ফুরাচ্ছে অপেক্ষা, দুয়ার খুলছে মেট্রো ট্রেন

যানজটের নগরীতে যাত্রীদের নতুন অভিজ্ঞতা আর স্বস্তির যাত্রার স্বপ্ন দেখিয়ে মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ।

মাসুম বিল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Dec 2022, 07:18 PM
Updated : 27 Dec 2022, 07:18 PM

প্রতিদিন সকালে আগারগাঁও তালতলার বাসা থেকে মোজাম্মেল হোসেনের উত্তরার হাউজ বিল্ডিং এলাকায় অফিস যেতে কপাল খুব ভালো থাকলেও লাগে দুই ঘণ্টা। সন্ধ্যায় ফিরতি পথে আরও দুই ঘণ্টা। মানে ২৪ ঘণ্টার দিনে অন্তত ৪ ঘণ্টাই তার কাটে রাস্তায়। যেদিন কপাল খারাপ থাকে, আর সেটা প্রায়ই ঘটে, পথের সময়টা আরও দীর্ঘ হয়ে যায়।

যানজটের নগরীতে মোজাম্মেলের মত যাত্রীদের নতুন অভিজ্ঞতা আর স্বস্তির যাত্রার স্বপ্ন দেখিয়ে মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ।

বুধবার ঢাকার প্রথম এই বৈদ্যুতিক গণপরিবহনের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গার্ডের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তিনি সবুজ পতাকা দুলিয়ে মেট্রোরেলের যাত্রার সংকেত দেবেন। প্রথম দিন প্রথম যাত্রীও হবেন সরকারপ্রধান।

মোজাম্মেলরা মেট্রো রেলে চলে অফিসে যেতে পারবেন পরদিন থেকে। বলা হচ্ছে আগারগাঁও থেকে দিয়াবাড়ি পর্যন্ত যেতে লাগবে ২০ মিনিট। তার মানে মোজাম্মেলের মোটামুটি ঘণ্টা তিনেক বেঁচে যাচ্ছে দিনে!

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, সবকিছু পরিকল্পনামাফিক চললে মেট্রোরেলের মাধ্যমে গণপরিবহনের নতুন রূপের সঙ্গে পরিচিত হবে নগরবাসী।

বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশে ইতোমধ্যে মানুষকে মেট্রোরেলে সেবা দেওয়া হচ্ছে। কেবল চীনেই ৪৬টি মেট্রো সিস্টেম রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে রয়েছে ১৫টি করে। অবশেষে বাংলাদেশও সেই ক্লাবে যোগ দিচ্ছে। 

৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয়ে উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ চলছে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকার সহযোগিতায়।

শুরুতে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ৯টি স্টেশন চলাচলের জন্য খুলে দিচ্ছে সরকার। সব ঠিক থাকলে আগামী বছরের ডিসেম্বর নাগাদ এই ট্রেন ধরেই উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাতায়াত করা যাবে ৪০ মিনিট সময়ে।

উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত এই লাইনের নাম দেওয়া হয়েছে এমআরটি-৬। সরকারের পরিকল্পনা হল, এরকম মোট ছয়টি মেট্রো রেলপথ ঢাকার বিভিন্ন অংশকে যুক্ত করবে। এরমধ্যে একটি হবে পাতাল রেল।

সূচি ধরে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ ঢাকা যানজটের যন্ত্রণা অনেকটাই লাঘব হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। 

মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ তদারকি ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) বলছে, পূর্ণমাত্রায় চালু হলে এমআরটি-৬ প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার এবং দিনে ৫ লাখ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।

ছয়টি কোচ সম্বলিত প্রতিটি একমুখী মেট্রো ট্রেন প্রতিবারে ৪০ মিনিটে উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৭টি স্টেশনে থেমে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৩০৮ জন যাত্রীকে পৌঁছে দিতে পারবে গন্তব্যে।

 

