জাতীয় সঙ্কট ছেড়ে কেন রিয়া চক্রবর্তীর পেছনে ভারতীয় গণমাধ্যম?

জিডিপির রেকর্ড সঙ্কোচন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে যাওয়া কিংবা লাদাখ সীমান্তে চীনের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থা- গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়গুলোর কোনোটিই ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ততটা মনোযোগ পাচ্ছে না, যতটা সময় তারা ব্যয় করছে সুশান্ত সিং রাজপুতের বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তীকে ঘিরে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Sept 2020, 12:02 PM
Updated : 12 Sept 2020, 04:44 AM

গত জুনে নিজ অ্যাপার্টমেন্টে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় বলিউড অভিনেতা সুশান্তর লাশ। আত্মহত্যার ওই ঘটনা ঘিরে নানা রহস্য দানা বেঁধেছে।

সুশান্তের বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তীকে টানা জিজ্ঞাসাবাদের পর গত মঙ্গলবার বিকালে মাদক আইনের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। রিয়া নিজেও বলিউড অভিনেত্রী এবং মডেল।

একই মামলায় এর আগে রিয়ার ভাই শৌভিক, সুশান্তের সাবেক ম্যানেজার মিরান্ডা ও সাবেক শেফ দীপেশ সাওয়ান্তসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ব্যুরো।

বিবিসি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, সুশান্তের মৃত্যুর পর থেকেই ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো এ ঘটনাকে ঘিরে নানা খবর অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করা শুরু করে। মৃত্যু নিয়ে রহস্য যত ঘনীভূত হতে থাকে গণমাধ্যমের আকর্ষণ আরো বাড়তে থাকে।

এক পর্যায়ে দৃশ্যপটের কেন্দ্রে চলে আসেন রিয়া। সুশান্তের বাবা রিয়ার বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা, ছেলের অর্থ চুরি, অতিরিক্ত ওষুধ দেওয়া এবং এমনকি সুশান্তকে ‘হত্যাও করা হয়ে থাকতে পারে’ অভিযোগ তুলে মামলা করেন।

রিয়া তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সেসব অভিযোগ এখনো তদন্তাধীন, বিচার প্রক্রিয়াও একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে। অথচ ভারতের জনপ্রিয় বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল এরই মধ্যে রিয়াকে একপ্রকার ‘অপরাধী’ ঘোষণা করে দিয়েছে।

পুরো ভারত এখন চরম সঙ্কটের সময় পার করছে। গত সোমবার ভারত সরকার চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (এপ্রিল-জুন) মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, ভারতের জিডিপি ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়েছে, যা গত ২৫ বছরে রেকর্ড পতন।

১৯৯৬ সাল থেকে ভারত তাদের ত্রৈমাসিক জিডিপির পরিসংখ্যান প্রকাশ করা শুরু করে। এবারের জিডিপির চিত্রকে ‘উদ্বেগজনক’ বলছেন অর্থনীতিবিদরা।

মূলত দেশজুড়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবং এই মহামারীর বিস্তার রোধে লকডাউনের কারণেই অর্থনীতির এই দুর্দশা হয়েছে।

লকডাউনে দেশের অর্থনীতির করুণ হাল হলেও ভাইরাসের বিস্তার কমানো যায়নি। কোভিড-১৯ শনাক্ত রোগীর সংখ্যায় ভারত এখন বিশ্বে দ্বিতীয়। এদিক দিয়ে ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে কেবল যুক্তরাষ্ট্র।

এখনও প্রতিদিন সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে ভারত এক সময় এক নম্বরেও পৌঁছে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।

বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার এই দেশে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রতিদিনই দৈনিক শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যায় রেকর্ড হচ্ছে। দৈনিক মৃত্যু বৃদ্ধির হারেও ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে।

দেশটিতে গত এক দিনে রেকর্ড ৯৬ হাজার ৫৫১ জনের দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়েছে, মারা গেছেন ১২০৯ জন।

সরকারি হিসেবে ভারতে এ পর্যন্ত ৪৫ লাখ ৬২ হাজার ৪১৪ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে, মোট মৃত্যু হয়েছ ৭৬ হাজার ২৭১ জনের।

এদিকে, চীন-ভারত সীমান্তে সৃষ্টি হয়েছে যুদ্ধাবস্থার। লাদাখের গালওয়ান ভ্যালিতে গত ১৫ জুন চীনের সেনারা কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়াই ২০ ভারতীয় সেনাকে হত্যা করে।

১৯৬০ সালের পর চীন সীমান্তে এত ভারতীয় সেনার প্রাণহানির ঘটনা আর ঘটেনি। ওই ঘটনার পর থেকেই উভয় দেশ সীমান্তে শক্তি বাড়িয়েছে। উভয়পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যে উস্কানিমূলক গুলিবর্ষণ এবং অনুপ্রবেশের অভিযোগও করা হচ্ছে।

যদিও মস্কোতে দুই দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা বৈঠক করে সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমনে একমত হয়েছেন, তবে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, চীন-ভারত সীমান্তের পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক।

অথচ ‍ভারতের বেশিরভাগ টেলিভিশন চ্যানেল এই সব খবর প্রকাশে সমান্য সময়ই ব্যয় করছে বলে মন্তব্য করা হয়েছ বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

সেখানে বলা হয়, ভারতের একটি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে এক বক্তা জিডিপি নিয়ে কথা বলতে চাইলে সঞ্চালক তাকে তীব্র ভাষায় কটাক্ষ করে থামিয়ে দেন।

বক্তা বলছিলেন, “জিডিপি ২৩.৯ শতাংশ সংকুচিত হওয়ার খবর শোনার দিনটিকে আমি আমার জীবনের ন্যক্কারজনক দিনগুলোর একটি বলতে চাই...”

