স্বাধীনতার ছয় দশকে এসে আমাদের কী এখনো সময় হয়নি নাগরিক বাজেট প্রণয়নের?
Published : 08 Jun 2024, 08:25 PM
প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রে নাগরিকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও নীতি নির্ধারণে সরাসরি এখতিয়ার ও অধিকার ছিল। নগররাষ্ট্রব্যবস্থার অবসানে দেশে দেশে নাগরিকরা সেই অধিকার এবং এখতিয়ার খুইয়ে বসেছে।তবে এবার একটি সমাজের গল্প বলব, যে সমাজটি বর্তমান পৃথিবীর আধুনিক একটি শহরের ভেতরে অবস্থিত হলেও শহরের প্রবর্তিত প্রায় সকল নিয়ম-কানুন ও রীতির বাইরে নিজেদের প্রবর্তিত জীবনব্যবস্থায় তাদের সমাজটি পরিচালনা করে আসছে অর্ধশতাব্দীর অধিক সময় ধরে।
ক্রিস্টিয়ানিয়া নামে ওই সমাজের রীতি কোনো রাষ্ট্রে নেই, কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের ওই রকম এখতিয়ার ও অধিকার না থাকলেও নাগরিক মর্যাদাটুকু থাকে। জনগণের করের টাকায় বেতনভোগী রাষ্ট্রের কর্মচারীকে কথায় কথায় স্যার কইতে হয় না। প্রশ্ন হলো আমাদের স্বাধীন দেশে নাগরিক হিসেবে আমরা কী নাগরিক মর্যাদাটুকু অর্জন করতে পেরেছি?
যে কোন সরকারি দফতরে শিক্ষালাভের সুযোগভোগী প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষের এবং লুঙ্গি পরা খেটে খাওয়া একজন কৃষক বা শ্রমিক কী একই মর্যাদা পেয়ে থাকেন? নাকি শ্রমিক কৃষকরা নিগৃহীত হয়ে থাকেন? এই প্রশ্নগুলো সামনে নিয়ে এলাম জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পর এর পক্ষে বিপক্ষে নানা তরফের বাহারি প্রতিক্রিয়া দেখে। বাজেটের পক্ষের দলের প্রতিক্রিয়াগুলো মোটামুটি এরকম:
রাজস্ব আদায় কঠিন হবে, মূল্যস্ফীতি স্পর্শকাতর; প্রস্তাবিত বাজেট ‘বাংলাদেশবিরোধী’; বাজেট গতানুগতিক, নতুন কিছু নেই; বাজেটে সংস্কৃতি খাতকে চরমভাবে অবহেলা করা হয়েছে; কর ও ঋণের বোঝা বাড়ানোর বাজেট; আইএমএফের ‘প্রেসক্রিপশনের’ বাজেট; সংকটের এই সময়ে গণমুখী বাজেট হয়েছে। প্রতিবছরের বাজেট প্রতিক্রিয়া মোটামুটি এরকমই।
বিপুল জনগোষ্ঠীর ছোট দেশে অনেক ক্ষেত্রে জনজীবনে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থায় বাজেটের আকার ফুলে ফেঁপে বেড়েছে। স্বাধীন দেশের প্রথম বাজেট ছিল দেড়শ কোটি টাকার। সেই বাজেট ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ লক্ষ কোটি টাকা। এত বিশাল বাজেটের পরও কি লক্ষ লক্ষ বেকারের বেকারত্বের অবসান হবে? ছিন্নমূল মানুষগুলো মূল খুঁজে পাবে? ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের মানুষগুলো কী স্বাস্থ্যের দিশা ফিরে পাবে? ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী উভয় পক্ষই নানা মেয়াদে মসনদে বসেছেন, উন্নয়ন করে আমাদের ধন্য করেছেন।
তবে উন্নয়নের জাদুচক্রের দুটো খটকা আমার মাথা থেকে একদম যায় না? দেশে এত উন্নয়ন হলেও, উন্নয়নের মহাসড়ক পেরিয়ে স্মার্ট হবার স্বর্গধামের দরোজার মুখে থাকার পরও দেশের নেতা মন্ত্রীরা কেন চিকিৎসার জন্যে নিদেনপক্ষে ভারত, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে ছুটেন এবং সুযোগ পেলে ইউরোপ-আমেরিকাতে ছুট মারেন? তাদের সন্তানদের কেনই বা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার না দিয়ে বিদেশে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে পড়তে পাঠান?
এই বিশাল বাজেটের জন্য গুনতে হবে সোয়া লক্ষ কোটি টাকার সুদ। ঋণ করে ঘি খাবার মজাটা আমরা আমআদমিরা টের পেতে থাকব। সরকারি তরফ থেকে যত কথাই বলা হোক, বক্তৃতা বিবৃতি যাই আসুক। এ প্রসঙ্গে ছোট্ট একটি উদাহরণ দেব। সংষ্কৃতি অঙ্গনের মোড়লদের তরফ থেকে বাজেট উপস্থাপনের প্রাক্কালে দাবি জানানো হয়েছিল মোট বাজেটের শতকরা একভাগ বরাদ্দের জন্যে। মোট বাজেটের একভাগ বরাদ্দ রাখতে হলে সংস্কৃতির জন্যে বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। আদতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের জন্যে বরাদ্দের পরিমাণ ৭৭৯ কোটি টাকা। যা শতকরা হিসাবে ০.১ এর চেয়েও কম। এর সিংহভাগই খরচ হবে মন্ত্রণালয়ের আমলা আর কর্মচারীদের পেছনে। এর বিপরীতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামগ্রিক বাজেট ৪২ হাজার কোটি টাকার উপরে; জনপ্রশাসনের জন্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার উপরে এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্যে ৪৫ হাজার কোটি টাকার উপরে।
তবে এখন যারা ক্ষমতার বাইরে ওনারা ক্ষমতায় থাকলে বাজেটের এই তুলনামূলক বরাদ্দ যে খুব একটা হেরফের হতো তা মনে করার কারণ কম। ক্ষমতার বাইরে থেকে দায়িত্বহীন বিরোধিতা করা সহজ। তাতে নাগরিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটে না। সংসদের ভেতরে এবং বাইরে সরকারের বিরোধী পক্ষ একটা ছায়া কিংবা বিকল্প বাজেট উপস্থাপন করে দেখিয়ে দিতে পারতেন তারা কতটা পারেন।
আদতে বছর যায় বছর আসে, একই ভাবে বাজেট যায় বাজেট আসে, মাথাপিছু আয় বাড়ে। কিন্তু সীমিত আয়ের মানুষের, আয়হীন মানুষের ভাগ্যের সামগ্রিক পরিবর্তন হয় না। এর বিপরীতে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত 'দুর্নীতির কুমির' পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের মতো দেশের আনাচে-কানাচে নানা জাতের, নানা প্রজাতির লক্ষ লক্ষ মাইক্রো এবং ম্যাক্রো বেনজীর আহমেদ তৈরি হয়েছে সব সরকারের আমলেই। এর টান পড়েছে গিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভিটেমাটিতে আর সীমিত আয়ের মানুষের পকেটে।
আমাদের যে শাসনতান্ত্রিক কাঠামো তাতে নাগরিক ভাবনা, নাগরিক মর্যাদার মতো বিষয়গুলো অনেকটা অপ্রাসঙ্গিক শোনায়। আমাদের জাতীয় বাজেট নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়, সংসদে অনেকটা লোক দেখানো আনুষ্ঠানিক আলোচনাও হয়। কিন্তু স্থানীয় সরকারের নগর সংস্থা থেকে শুরু করে পৌরসভা আর ইউনিয়ন পর্যায়ের বাজেটগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা পর্যালোচনা খুব একটা হয় কী? তাহলে নাগরিক ভাবনার প্রতিফলনের ন্যূনতম সুযোগ কোথায় অবশিষ্ট থাকল? সবটা আমলাতন্ত্রের খপ্পরের মধ্যে রয়ে যাচ্ছে না তো? আমাদের আমলাতন্ত্র কী কোম্পানি আমলের আমলাতন্ত্র থেকে খুব একটা আলাদা? এই প্রশ্ন সামনে রেখেই দেশে দেশে নাগরিক বাজেটের ধারণা এবং নাগরিক মর্যাদার একটি প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে আসতে চাই।
এই শতকের শুরুর দিকে পেরু এবং ডমিনিক প্রজাতন্ত্র নাগরিক বাজেটের ধারণা প্রবর্তন করে।এখন আফ্রিকা মহাদেশ থেকে শুরু করে দুনিয়ার নানা প্রান্তের বেশকটি দেশ নাগরিক বাজেটের এই ধারণার প্রয়োগ এবং পরিক্ষা নিরীক্ষা করছে। এই ধারণার আলোকে শাসনব্যবস্থার নানা ইউনিটে কিশোর তরুণ থেকে সত্তরোর্ধ্ব নাগরিক প্রতিনিধিদের বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। নাগরিকদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে বাজেট প্রণীত হয়ে থাকে। নাগরিক বাজেট বা অংশগ্রহণমূলক বাজেটের চর্চার মধ্যে এসেছে বেশকটি দেশ, সেই সব দেশের মধ্যে পেরু, ডমিনিক প্রজাতন্ত্র, গুয়েতেমালা, নিকারাগুয়া, পর্তুগাল, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, স্পেন, সুইডেন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, ইসরায়েল, দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা, স্কটল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীনতার ছয় দশকে এসে আমাদের কী এখনো সময় হয়নি নাগরিক বাজেট প্রণয়নের?
এবার স্বশাসন বা নাগরিক মুক্তি বা নাগরিক মর্যাদা অর্জনের একটি উদাহরণ তুলে ধরতে চাওয়ার কথা শুরুতেই বলেছিলাম, যেখানে লালন ফকিরের ‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে’ আক্ষেপের প্রশমন হয়েছে।১৯৭১ সালে মুক্ত এই জনপদ যখন আবির্ভূত হয়, তখন ধারণা করা হয়েছিল এরকম ব্যতিক্রমী স্বশাসিত মুক্ত জনপদ টিকবে না। কিন্তু সেই ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে সমাজটি টিকে আছে এবং দিন দিন দুনিয়ার মানুষের মনযোগ লাভ করতে পেরেছে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
জনপদটিকে বলা হয় 'ছদ্মবেশী নৈরাজ্যবাদী মতৈক্যের গণতন্ত্র' । জনপদে প্রচলিত ব্যবস্থার কয়েকটি বিষয় তুলে ধরলে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে এই জনপদটি কেমন। ১৯৭১ সালে এই জনপদের যাত্রা থেকে শুরু করে ২০১১ সাল পর্যন্ত এই জনপদের অধিবাসীরা এখানকার জমির মালিক ছিলেন না। শেষতক ওই শহরের সঙ্গে দীর্ঘ এবং তিক্ত আলোচনার পর ওখানকার সাকুল্যে এক হাজারের কম অধিবাসীর জপদের বাসিন্দারা একটি তহবিল প্রতিষ্ঠা করেন। উদ্দেশ্য ওই জনপদের জমিটা কর্তৃপক্ষয়ের কাছ থেকে ক্রয়ের জন্যে। ২০১২ সালে তারা এর প্রথম কিস্তি পরিশোধ করেন।
এই জনপদের সকলেই ওই জমিনে বাস করেন, তবে সকলেই ভূমিহীন। ওখানে কারো ব্যক্তিমালিকানার বাড়ি নেই, গাড়িও নেই, এমন কী ২০০৫ সাল পর্যন্ত ভেতরে গাড়ি প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ২০০৫ সালে এসে কেবল ভেতরের অধিবাসীদের প্রয়োজনে ১৪ টি গাড়ি দাঁড় করানোর একটি জায়গা ঠিক করে দেয়া হয়।
এখানে অস্ত্র রাখা এবং বহন করা নিষেধ। উচ্চমাত্রার ভারী নেশাও এখানে নিষেধ। গাঁজা এবং অ্যালকোহল ছাড়া সব নেশাও নিষিদ্ধ। যদিও এক সময় খোলা রাস্তায় হাশিশ বিক্রি হতো। সম্প্রতি তা নিষিদ্ধ হয়েছে। বুলেট প্রতিরোধক পোশাক, আতশবাজি, বজ্রপাতসামগ্রী এবং চুরির জিনিস কেনাবেচা এখানে নিষিদ্ধ।
এই জনপদ মোটামুটি ওখানকার তৈরি ঘরোয়া জিনিসপত্র বিক্রি করে অধিবাসীদের জীবনমান চলে যায়। কেউ কেউ ইদানিং জনপদের বাইরে চাকরিবাকরি বা অন্য কোনো রোজগারের উৎসের সঙ্গেও জড়িত। এখানকার জিনিসপত্রের একটা নিজস্ব ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে গেছে অনেকটা নানা আদিবাসী নৃগোষ্ঠীর যেরকম স্বতন্ত্র ঐতিহ্য থাকে অনেকটা সেরকম। এখানকার সবকিছু তুলনামূলক সস্তা।
এখানকার সকলের জীবন স্বাধীন এবং অযাচিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও নিয়মের জঞ্জাল থেকে অনেকটা মুক্ত। পুরো এলাকাটি ৮৪ একরের হলেও জনবসতি সাত একর এলাকাজুড়ে। পুরো জনপদটি ১৫টি ভাগে বিন্যস্ত। প্রতিটি ভাগের একজন প্রতিনিধি নিয়ে একটি যোগাযোগ দল গঠিত। এই দল বৈঠক করে জনপদের অর্থ, রাজস্ব এবং খরচাদি, ব্যবসা এবং নির্মাণ কার্যক্রম বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। জনপদের রক্ষণাবেক্ষণ, গৃহায়ণসহ নানাবিধ বিষয়ে বাইরের কোম্পানির সঙ্গে দেনদরবার, চুক্তি এমন কি এই জনপদে কোনো নতুন বাসিন্দা যুক্ত করার ব্যাপারে এই দল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে। কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে একমত হতে না পারলে সংযুক্ত বৈঠক আহবান করা হয়। এই বৈঠকে জনপদের সকলে অংশে নিতে পারে এবং মতামত দিতে পারে।
এখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র বিশেষের কোনো ভেদাভেদ নেই। এখানে কেউ ধনীও নয়, কেউ গরিবও নয়। আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এখানে সবাই রাজা তাদেরই রাজার রাজত্বে। এখানে কেউ না খেয়ে থাকে না। এখানে কেউ বেকার নয়। আবার কাজের চাপে এখানে কেউ ফ্রান্স কাফকার গল্পের গ্রেগর সামসা নয়। এখানে কারো হাহাকার নেই, না পাবার অতৃপ্তি নেই, এখানে সকলেই একটি জনপদের বাসিন্দা, তাদের আবার সকলেই ভূমিহীন। এখানে কেউ শিল্পী, কেউ গায়ক, কেউ মালি, কেউ দোকানি, কেউ চাষি, কেউ মালি এরকম রকমারি সব একজন একজন করে পুরো জনপদকে নিজের বাড়ি মনে করে। পুরো জনপদ যেন এক প্রেমের হাটবাজার, এখানে সকলের প্রেম জীবনের প্রতি, মানুষের প্রতি, সময়ের প্রতি, সমবায়ের প্রতি। এখানে কেউ ঠকে না, কেউ জেতার তৎপরতাও চালায় না। অথচ রাতে দিনে সবসময় সকলেই জয়ী হয়। এখানে সবকিছুই রঙিন, সবকিছুতে রং লেগে থাকে, এই রং জীবনের, এই রং মুক্তির, এই রং মানুষের, এই রং প্রকৃতির, এই রং সকল প্রাণের।
এখানে আছে উৎসব, আছে আনন্দ। এখানে দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসে শিশু থেকে পরিণত বয়সের সকলে। এখানে কেউ অনাহুত নয়, অচেনা হয়েই সকলেই কেমন করে যেন আপনার আপন হয়ে যায়, হাসিতে আর ইশারায়। এখানে জীবন ও সংস্কৃতির রয়েছে বহুবৈচিত্র্য। প্রতি রোববারে এই জনপদে চলে গান বাজনা কনসার্টসহ নানা আয়োজন। এখানে সুন্দর আর নির্মল আনন্দের সব আছে; নেই কেবল শ্রেণি । এখানে নেই কোন উপাসনালয়। এখানকার সবাই মানুষ, সবাই শ্রমিক বা শিল্পী; সবাই মর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক।
এবার স্বপ্নঘেরা জনপদটির গল্পগুলো লালনের গানের কথার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারি। এবার প্রশ্ন জাগতে পারে এরকম জনপদ কী বাস্তবে থাকা সম্ভব? আর থাকলেও সেটা কোথায়? কোনো পর্বতে বা জঙ্গলে নয় তো? কিংবা বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপে নয় তো? বাস্তবতা হল সবগুলো প্রশ্নকে বাতিল করে এই জনপদ দিন দিন তার রং ছড়িয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বাসযোগ্য নগরী ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহ্যাগেনের ভেতরে জায়গা করে। অবাক করা এই জনপদের নাম ক্রিস্টিয়ানিয়া, এটি কোপেনহেগেনের কোপেনহাভ বা আমাগের দ্বীপে অবস্থিত। মূল শহরের সঙ্গে নির্মিত সেতু দ্বারা দ্বীপটি সংযুক্ত।
এটি শহরের ভেতরে থেকেও যেন বাইরের এক দুনিয়া। তবে ঠিক তেমনটা নয় যেমনটা ইতালির রাজধানী রোমের ভেতরে অবস্থিত আরেক দেশ আরেক নগরী ভ্যাটিকান সিটি। ভ্যাটিকান সিটি এবং রোমের মধ্যে রাজনৈতিক পরিচয়ে আলাদা বটে। কিন্তু জীবন সংস্কৃতি সমাজ অর্থনীতি প্রশাসন সবকিছু একই ধাঁচের একই দর্শনের।
এই এলাকাটি এক সময় সেনা ছাউনি ছিল। ডেনমার্কের রাজা চতুর্থ ক্রিস্টিয়ানিয়ে সমুদ্রের তীর দখল করে এখানে সেনা ছাউনি এবং নানা সামরিক স্থাপনা নির্মাণ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আস্তে আস্তে এলাকাটি পরিত্যক্ত হতে থাকে। ১৯৬০-এর দশকে এটি একটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত এলাকা। ওই সময়টাতে দেশটির নারীবাদী, শিল্পী, হিপ্পিসহ হাজার হাজার তরুণ নিজেদের চিন্তা চেতনা আর জীবনের মুক্তির দাবিতে প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। পুলিশের সঙ্গে বচসা বেঁধে যায়। মূল শহর থেকে হটাতে হটাতে এই পরিত্যক্ত জমিনে নিয়ে ঠেকায়। আর এই তরুণ দল দমন আর পীড়নে দমে না গিয়ে, পরিত্যক্ত এই জমিনেই নিজেদের মুক্তির পতাকা উড্ডীন করেন আর প্রতিষ্ঠা করেন 'ক্ত জনপদ' 'মুক্ত ক্রিস্টিয়ানিয়া'।
মুক্তজনপদের বা মুক্তানগরীর ঘোষণা তারা দেন ১৯৭১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৮ সালের দোসরা ফেব্রুয়ারি তারা তাদের নিজস্ব সংবিধান প্রণয়ন করেন। ১৯৮৯ সালের সাতই জুন দিনেমার কর্তৃপক্ষ একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই জনপদের স্বায়ত্তশাসনকে স্বীকার করে নেন।
তাদের রয়েছে লাল জমিনের ওপর তিনটি হলুদ ফোটা সম্বলিত পতাকা। এই ফোটা তিনটি ইংরেজিতে বা ড্যানিশে ক্রিস্টিনিয়া/Christiania/ Kristiania লিখতে তিনটি আই বর্ণের তিনটি ফোটা। একই নকশায় রয়েছে তাদের আলাদা প্রতীক। এখানকার বাজেট প্রণয়ন ও জনপদের ব্যবস্থাপনায় সকলের অংশগ্রহণ থাকে।
তাদের রয়েছে নিজস্ব সঙ্গীত। এই সংগীতের সারকথা হচ্ছে তোমরা আমাদের নির্মূল করতে পার না, আমরা তোমাদের নিজেদেরই একটা অংশ। ক্রিস্টিয়ানিয়া জনপদে বৈচিত্র্যের এতো বাহারের ভেতরে টের পাওয়া যায় এশিয়া আফ্রিকা, ইউরোপসহ বাকি মহাদেশগুলোর আবেশ। এ যেন নগরের ভেতরে স্বতন্ত্র এক মহাদেশ। এর ভেতরে যখন ঢুকবেন অনুভূত হবে ক্রিস্টিয়ানিয়ায় আপনাকে স্বাগতম জানানো হচ্ছে। যখন ওখান থেকে বের হবেন গেটে লেখা নিম্নোক্ত কথাটি পড়ে বের হবেন: You are now entering the EU অর্থাৎ আপনি এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশ করছেন।
অভিনব এই জনপদ মানুষের নাগরিক অধিকার, নাগরিক মর্যাদার আধুনিক এক দৃষ্টান্ত। আমরা এই ভাবধারার কতটুকু কাছে বা দূরে?