দ্য কেরালা স্টোরি: আইএসে ভারতীয় নারীদের নিয়ে চলচ্চিত্র ঘিরে বিতর্ক

চলচ্চিত্রটির টিজারে এক অভিনেত্রী তার চরিত্রকে রাজ্যের সেই ৩২ হাজার নারীর একজন হিসেবে দাবি করেছেন, যারা ইসলামি সন্ত্রাসীতে ‘রূপান্তরিত’ হয়েছিল।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Nov 2022, 11:38 AM
Updated : 10 Nov 2022, 11:38 AM

কেরালায় তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি করা একটি চলচ্চিত্রের টিজার নিয়ে ওঠা অভিযোগের প্রেক্ষিতে আইনি পরামর্শ চেয়েছে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যটির পুলিশ।

‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নামের ওই চলচ্চিত্রটি সামনে মুক্তি পেতে পারে। এর টিজারে এক অভিনেত্রী তার চরিত্রকে রাজ্যের সেই ৩২ হাজার নারীর একজন হিসেবে দাবি করেছেন, যারা ইসলামি সন্ত্রাসীতে ‘রূপান্তরিত’ হয়েছিল।

টিজারটি প্রকাশের পর কেরালার অনেক রাজনীতিকই চলচ্চিত্রটি নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।

বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চেয়ে অরবিন্দাকশান বিআর নামের এক সাংবাদিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠিও লিখেছেন।

পরে মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয় ওই চিঠিটি পুলিশকে পাঠিয়ে দেয়।

“তদন্ত শুরু হয়েছে। কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় সে বিষয়ে চিঠিতে পরামর্শ চাওয়া হয়েছে,” বলেছেন কেরালার রাজধানী থিরুভানান্তাপুরমের পুলিশ কমিশনার স্পারজান কুমার।

চলচ্চিত্রটির টিজারে বোরকা পরিহিত এক নারীকে তার নাম শৈলিনী উন্নাকৃষ্ণান এবং তিনি নার্স হতে চেয়েছিলেন, এমনটা বলতে শোনা যায়।

“এখন আমি ফাতিমা বা, এক ইসলামিক স্টেট (আইএস) সন্ত্রাসী, আছি আফগানিস্তানের কারাগারে,” বলেন তিনি। জানান, তার মতো ৩২ হাজার মেয়েকে ধর্মান্তরিত এবং সিরিয়া ও ইয়েমেনের মরুভুমিতে সমাহিত করা হয়েছে।

“কেরালায় সাধারণ মেয়েদের ধর্মান্তরিত করে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীতে পরিণত করার মরণখেলা চলছে, এবং সেটা প্রকাশ্যেই,” টিজারে এমনটাই বলেছে ওই নারী চরিত্র। 

ছয়দিনের ভেতরেই ইউটিউবে টিজারটি সাড়ে ৪ লাখ ৪০ হাজারের বেশি বার দেখা হয়েছে; কারও কাছ থেকে পেয়েছে সমালোচনা, কারও প্রশংসা।

যিনি ওই নারী চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন, সেই আদাহ শর্মা টুইটারে চলচ্চিত্রটির টিজার পোস্ট করে সঙ্গে হ্যাশট্যাগ ‘ট্রু স্টোরি’ জুড়ে দিয়েছেন।

বিবিসি চলচ্চিত্রটির প্রযোজক বিপুল শাহের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তার সাড়া মেলেনি।

মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লেখা সাংবাদিক অরবিন্দাকশান বিবিসিকে বলেছেন, তিনি এ বিষয়ে তদন্ত এবং চলচ্চিত্র নির্মাতার কাছে টিজারে দেওয়া তথ্যের সপক্ষে প্রমাণ চেয়েছেন। 

টিজারে যে দাবি করা হয়েছে, তা তাকে ক্রুদ্ধ করেছে বলেও মন্তব্য অরবিন্দাকশানের।

“কিছু ঘটনা হয়তো ঘটেছে, তাই বলে ৩২ হাজার, অবিশ্বাস্য সংখ্যা,” বলেছেন তিনি।

২০২১ সালে একটি মিডিয়া প্রোডাকশন কোম্পানি সিট্টি মিডিয়াকে চলচ্চিত্রটির পরিচালক সুদীপ্ত সেন বলেছিলেন, কেরালা বিধানসভায় সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওম্মেন চান্ডির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তিনি আইএসে যাওয়া নারীর ওই সংখ্যা বের করেছিলেন।

সুদীপ্তের দাবি, চান্ডি সেসময় বছরে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ মেয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত হচ্ছে, এমন তথ্য দিয়েছিলেন; সেই হিসাবে ১০ বছরে ৩২ হাজার মেয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।

তার এ দাবির সপক্ষে কোনো ‘প্রমাণ পাওয়া যায়নি’ বলে জানিয়েছে তথ্যের সত্যতা নিয়ে কাজ করা ভারতীয় ওয়েবসাইট অল্ট নিউজ।

তারা জানাচ্ছে, ২০১২ সালে চান্ডি ২০০৬ সাল থেকে কেরালায় মোট ২ হাজার ৬৬৭ তরুণী ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছেন বলে জানালেও বাৎসরিক কতজন ধর্মান্তরিত হচ্ছে, তা নিয়ে কিছু বলেননি।

২০১৬ সালে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের একটি শাখা সংগঠনে যোগ দিতে কেরালার ২১ জন দেশ ছেড়েছিলেন বলে জানা যায়।

ওই দলে থাকা এক শিক্ষার্থী বিয়ের আগে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। দেশ ছাড়ার সময় তিনি ৮ মাসের গর্ভবতীও ছিলেন।

২০২১ সালে তালেবান আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসার পর ইসলামিক স্টেটে যোগ দেওয়া কেরালার ৪ নারী তখন সেখানকার কারগারে ছিলেন বলে ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন।

“নথিপত্র চেক করা দরকার। কিন্তু আমাদের ধারণা, ২০১৬ থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে কেরালা থেকে আইএসে যোগ দিতে যাওয়া নারীর সংখ্যা কোনোভাবেই ১০-১৫’র বেশি হবে না,” নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে এমনটাই বলেছেন পুলিশের এক কর্মকর্তা।

অরবিন্দাকশান জানান, তিনি চলচ্চিত্রটি নিয়ে সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন, রাজ্য ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ড এবং ভারতের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরকে চিঠি লিখলেও এখন পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে কোনো জবাব পাননি।

“চলচ্চিত্রটি ভারতের একতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে এবং ভারতের সব গোয়েন্দা সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে,” বলেছেন তিনি।

চলচ্চিত্রটির টিজার কেরালার রাজনৈতিক মহলেও ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।

কংগ্রেস নেতা ভিডি সাথিসান এই চলচ্চিত্রকে ‘ভুল তথ্যের সুস্পষ্ট নজির’ অ্যাখ্যা দিয়ে ‘কেরালার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ করতে ও ‘মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়াতে’ চলচ্চিত্রটি বানানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন।

কেরালার ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (মার্কসিস্ট) আইনপ্রণেতা জন ব্রিটাস বুধবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লিখে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ চলচ্চিত্রটি যারা বানিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছেন।

অন্যদিকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা কে সুরেন্দ্রন নির্মাতাদের বিরুদ্ধে কেরালা সরকারের মামলার নিন্দা জানিয়েছেন।

“কেরালায় যারা আইএসের সদস্য সংগ্রহ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হিম্মত থাকা উচিত মুখ্যমন্ত্রীর,” বলেছেন তিনি।