তালেবানের প্রত্যাবর্তনের এক বছর: স্বাধীনতা ফিরে পেতে লড়ছেন নারীরা

মেয়েদের বিষয়ে তালেবানের কট্টর দৃষ্টিভঙ্গিই আফগানিস্তানের নতুন সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং শতকোটি ডলারে সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 August 2022, 10:03 AM
Updated : 9 August 2022, 10:03 AM

পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থিত শাসনকাঠামোর দুই দশকে আফগান নারীরা যেসব অধিকার আদায় করে নিয়েছিল তালেবানের চোখ রাঙানি সত্ত্বেও তা সহজে বিসর্জন দিতে নারাজ মোনেসা মুবারেজ।

গত বছরের অগাস্টে কট্টরপন্থি গোষ্ঠী তালেবান আন্দোলন অনেকটা ঝড়ের বেগে প্রায় পুরো আফগানিস্তানের দখল নেয়, তার আগে ৩১ বছর বয়সী মুবারেজ ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতি পর্যবেক্ষণকারী পরিচালকের দায়িত্বে।

তিনি ছিলেন সেই নারীদের একজন, যাদের বেশিরভাগেরই বাস ছিল বড় বড় শহরগুলোতে এবং যারা এমন সব স্বাধীনতা ভোগ করেছেন, যা গত শতকের শেষ দশকে তালেবানের আগের শাসনামল দেখা প্রজন্মের অনেকে কল্পনাও করতে পারেনি, বলেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

ক্ষমতায় ফেরা তালেবান ইসলামি আইনের কট্টর ব্যাখ্যা দিয়ে নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করার সুযোগ কমিয়ে দেওয়ার পর থেকে মুবারেজের চাকরি নেই।

কেবল তাই নয়, তালেবান এখন আফগানিস্তানের নারীদেরকে রক্ষণশীল আচার আচরণ ও পোশাক পরতে বলছে, মেয়েদের জন্য মাধ্যমিক শিক্ষার দুয়ারও বন্ধ করে দিয়েছে।

তাদের নতুন সরকারের মন্ত্রিসভায় কোনো নারী নেই, নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ই তুলে দিয়েছে তারা।

“এক যুদ্ধ শেষ, কিন্তু আফগান নারীদের জন্য ন্যায্য অধিকার আদায় করে নেওয়ার লড়াই শুরু হয়েছে। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমরা প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবো,” বলেছেন রাজধানী কাবুলের সুপরিচিত নারী অধিকারকর্মীদের একজন মুবারেজ।

পশ্চিমা সমর্থিত সরকারকে উৎখাতের কয়েক সপ্তাহ পরও তালেবান সদস্যরা যখন বিভিন্ন সড়কে টহল দিচ্ছিল, সেসময় মারধরের শিকার ও আটক হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই কষ্টার্জিত অধিকার রক্ষার তাগিদে একাধিক বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।

এই ধরনের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ এখন কালেভদ্রে হয়; সর্বশেষ যে বিক্ষোভে মুবারেজ অংশ নিয়েছিলেন, তা ১০ মে হয়েছিল।

তালেবানকে উপেক্ষা করেই তিনি এবং অন্যান্যরা এখন বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতে একত্রিত হচ্ছেন, নারী অধিকার নিয়ে আলোচনা করছেন, লোকজনকে তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন; যা তালেবানের আগের শাসনামলে কার্যত কল্পনাতীতই ছিল।

জুলাইয়ে মুবারেজের বাড়িতে এমনই এক বৈঠকে তিনি ও একদল নারী মেঝেতে বসে নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় করছিলেন, ‘খাদ্য’, ‘কাজ’ ও ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে তারা এমন কিছু স্লোগান দিচ্ছিলেন, যেন মনে হচ্ছিল তারা বাইরে সমাবেশ করছেন।

“আমরা আমাদের নিজেদের স্বাধীনতার জন্য লড়ছি। আমরা লড়ছি আমাদের অধিকার ও মর্যাদার জন্য। কোনো দেশ, সংস্থা বা গুপ্তচর এজেন্সির হয়ে কাজ করছি না আমরা। এটা আমাদের দেশ, আমাদের জন্মভূমি, আমাদের এখানে থাকার অধিকার রয়েছে,” রয়টার্সকে এমনটাই বলেছেন মুবারেজ।

আফগানিস্তানে জাতিসংঘের নারী বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএন উইমেনের প্রতিনিধি অ্যালিসন ডেভিডিয়ান বলেছেন, আফগানিস্তানে অনেকে গল্পই এখন মুবারেজের মতো।

“বিশ্বজুড়ে অসংখ্য নারীর জন্য সদর দরজার বাইরে বের হওয়া স্বাভাবিক জীবনেরই অংশ। কিন্তু আফগানিস্তানে অনেক নারীর জন্যই এটা অস্বাভাবিক। দুঃসাহসী কাজ,” বলেছেন তিনি।

ঘরের বাইরে নারীরা কি কি করতে পারবে, এ সংক্রান্ত নিয়ম নীতি স্পষ্ট না হওয়ায়, কাবুলের মতো তুলনামূলক উদার শহুরে এলাকাগুলোতে নারীদেরকে প্রায়ই পুরুষ অভিভাবক ছাড়া বাইরে চলাফেরা করতে দেখা গেলেও দেশটির দক্ষিণ ও পূর্বের কট্টর রক্ষণশীল এলাকায় এমনটা চোখে পড়বে না।

তালেবানের আইন অনুযায়ী এখন দেশটির সব নারীকেই ৭৮ কিলোমিটারের বেশি ভ্রমণের ক্ষেত্রে সঙ্গে পরিবারের পুরুষ সদস্যকে রাখতে হবে।

নারী ও মেয়েদের বিষয়ে তালেবানের এই দৃষ্টিভঙ্গিই দেশটির নতুন সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা। একই কারণে তারা শতকোটি ডলারের সহায়তা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে, যা দেশটির এমনিতেই ডুবতে থাকা অর্থনীতিকে আরও বিপাকে ফেলেছে।

দেশটির বর্তমান প্রশাসনের একাধিক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নারী বিষয়ক নীতি তালেবানের শীর্ষ নেতারাই ঠিক করেন বলে জানান।

এ বিষয়ে আর কিছু বলতে রাজি হননি তারা।

তালেবান নেতারা বলছেন, আফগান নাগরিকরা সব অধিকারই পাবেন তাদের ব্যাখ্যা করা শরিয়া আইন অনুযায়ী।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও পশ্চিমা একাধিক দেশের সরকার কট্টরপন্থি এ গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিদেশি সেনা এবং পশ্চিমা মদদপুষ্ট আফগান বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় হাজার হাজার আফগান বেসামরিককে হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ করে আসছে।[

তালেবান বলছে, তারা বিদেশি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধই চালিয়েছে। ক্ষমতায় আসার পর পূর্বশত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ না নেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা। কোথাও কোথাও কোনো এর ব্যত্যয়ের খবর পাওয়া গেলে সেসব ঘটনা তদন্ত করে দেখা হবে বলে গত বছর কট্টরপন্থি গোষ্ঠীটির কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়েছিলেন।

আফগানিস্তান এখন বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে মেয়েদের মাধ্যমিক স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ।

এ বছরের মার্চে তালেবান মেয়েদের মাধ্যমিক স্কুলগুলো খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল, কিন্তু যেদিন থেকে মেয়েদের স্কুলগুলো মুখরিত হওয়ার কথা, সেদিন সকালেই তারা ওই ঘোষণা স্থগিত করে দেয়।

এই বিধিনিষেধের মধ্যে দেশটির অনেক মেয়ে প্রাইভেট টিউটর বা অনলাইন ক্লাসে ভর্তি হয়ে নিজেদের পড়াশোনা চালিয়ে নিচ্ছে।

“স্কুল খুলে দেবে বলে আশা করছি আমরা,” বলেছে ১৬ বছর বয়সী কেরিশমা রাশেদি। স্কুল বন্ধ থাকায় আপাতত প্রাইভেট টিউশনই ভরসা।

আফগানিস্তানে স্কুল বন্ধ থাকলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দ্রুত দেশ ছাড়তেও আপত্তি নেই তার।

“আমি কখনোই পড়াশোনা থামাবো না,” ভাষ্য রাশেদির, ২০২০ সালে উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় কুন্দুজ প্রদেশে অবস্থিত তাদের বাড়িতে রকেট পড়েছিল। এর পরই তার পরিবার কাবুলে চলে আসে।

তালেবান ক্ষমতায় আসার পরও আফ গানিস্তানে নারীদের অধিকার, দৈনন্দিন জীবন ও রাজনীতিতে মেয়েদের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের তাগিদ অব্যাহত আছে। এদিকে দেশটির অনেক নারীই এখন বলছেন, টিকে থাকার প্রয়োজনেই তারা এখন নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

তাদেরই একজন গুলেস্তান সাফারি। তালেবান চাকরি করতে না দেওয়ায় এক সময়কার এই নারী পুলিশ সদস্যকে এখন জীবিকার তাগিদে কাবুলের বাড়িতে বাড়িতে ছোটখাট কাজ করতে হচ্ছে।

“আমি আমার চাকরিকে ভালোবাসতাম। তখন আমরা যা চাই, তা কেনার সামর্থ্য ছিল। তখন মাংস, ফল কিনতে পারতাম,” বলেন ৪৫ বছর বয়সী এই নারী।