লোকসভা নির্বাচনের যতটুকু ফলাফল বৃহস্পতিবার রাত নাগাদ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ লাগোয়া রাজ্যটিতে গেরুয়াদের অগ্রযাত্রা দেখা যাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে বিজেপির আসন সংখ্যা ১৬টি বেড়ে ১৮টি হতে চলেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস সর্বাধিক ২২টি আসনে জিততে চললেও তাদের আসন কমছে ১২টি।
সবচেয়ে পুরনো দল কংগ্রেস দুটি আসনে ধরে রেখে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারলেও একেবারে শূন্য হাতে ফিরতে হচ্ছে রাজ্যটিতে প্রায় তিন দশক ক্ষমতায় থাকা বাম ফ্রন্টকে।
লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের ক্ষমতার বদল না হলেও নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে গেরুয়াদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে দুই বছর বাদে বিধান সভা নির্বাচনেও তাদের জয় অপ্রত্যাশিত হবে না। যেমনটা ইতোমধ্যে ঘটেছে ত্রিপুরা রাজ্যে।
জ্যোতি বসু আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্যের নেতৃত্বে তিন দশক পশ্চিমবঙ্গ শাসন করে রাজ্যটিকে নিজেদের দুর্গ হিসেবে পরিচিত করিয়েছিল বাম ফ্রন্ট।
কিন্তু ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে থেকে লাল দুর্গের পতনের শুরু, যা ঘটিয়েছিলেন এক সময়ের কংগ্রেস নেত্রী মমতা। ওই নির্বাচনেই ইঙ্গিত দিচ্ছিল বামদের পতন আসন্ন।
২০১১ সালে রাজ্য বিধান সভা নির্বাচনে তারই প্রতিফলন ঘটেছিল, বামদের হটিয়ে ক্ষমতায় গিয়েছিলেন মমতা তার জোড়া ফুল প্রতীক নিয়ে।
এবার ভোটপ্রাপ্তিতে বড় চমক দেখিয়েছে বিজেপি। তাদের পদ্ম ফুলে ভোট পড়েছে ৪০ শতাংশের মতো। ৪৫ শতাংশ ভোট নিয়ে তৃণমূল এখনও এগিয়ে আছে।
কিন্তু এই ফলের সঙ্গে ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের বেশ মিল পাওয়া যাচ্ছে। সেবার তৃণমূল পেয়েছিল ৩১ দশমিক ১৮ শতাংশ ভোট। আর তখন রাজ্যে ক্ষমতাসীন বাম ফ্রন্ট পেয়েছিল ৪৩ দশমিক ৩০ শতাংশ ভোট।
অর্থাৎ এ বার বিজেপি যেমন ভোট পেয়েছে, তা তৃণমূলের সেবারের ভোটের কাছাকাছিই।
আর আসন সংখ্যা হিসাব করলে তো তারা এগিয়ে গেছে অনেক। গতবার তাদের আসন সংখ্যা ছিল যেখানে দুটি, এবার তা এক লাফে বেড়ে হচ্ছে ১৮টি।
বাংলাদেশ লাগোয়া ত্রিপুরা ও আসাম ইতোমধ্যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির কব্জায় চলে গেছে, এখন পশ্চিমবঙ্গেও তারা নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে যাচ্ছে।
কাহিনীতে থাকা রামের জন্মভূমি অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে ভোটের লড়াইয়ে সামনে চলে আসা বিজেপির ইতিহাসের সঙ্গে আবার জড়িয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গ।
বিজেপির উৎস হিসেবে যে সংগঠনটিতে ধরা হয়, সেই ভারতীয় জনসংঘ গঠন করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গেরই রাজনীতিক ডা. শ্যমাপ্রসাদ মুখার্জি।
১৯৫১ সালে তার গড়া ভারতীয় জনসংঘই দেশটির প্রথম হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল। ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার পর জনসংঘ একাধিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিশে গড়ে তোলে জনতা পার্টি। তার তিন বছর পর জনতা পার্টি অবলুপ্ত হলে জনসংঘের সাবেক সদস্যরা মিলে গঠন করেন বিজেপি দলটি।
১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি মাত্র দুটি আসনে জয় লাভ করেছিল। কিন্তু ‘রাম জন্মভূমি আন্দোলন’র ঢেউয়ে পরের নির্বাচনেই তাদের আসন সংখ্যা একশর কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এরপর তো আরও এগিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পৌঁছে যায় দলটি।
অসাম্প্রদায়িক বামদের শাসনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এক সময় মমতার সঙ্গে জোট বেঁধে ভোট করলেও তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা তেমন বাড়াতে পারেনি; কিন্তু এখন তারা ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে রাজ্যটিতে।
পাঁচ বছর আগে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পরপরই বিজেপির কর্মীবাহিনীর উৎস রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়িয়ে তোলে পশ্চিমবঙ্গে।
সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে যেখানে তাদের ৭৫০টি শাখা ছিল, সেখানে ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২৭৯টিতে।
গোটা দেশে গত বছর সংগঠনটির পরিসর বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৪০ শতাংশ, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে তা ৪৭ শতাংশ।
এবার ভোটের প্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন কয়েকবার। যার অর্থ এই রাজ্যটিতে চোখ নিবিষ্ট করছেন তিনি।
এভাবে যদি আরএসএস বাড়তে থাকে, আর মোদীও তৎপর থাকেন, তাহলে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা মমতার জন্য কঠিন হবে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।