বক্তা বাক্যটি শেষ করতে পারেননি। তার আগেই তাকে থামিয়ে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক বলেন, “যদি আপনার কাছে বিষয়টা এতটাই ন্যক্কারজনক হয় তবে আপনার এই আলোচনায় অংশ নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের সময়, আপনার সময়, জাতীর সময়, দর্শকদের সময় এবং আমার সময় নষ্ট করবেন না।

“জিডিপি নিয়ে জানতে চাইলে আগামীকালের পত্রিকা পড়ে নেবেন।”

আরো বেশ কয়েকটি চ্যানেলেও একই রকম কাণ্ড হয়েছে। তারা সুশান্তের মৃত্যুকে এই সময়ের ‘সবচেয়ে বড় ঘটনা’ বলে বর্ণনা করছেন।

গত মঙ্গলবার রিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর এক চ্যানেলের উপস্থাপক বেশ গর্বের সঙ্গে বলেন, তাদের চ্যানেল এখন পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার ঘণ্টা সুশান্তের মৃত্যু নিয়ে খবর প্রকাশ করেছে।

কেন সুশান্তের মৃত্যু ঘিরে এত আগ্রহ? কেন রিয়া ভিলেন?

বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘নিশ্চিতভাবে’ এর প্রধান কারণ রাজনীতি। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপিকে সমর্থন করা চ্যানেলগুলোতেই সুশান্তের মৃত্যু এবং রিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ ও গ্রেপ্তারের খবর বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে।

বিহার রাজ্যের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অমরনাথ তিওয়ারি বিবিসিকে বলেন, “এবছরের শেষ দিকে বিহারে বিধানসভা নির্বাচন। সুশান্ত বিহারের ছেলে। এখানে নেতারা সুশান্তের নামে ভোট চাইছেন।”

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমার গত সোমবার তার প্রথম ভার্চুয়াল র‌্যালিতে বার বার সুশান্তের নাম নিয়েছেন। তার জোটের অংশীদার বিজেপি নির্বাচনী প্রচারে সুশান্তের হাসি মুখের ছবি দেওয়া স্টিকার, মাস্ক ও লিফলেট বিতরণ করছে।

অমরনাথ বলেন, “খালি নির্বাচনটা শেষ হতে দেন। বিহারে কেউ আর সুশান্তকে নিয়ে একটা কথাও বলবে না।”

সুশান্তকে নিয়ে রাজনীতি চলছে মহারাষ্ট্রেও। রাজধানী মুম্বাইয়ে সুশান্তের মৃত্যুর মামলা নিয়ে বিজেপি ও শিব সেনার মধ্যে বিরোধ শুরু হয়েছে। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির অভিযোগ, রাজ্যে ক্ষমতাসীন শিব সেনার এক মন্ত্রী এ মামলায় হস্তক্ষেপ করছেন।

সুশান্ত ও রিয়ার ঘটনা নিয়ে দ্য প্রিন্টের শৈলজা বাজপাই বলেন, জাতীয় সঙ্কটের সময় জনগণের মনযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে এ ধরনের ঘটনা ‘দারুণ কাজের’ এবং সরকার যেটাকে ‘সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগাচ্ছে’।

“আপনার হাতে এমন একটি খবর, যাতে অপরাধের রসালো গল্প, বলিউড, সিনেমা এবং বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ সবই উপস্থিত। সুন্দর দেখতে এক তরুণীকে এই গল্পের কেন্দ্রে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং গল্পকার দক্ষতার সঙ্গে সত্যিকারের জাতীয় সঙ্কট থেকে জনগণের মনযোগ অন্যদিকে সরিয়ে দিচ্ছেন।

“সরকার দারুণ খুশি। কারণ কেউ তাকে দেশের অর্থনীতি, জিডিপি, বেকারত্ব বা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়তে থাকা করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে প্রশ্ন করছে না।”

টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও সুশান্ত-রিয়ার খবর বেচে লাভবান হচ্ছে। চটকদার এ খবরে তাদের দর্শক বেড়েছে, অনুষ্ঠানের রেটিং বেড়েছে এবং সে কারণে বিজ্ঞাপনের সংখ্যাও বেড়েছে।

শৈলজা বাজপাই বলেন, “চ্যানেলগুলোর রেটিং টানা বাড়ছে। কারণ, আমাদের বিকৃত রুচির দর্শকরা সুশান্ত-রিয়া গল্পের যে কোনো টুইস্ট বা ঘটনার যে কোনো মোড় লুফে নিচ্ছে। তাই চ্যানেলগুলোও এ ঘটনার পেছনে পড়ে আছে।

“কিন্তু আমাদেরকে আসল সঙ্কটের মুখোমুখিও তো হতে হবে। এ ঘটনা আমাদের সমাজ সম্পর্কে কী বার্তা দিচ্ছে?”