ডিএমটিসিএলের আশা, মেট্রেরেলের কারণে শহরে ছোট ছোট যানবাহনের প্রয়োজন অনেক কমে যাবে। সেই সঙ্গে কমবে যানবাহনে জীবাশ্ম ও তরল জ্বালানির ব্যবহার। ঢাকা মহানগরীর যাতায়াত ব্যবস্থায় যোগ হবে ভিন্ন মাত্রা ও গতি। নগরবাসীর কর্মঘণ্টা সাশ্রয় হবে। সবকিছুর যোগফল হবে নগরজীবনে অনেকটা স্বস্তি।

মেট্রো রেল যে দ্রুতগতিতে, নিরাপদে ও ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে নতুন অভিজ্ঞতা দিতে পারবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হকের।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গণপরিবহন বলতে এখন পর্যন্ত ঢাকাসহ বাংলাদেশের মানুষ চিনেছে হল অরাজকতার একটা গণপরিবহন, বাসভিত্তিক যেটা আছে। এটাকে কোনো পর্যায়ে ফেলা যায় না, গণপরিবহনের সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। সেই জায়গায় মেট্র্রো সবদিক থেকে সুশৃঙ্খল একটা পরিবহনের ব্যবস্থা তৈরি করবে এবং সবার জন্য এটা একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা হবে।

“সেই হিসাবে এই মেট্রোরেলের নতুন মাত্রাটা গণপরিবহনের সংজ্ঞাকে নতুনভাবে চিনিয়ে দেবে, যারা রাস্তায় নামতে হয়, তারা এটা উপভোগ করবেন নিশ্চিতভাবে। দ্রুত গতিতে এবং স্বাচ্ছন্দে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা পূরণের জন্য মেট্রোর বিকল্প নাই।”

তবে যাত্রীদের মেট্রোতে অভ্যস্ত করার জন্য সাশ্রয়ী ভাড়া নির্ধারণ এবং মেট্রোমুখী যাত্রা সাবলিল করারও উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন এই বিশেষজ্ঞ।

প্রথম দফায় উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার মেট্রো রেল চালু করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে ডিএমটিসিএল।

কোম্পানি জানিয়েছে, বুধবার থেকে প্রথম দিকে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পথে সরাসরি চলবে মেট্রোরেল। পথের সাতটি স্টেশনে থামবে না।

ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আপাতত সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলবে মেট্রোরেল। প্রতি ১০ মিনিট অন্তর ট্রেন ছাড়বে। উত্তরা উত্তর ও আগারগাঁও স্টেশনের মধ্যে প্রতি যাত্রায় ২০০ জন করে যাত্রী বহন করবে একেকটি ট্রেন। মঙ্গলবার বন্ধ থাকবে ট্রেন চলাচল। 

যাত্রীরা অভ্যস্ত হতে থাকলে ক্রমান্বয়ে মাঝপথের স্টেশনগুলো থেকেও যাত্রী উঠানো শুরু করবে জানিয়ে এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, “আশা করছি মার্চের মধ্যে পরিপূর্ণ যাত্রী নিয়ে পুরোদমে চালাতে পারব আমরা।”

ছিদ্দিক জানান, সরাসরি চললে উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও স্টেশন পর্যন্ত সময় লাগবে ১০ মিনিট ১০ সেকেন্ড। যাত্রীদের অভ্যস্ত করতে প্রথম দিকে ১০ মিনিট থেমে যাত্রী ওঠানামার কাজ করা হবে।  

“প্রথম দিকে চার মিনিট পরপর ট্রেন চালালে জনসাধারণ এটার সাথে অভ্যস্ত হতে বা সেভাবে পরিচিত হতে পারবে না। আবার আমরা দাঁড়ানোর সময়টাকে হয়ত এক সময় ৩০ সেকেন্ডে নিয়ে আসব। কিন্তু প্রথম দিকে যদি আপনি এক-দুই মিনিট না দেন, তাহলে যাত্রীরা সহজে নামবেন-উঠবেন, এই কাজগুলো হবে না। এ জন্য প্রথম দিকে আমরা বেশি সময় দাঁড়াব।”

