি।
সরকার ও জনগণের সুরে সুর মিলিয়ে যারা কথা বলেন, লেখেন, তারা কখনই প্রকৃত বুদ্ধিজীবী নন। প্রকৃত বুদ্ধিজীবী তিনিই যিনি জোলার মতো প্রয়োজন ও সময়মতো তালকানা সরকার ও অবোধ জনগণের ভুল ধরিয়ে দেবেন। এ কাজে পুরস্কার নেই, ঝুঁকি আছে। এই ঝুঁকি নেবার কারণেই জাতি একদিন না একদিন প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্যে আভূমি মাথা নত করতে বাধ্য হয়। আমি অবশ্য জানি না, প্রশ্ন করার এই অভিনব দুঃসাহসের জন্য বাংলাদেশের ‘পালচেভ’-দের হাওয়া বদলাতে ঠিক কোথায়, কোন (সাঁই)বাড়িয়ায় পাঠানো হবে।
স্থান-কাল-পাত্র। বিশেষ স্থানে বিশেষ পাত্রদের আচরণকে সঠিক কালে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পেরেছেন বাংলার প্রশান্তভ বা পালচেভ, সে যে উপায়ই তিনি অবলম্বন করুন না কেন। রোগ নির্ণয় হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ, উপায়টা নয়। এই প্রশ্নের কারণে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের লক্ষাধিক তরুণ জেনে গেলো তাদের মাতৃভূমির একটি রূঢ় বাস্তবতা। এই প্রশ্ন কি তরুণদের সাম্প্রদায়িক করবে, নাকি দেশের সাম্প্রদায়িক বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকেবহাল করবে? জীবনানন্দীয় ঢঙে প্রশ্ন করি: ‘জানা থেকে ঢের ভালো নাকি নিকষিত অন্ধকারে থাকা?’
কোনো ক্ষতরোগের সঠিক চিকিৎসা যদি না হয়, তবে সেই ক্ষত শরীরের যে কোনো অঙ্গে যেকোনোভাবে, যেকোনো রূপে প্রকাশ পেতে পারে। গোপন না থাকা, না থাকতে চাওয়া সত্যের অন্যতম স্বভাব বটে। কুঁড়ি যখন ফুল হয়ে ফুটতে চায়, অঙ্কুর যখন উদগত হতে চায়, (মাইকেলের ভাষায়) ‘কার সাধ্য রোধে তার গতি’?
আজ থেকে হয়তো এক শ বছর পর একাধারে মূঢ় ও চিন্তাবামন এই আমাদের বুদ্ধিমান ও মননশীল উত্তরপুরুষেরা একবাক্যে স্বীকার করবে যে সক্রেটিস, জোলা, গান্ধী, লুথার কিং, দানচেভ বা পালচেভের কোনো দোষ ছিল না, তারা বরং ‘অসঙ্কোচে প্রশ্ন করার দুরন্ত সাহসে’ সময়মতো আমাদের সতর্ক করতে চেয়েছিলেন। দোষ ছিল গৌণত আমাদের, সব দেখেও যারা প্রাণপণে কিছু না দেখার ভান করছিলাম এবং মুখ্যত তাদের, দশকের পর দশক যাদের উপর রাষ্ট্র পরিচালনার ভার দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম।