সে বলে উঠল, ‘I know, I know, you are from Sheikh Mujib’s land. You Have killed your leader who gave your independence. How could you kill him? He was a great leader’। আমার কোনো উত্তর ছিল না।
Published : 17 Mar 2023, 11:13 AM
বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে একটি দশকের ইতিহাস অবিনশ্বর অক্ষরে লেখা থাকবে। এই দশকটি বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক। এই দশকেই বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি তার হাজার বছরের ইতিহাসে নিজের অর্থাৎ জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব বাঙালি জনগণ– যাঁকে হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে অর্ঘ্য জানিয়েছে তাঁরই– তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি নানা প্রবন্ধে লিখেছি বাঙালি বিভিন্ন সময়ে নানা স্বাধীন রাজা ও নবাব-বাদশাহের অধীনে ছিল, যেমন, পালরাজ বংশ, সেনরাজ বংশ, সুলতানী আমল ও মোঘল আমল (আলীবর্দ্দী ও নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলার স্বাধীন নবাব হিসেবে পরিচিত ছিলেন, যদিও দুজনেই মোঘল দরবার থেকে সুবেদার হিসেবে সনদপ্রাপ্ত ছিলেন)। এইসব নৃপতি বা রাজা-সুলতানদের আমলে তাঁরা এবং তাঁদের উচ্চ রাজকর্মচারীরা অমিত ক্ষমতার অধিকারী হলেও সাধারণ জনগণের কোনো ক্ষমতাই ছিল না। এইসব ক্ষমতাধারীদের হুকুমে সাধারণ জনগণের প্রাণও চলে যেত; তারা তাদের শির বা মুণ্ডুও খোয়াত। সুতরাং এইসব রাষ্ট্রে রাজারা স্বাধীন হলেও প্রজারা ছিল নিতান্তই তাঁদের হুকুমের দাস, চরমভাবে স্বাধীনতাহীন।
১৯৭১ সালেই বাঙালি তার হাজার বছরের ইতিহাসে নিজের রাষ্ট্র পেয়েছে, যেখানে সাংবিধানিকভাবে তাকেই অর্থাৎ জনগণকেই সব ক্ষমতার উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রের সকল কর্মক্ষেত্রে একমাত্র ভাষা হিসেবে অসীম মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কর্তৃক এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে বাংলা কোনোদিনই একমাত্র রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়নি। বিভিন্ন সময়ে তা ছিল সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, ফার্সি, ইংরেজি। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬-৭১ পর্যন্ত উর্দুর সঙ্গে বাংলা ছিল অন্যতম রাষ্ট্রভাষা (প্রকৃত অর্থে এই সময়ে বাংলার যথাযথ স্বীকৃতি ছিল না)। বিংশ শতাব্দীর নব্বই দশকে এই বাংলাকেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ– জাতির জনকের তনয়া শেখ হাসিনার অসাধারণ উদ্যোগের ফলস্বরূপ।
১৯৬০ থেকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। এই দশকের মধ্যভাগ থেকে আমি শিক্ষকতার সুযোগ পাই যথাক্রমে বুয়েটে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই অসীম সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পেরেছিলাম এই দশকে বাঙালির অভিনব আত্মজাগরণের ফলে বাঙালির দ্বিতীয় রেনেসাঁসের ফল হিসেবে। বাঙালির এই নব জাগরণে, জাতীয়তাবাদের অভিনব বিকাশে যাঁর অবদান ছিল মুখ্য তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্র হিসেবে ও শিক্ষক হিসেবে তাঁর বেশ কয়েকটি জনসভায় শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। জলদগম্ভীর স্বরে তাঁর অসাধারণ ভাষণগুলো আজও আমার কানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়; তা অন্তরের মণিকোঠায় সঞ্চিত রয়েছে। সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য আমার হয়নি। সেই সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৭৪ সালে।
১৯৭৩ সালে আমি কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পিএইচডি করার জন্য যাই। ১৯৭৪ সালের গ্রীষ্মকালীন অবকাশে আমি বাংলাদেশে ফিরে আসি দু-মাসের জন্য। দেশ থেকে কানাডায় আবার ফিরে যাওয়ার সময় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যখন পৌঁছি, ওই সময়ে কয়েকজন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে তাঁদের অফিসে যাই; অফিসটি প্রকৃত অর্থে অসাধারণ অফিস, বঙ্গবন্ধুর অফিস। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুর অফিসে এপিএস হিসেবে কাজ করছিলেন আমার তিন সহপাঠী ও বন্ধু; ড. আবদুস সামাদ, ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন; তৃতীয় জন ওয়ালিউল ইসলাম না ড. মসিউর রহমান ভালো করে মনে পড়ছে না। তাঁদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বঙ্গবন্ধু কি অফিসে আছেন’? ড. সামাদ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন, দেখা করবেন’? আমি বললাম, ‘বঙ্গবন্ধু এত ব্যস্ত, তাঁর সঙ্গে দেখা করা কি সম্ভব?’ ড. সামাদ বললেন, ‘উনি এই মুহূর্তে একাই রয়েছেন। কিছুক্ষণ পরে হয়ত অনেকেই আসবেন’।
ড. সামাদ আমাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কক্ষে ঢুকলেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে প্রণাম করলাম। ড. সামাদ আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার বন্ধু অনুপম, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় একসঙ্গে পড়েছি ও পড়িয়েছি। অনুপম বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কানাডার ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছেন।’
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘খুব ভাল’। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কখন পড়া শেষ হবে, কখন ফিরবেন?’ আমি বললাম, ‘সম্ভবত চার-পাঁচ বছর লাগবে’। শুনে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমাদের তো এখন শিক্ষিত লোকের, কর্মী লোকের, ভালো লোকের খুব দরকার। এতদিন দেরি হবে কেন? যত তাড়াতাড়ি পারেন ফিরে আসুন। দেশকে তো গড়তে হবে। দেশে ভালো এবং উচ্চশিক্ষিত লোকের খুবই দরকার, যারা মানুষের জন্য কাজ করবে। দেশে এখন খুব বেশি কাজের লোক তো পাওয়া যাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি চলে আসুন।’ আমি বললাম, ‘স্যার, আমি অবশ্যই চলে আসব’।
আমার মনে হচ্ছিল তিনি ঐকান্তিকভাবে কাজের লোক খুঁজছেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘আমার বন্ধুরা, বিশেষভাবে সামাদ তো খুবই দক্ষ কাজের লোক। চট্টগ্রামে ডিসি হিসেবে খুবই নাম কুড়িয়েছেন। কয়েক মাসের মধ্যেই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছেন। যেভাবে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল, তা বলার নয়।’
এখানে উল্লেখ্য, ড. সামাদ ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে চট্টগ্রামের প্রথম ডিসি হিসেবে কার্যভার পেয়েছিলেন। ওই সময়ে চট্টগ্রামে, বিশেষভাবে চট্টগ্রাম শহরে একটা মহাশূন্যতার সৃষ্টি হলেও ধীরে ধীরে শৃঙ্খলা ফিরে আসা শুরু হয়েছিল ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে; আইন শৃঙ্খলার প্রয়োগও শুরু হয়। আমলারাও অত্যাচারের বদলে (পাকিস্তানি দখলদারিত্বের আমলের), আইনের শাসন ফিরিয়ে আনতে আইনের প্রয়োগ করতে শুরু করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন রাজনৈতিক নেতারাও। কোর্ট-কাচারিও যথাযথভাবে কার্যকলাপ শুরু করে। সারা দেশজুড়ে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের পর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা খুব সহজ কাজ ছিল না। ড. সামাদ চট্টগ্রামে আইনি কাঠামোর প্রয়োগ ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বেশ বড় একটি ভূমিকা রেখেছিলেন। প্রাথমিক সেই শূন্যতার সময়ে ছোট-খাট রাজনৈতিক নেতারা (যাঁরা অনেক সময়ই রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, হঠাৎ করে নেতা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলেন) অবাঙালিদের রেখে যাওয়া বেশকিছু গুদাম, দোকান, বাড়ি-ঘর ইত্যাদি অন্যায়ভাবে দখল করা শুরু করেছিল। ড. সামাদ কঠোর হাতে এসব নিবৃত্ত করেন। এজন্য তাঁকে অনেক সময় এসব পাঁতি নেতাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াতে হয়। কিন্তু তিনি কোথাও কোনো ছাড় দেননি। সব কাজই করেছেন দৃঢ়তার সঙ্গে, ন্যায়ের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুকে আমি সংক্ষেপে ড. সামাদের এসব কৃতিত্বের কাজগুলো জানাই। বঙ্গবন্ধু এ কথা শুনে খুবই খুশি হয়ে বলেন, ‘তাহলে সামাদকে আবার চাটগাঁয় পাঠিয়ে দিই’? আমি বললাম, ‘তাহলে বেশ ভাল হয়’।
এরপরে বঙ্গবন্ধুকে প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম। কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ড. সামাদ আমাকে বললেন, ‘আমি তো শেষ’। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’ উনি বললেন, ‘বোস্টন ইউনিভার্সিটি আমাকে পিএইচডিতে অ্যাক্সেপ্ট করেছে, স্কলারশিপও পেয়েছি। এখন কী হবে? আমাকে তো চাটগাঁয় পাঠিয়ে দেবেন বঙ্গবন্ধু। আমার তো পিএইচডি করা শেষ। কী করি?’ আমি জানতাম না সামাদ বোস্টনে অ্যাডমিশন পেয়েছেন, স্কলারশিপ পেয়েছেন। লোক আসার আগেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাকে সাক্ষাৎ করিয়ে দিতে আমাকে এসব কথা বলতে সামাদ ভুলে গিয়েছিলেন। তাঁর কথা শুনে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। যতটুকু মনে পড়ে, এরপরে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন, ওয়ালিউল ইসলাম ও ড. মসিউর রহমানের সঙ্গে কথা বলি; তখনও মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন বা মসিউর রহমানের কেউই পিএইচডি হননি। সদ্য স্বাধীন দেশে তাঁরা নবীন আমলা, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন, বঙ্গবন্ধুর অফিসে কর্মরত।
এই ছোট্ট সাক্ষাতকারের স্মৃতিটি আমার অন্তরে যে-গভীর রেখাপাত করেছে, তা কোনোদিন, আমৃত্যু ভুলতে পারব না। দীর্ঘদেহী বঙ্গবন্ধুর মধ্যে যে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আমি দেখেছি, তা অতুলনীয়। তাঁর প্রতিটি বাক্যে বাংলাদেশের প্রতি তাঁর অন্তহীন ভালবাসা আমি বুঝতে পেরেছি, উপলব্ধি করেছি। তিনি চাচ্ছিলেন, সবাই যেন বাংলাদেশের উন্নয়নে আত্মোৎসর্গ করে, যার যতটুকু সাধ্য আছে। সব কর্মক্ষম ব্যক্তিকে তিনি চাচ্ছিলেন বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার কাজে। তাই তিনি আমাকে আন্তরিকভাবে বলেছিলেন, লেখাপড়া শেষ করে আমি যেন অবিলম্বে দেশে ফিরে এসে এদেশের কাজে নিজেকে যুক্ত করি।
২
১৯৭৫ সালের ১৬ অগাস্ট দিনটি কোনোদিন আমার স্মৃতিপট থেকে মুছে ফেলতে পারব না। তখন কানাডায় প্রতিদিন সকালে উঠে টেলিভিশন দেখতাম। ওইদিনই দেখিনি। ইউনিভার্সিটি যেতে রাস্তায় বেরুতেই ম্যাকমাস্টারের পরিচিত একজন ছাত্রের সঙ্গে দেখা হলো। সে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার দেশের খবর জানো?’ আমি বললাম, ‘কেন? কী হয়েছে?’ সে বলল, ‘Your President has been killed’। শোনামাত্র আমার বুক ধক্ করে উঠল। দৌড়ে ঘরে ফিরে এসে টেলিভিশন অন করলাম। টেলিভিশনের নব (Knob) ঘোরাতেই এবিসিতে শুনতে পেলাম, ‘বাংলাদেশে সামরিক ক্যু হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁকে হত্যা করে কারা ক্ষমতায় এসেছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।’ আমি টেলিভিশন বন্ধ করে দিলাম। তখনও জানি না, জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পর ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার সময় পা টলছিল। দেশের অবস্থা কী তা ভেবে ভয়ানক অস্থিরতা বোধ করছিলাম। ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছুতেই বাংলাদেশের অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। সবাই অস্থির। দেশের খবর জানার জন্য উদ্বিগ্ন। সেদিন রাত্রে ভাল ঘুম হলো না, ছটফট করে কাটালাম। তখনকার দিনে, আজকের মতো মোবাইল ফোন ছিল না যে, দেশের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করা যায়। সংবাদমাধ্যম, বিশেষত টেলিভিশন ও রেডিওই ছিল জানার মুখ্য মাধ্যম।
সপ্তাহখানেকের মধ্যে সব খবর পেলাম। বুঝতে পারলাম, দেশদ্রোহী পাকিস্তানপন্থীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশকে কয়েক দশক পেছনে নিয়ে গেছে, একটি পরাজিত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। এই অনুভূতি কেবল আমার হয়েছিল, তা নয়, কানাডার অনেকেরই হয়েছিল। মাসখানেক পরে আমি আমার শহর (হ্যামিল্টন) থেকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে টরন্টো ইউনিভার্সিটির রবার্টস লাইব্রেরিতে যাই। কাজ শেষ করে লাইব্রেরি থেকে বাসস্টেশনে আসার জন্য একটি ট্যাক্সি নিয়েছিলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাকে কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার দেশ কোথায়? ইন্ডিয়ায়?’ আমি বললাম, ‘না, বাংলাদেশে।’ সে বলল, ‘Where is it’? আমি বললাম, ‘It is beside India’। সে বলে উঠল, ‘I know, I know, you are from Sheikh Mujib’s land. You Have killed your leader who gave your independence. How could you kill him? He was a great leader’। আমার কোনো উত্তর ছিল না।
যতটুকু মনে পড়ে, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ড. সামাদ বোস্টন থেকে ম্যাকমাস্টারে আসেন আমার সঙ্গে দেখা করতে, আমার সঙ্গে কয়েকদিন কাটাতে। ড. সামাদ বাস থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্রই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন, বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু নেই, এটা ভাবতেই পারি না। আপনি তো জানেন, বঙ্গবন্ধুর পরিবার, এমনকি তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয়দেরও দুর্বৃত্তরা, বাংলাদেশের শত্রুরা মেরে ফেলেছে, কেবল তাঁর কন্যারা বেঁচেছেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর কারণ তাঁর অসীম ক্ষমা, অসীম করুণা, যে-ই ক্ষমা চেয়েছে তাকেই ক্ষমা করে দিয়েছেন, কেবলমাত্র খুনী-হত্যাকারী-ধর্ষণকারীদের ছাড়া। তিনি সবাইকে আপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শয়তান শয়তানই থাকে, দেশদ্রোহী দেশদ্রোহীই থাকে।’ সামাদের কথা আমার সত্য মনে হয়েছিল।
আজও ভেবে অবাক হই, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে, যিনি বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন, বাঙালির মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, জীবন-যৌবনের ১৩ বছর কারান্তরালে কাটিয়েছেন, তাঁকে কী করে হত্যা করা হলো! এর কি কোনো উত্তর আছে?
কোনো উত্তর নেই। তবু আমরা জানি, মহাপ্রাণ মানুষের মৃত্যু নেই, তাঁরা মৃত্যুঞ্জয়ী। বঙ্গবন্ধুও মৃত্যুঞ্জয়ী। কারণ তিনি একটি জাতিসত্তাকে ঔপনিবেশিক বন্ধনের গ্লানি থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। আব্রাহাম লিংকন, গান্ধী, লেনিন, মাও সেতুং, মার্টিন লুথার কিং, আলেন্দে প্রমুখ নেতারা কখনো মরেন না। তাঁরা চিরভাস্বর, চির উজ্জ্বল। বঙ্গবন্ধুও চির অমর। তিনি যে সোনার বাংলা চেয়েছিলেন– ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত, স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও সংস্কৃতিঋদ্ধ, সেই বাংলা বিনির্মাণের জন্য আজ তাঁর কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। সেই পথে বাংলাদেশ আজ বহুদূর এগিয়েছে, এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এই শতাব্দীর মধ্যভাগের আগেই তা অর্জিত হবে। বাঙালি মুক্তি অর্জন করবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা অর্জিত হবে।