‘সবচেয়ে জনবহুল দেশ’ হতে যাওয়া ভারত জানে না তার লোকসংখ্যা কত

দীর্ঘ সময় ধরে জনগণনা করতে না পারা ভারতের জনসংখ্যার চলতি হিসাব বিভিন্ন সংস্থার অনুমিত।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Feb 2023, 10:32 AM
Updated : 15 Feb 2023, 10:32 AM

ভারত দুই মাসের ভেতর ১৪০ কোটির বেশি জনসংখ্যা নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হওয়ার পথে থাকলেও জানে না তার লোকসংখ্যা আসলে কত।

দীর্ঘ সময় ধরে জনগণনা করতে না পারা ভারতের জনসংখ্যার ওই হিসাব বিভিন্ন সংস্থার অনুমিত।  

দেশটি প্রতি দশ বছর পরপর আদমশুমারি করে। হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে ফের আদমশুমারি হওয়ার কথা থাকলেও কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে তা দেরি হয়। আর এখন এটি প্রযুক্তি ও সরঞ্জামগত সীমাবদ্ধতায় আটকা পড়েছে, সেসব পেরিয়ে লোক গণনা দ্রুত শুরু করা যাবে, এমন কোনো ইঙ্গিতও দেখা যাচ্ছে না।

কর্মসংস্থান, বাসস্থান, শিক্ষিতের হার, অভিবাসনের ধরন, শিশুমৃত্যুর হার সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য পাওয়া উপায় আদমশুমারি; তাতে দেরি হওয়ায় তা বিশাল অর্থনীতির দেশটির সামাজিক ও অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা তৈরিতে প্রভাব ফেলছে বলে বিশেষজ্ঞরা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন।

আদমশুমারির তথ্যকে ‘অপরিহার্য’ অ্যাখ্যা দিয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফাইন্যান্সের ফেলো রচনা শর্মা বলেছেন, ভোগ ব্যয় জরিপ ও পর্যায়ক্রমিক শ্রমশক্তি সংক্রান্ত জরিপের মতো কাজগুলো আদমশুমারির তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই করা হয়।

“আদমশুমারির হালনাগাদ তথ্যের অনুপস্থিতিতে এখন এই কাজগুলো করা হচ্ছে দশক পুরনো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে, যে কারণে এতে যে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, তা বাস্তবতার চেয়ে অনেক অনেক দূরের,” বলেছেন তিনি।

ভারতের পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে যে অনুমিত হিসাব ও ধারণা ব্যবহৃত হচ্ছে, তা ২০১১ সালের আদমশুমারির ওপর ভিত্তি করেই করা হচ্ছে।

ওই বছরই দেশটিতে সর্বশেষ আদমশুমারি হয়েছিল।

মন্ত্রণালয়টির এক মুখপাত্র বলেন, তাদের দায়িত্ব কেবল সম্ভাব্য সেরা যা যা হতে পারে তা সরবরাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, আদমশুমারির প্রক্রিয়া নিয়ে তারা কোনো মন্তব্য করতে পারেন না।

এ প্রসঙ্গে রয়টার্স ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মন্তব্য চাইলেও তারা তাতে সাড়া দেয়নি।

দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের দুই কর্মকর্তা জানান, আদমশুমারি প্রক্রিয়া ঠিকঠাক ও প্রযুক্তির সাহায্যে একে নির্ভুল করতে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার কারণেই এবারের লোকগণনায় দেরি হচ্ছে।

আদমশুমারির তথ্য সংগ্রহে যে মোবাইল ফোন অ্যাপ ব্যবহার করা হবে সেটিকে জাতীয় পরিচয়পত্রসহ নাগরিকের পরিচয় সংক্রান্ত বিদ্যমান সব তথ্যভাণ্ডারের সঙ্গে সংযুক্ত করতে সময় লাগছে, বলেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা।

আদমশুমারির দায়িত্বে থাকা রেজিস্ট্রার জেনারেল অব ইন্ডিয়ার কার্যালয়ের কাছে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য চাওয়া হলেও তারা সাড়া দেয়নি।

ভারতের প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমালোচকরা বলছেন, ২০২৪ সালে হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনের আগে বেকারত্বের মতো রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল ইস্যু সংক্রান্ত তথ্য লুকাতেই সরকার এবার আদমশুমারি করতে দেরি করছে।

“এই সরকার প্রায়ই তথ্যের সঙ্গে তাদের প্রকাশ্য বৈরিতার বিষয়টি প্রদর্শন করেছে। কর্মসংস্থান, কোভিডে মৃত্যু এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে মোদী সরকার যেভাবে তাদের অপছন্দের তথ্য লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে, তা দেখেছি আমরা,” বলেছেন কংগ্রেসের মুখপাত্র পবন খেরা।

ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মুখপাত্র গোপাল কৃষ্ণ আগরওয়াল এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন।

“কীসের ভিত্তিতে তারা এসব বলছেন, তা জানতে চাই আমি। কোন সামাজিক সূচকে তাদের ৬৫ বছরের শাসনের তুলনায় আমাদের ৯ বছরের কার্যক্রম খারাপ হয়েছে?,” কংগ্রেসের ক্ষমতায় থাকা সময়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন গোপাল।

শিক্ষকদের হাড়ভাঙা খাটুনি

জাতিসংঘের হিসাব বলছে, ভারতের জনসংখ্যা চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল ১৪২ কোটি ৫৭ লাখ ৭৫ হাজার ৮৫০ ছুঁতে পারে আর সেদিনই দেশটি চীনকে ছাড়িয়ে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশে পরিণত হবে। 

২০১১ সালের আদমশুমারিতে দেশটির জনসংখ্যা ছিল ১২১ কোটি; অর্থাৎ, পরের এক যুগে দেশটিতে আরও ২১ কোটি লোক যোগ হয়েছে, যা ব্রাজিলের মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান।

ভারত এই আদমশুমারি করে দেশটির প্রায় তিন লাখ ৩০ হাজার শিক্ষকের মাধ্যমে। ওই শিক্ষকরা প্রথমে দ্বারে দ্বারে ঘুরে দেশের সব ঘরকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন, এরপর জরিপের প্রশ্নের আরেকটি তালিকা নিয়ে তারা ফের বাড়িগুলোতে যান। 

১১ মাস ধরে তারা দুই দফায় ১৬টি ভাষায় প্রত্যেকবার দুই ডজনেরও বেশি প্রশ্ন করবেন, এমনটাই ছিল ২০২১ এর শুমারির পরিকল্পনায়।  

সব তথ্য একত্রিত করার আরও কয়েক মাস পর তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। ২০১৯ সালে এই পুরো প্রক্রিয়ার ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৭৫০ কোটি রুপি।

কিন্তু মহামারীর বিঘ্ন কাটিয়ে শিক্ষকরা অল্প কিছুদিন আগেই শ্রেণিকক্ষে ফিরলেন; আদমশুমারি হলে তার পাশাপাশি তাদেরকে ২০২৩ সালে ৯টি রাজ্য নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনেও কাজ করতে হবে, যা আবারও শিক্ষাদানকে ব্যাহত করবে।

এর পাশাপাশি পারিশ্রমিকের প্রসঙ্গও সামনে চলে আসছে।

২৩ লাখ সদস্যের সর্বভারতীয় প্রাথমিক শিক্ষক ফেডারেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অরবিন্দ মিশ্র বলেন, নির্বাচন এবং শুমারিতে সহযোগিতা করতে শিক্ষকরা আইনিভাবেই বাধ্য, কিন্তু সরকারকে তাদের মজুরি বাড়িয়ে দিতে হবে।

“এসব কাজের পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া চালু করা দরকার তাদের। শিক্ষকদের সম্মান প্রাপ্য, তারা বিশ্বের সর্ববৃহৎ লোকগণনা করে তারপর খরচের টাকা তুলতে এদিক ওদিক দৌড়ঝাঁপ করবেন, তা হয় না,” বলেছেন তিনি।