আগারগাঁও, মিরপুর ও উত্তরার মেট্রো রেল স্টেশন এলাকা ইতোমধ্যে বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে। আর এই ট্রেন নিয়ে মানুষেরও আগ্রহ প্রবল। ফলে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সময় যেমন উৎসবের আবহের মধ্যে মানুষের বাঁধ ভাঙা জোয়ার সামলাতে হয়েছিল কর্তৃপক্ষকে, মেট্রোরেলেও তেমন শঙ্কা থাকছে।

তবে ঢাকার পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক আত্মবিশ্বাসী, পরিস্থিতি তারা সামাল দিতে পারবেন। প্রস্তাবিত এমআরটি পুলিশ গঠন না হওয়ায় আপাতত ঢাকা মহানগর পুলিশই মোট্রোরেলের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকছে।

মাঝের সাতটি স্টেশন এখন চালু না হলেও ৯ জন করে পুলিশ সদস্য ওইসব স্টেশনে পালা বদল করে দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ কমিশনার।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী উদ্ধোধন করে চলে যাওয়ার পর কলাপসিবল গেইট বন্ধ থাকবে। দেখার জন্য অনেক মানুষ এলে কেউ উপরে উঠতে পারবে না। তাছাড়া নিচে অনেক ফাঁকা জায়গা রয়েছে। বৃহস্পতিবার টিকেট কাটতে অনেক মানুষ এলেও সমলে নেওয়া যাবে। অনেক পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে।”

কিন্তু ভাড়া?

মেট্রোরেলে চড়তে প্রতি কিলোমিটারে জন্য ৫ টাকা এবং সর্বনিম্ন ২০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করেছে সরকার। সেই হিসাবে দিয়াবাড়ির উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রত্যেক যাত্রীকে গুণতে হবে ৬০ টাকা করে।

মেট্রো রেলের বিপরীতে রাজধানীতে ডিজেল চালিত বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ৫০ পয়সা এবং সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা।

যাত্রীদের কথা বিবেচনায় নিয়ে মেট্র্রো রেলের ভাড়া ৫০ শতাংশ কমানোর দাবি জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। অন্যদিকে, মেট্রোরেলে পর্যাপ্ত যাত্রীসংখ্যা নিশ্চিত করতে ভাড়া কমানো এবং মেট্রোরেলকে কেন্দ্র করে বহুমাধ্যমভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।

মেট্রো রেলের নিম্ন আয়ের মানুষকে আকৃষ্ট করার মত ভাড়া না হওয়ার পেছনে নির্মাণ ব্যয় বেশি হয়ে যাওয়া এবং মেট্রোরেল-কেন্দ্রিক ‘নন-অপারেশনাল’ আয়ের সুযোগ সৃষ্টি না করাকে কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাদের থেকে দুর্বল অর্থনীতিতেও আছে, তারা মেট্রোর ভাড়াটা আমাদের থেকে অনেক কম রেখেছে। কেন রেখেছে? আমরা খরচ করতে জানি না, বেহিসেবিভাবে বানানোর সময় খরচ করে ফেলেছি বেশি। তুলতে গেলে এখন নিশ্চিতভাবে জনগণের উপরে বেশি চাপ দিতে হবে, এটা স্বাভাবিক।

“আমি খরচ করার ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিলাম না, আমার অক্ষমতাটা আমি চাপিয়ে দিচ্ছি ভাড়ার উপরে। এটা কিন্তু ভাবনার বিষয়। অন্যান্য দেশ পারে, আমি কেন পারি না। অন্যান্য দেশ চার-পাঁচ বছরের মধ্যে উদ্বোধন করে ফেলতে পারে, তাহলে আমি কেন পারি না।”

যাত্রীদের উপর বেশি খরচ না চাপিয়ে নন-অপারেশনাল ইনকামের দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে এ যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, “যাত্রীর ভাড়াটাকে কমিয়ে রাখলে নিজ থেকে না চাইলেও ফেয়ারের অ্যাট্রাকশনে সে উঠে আসবে। এর নাম হল একসেসেবল অ্যাফোর্ডেবল ফেয়ার।

“আমি বাসকেটের মধ্যে একটাই রেখেছি, রেভিনিউ স্কিম। তার মানে বোঝা যায়, একবিংশ শতাব্দীর যেই পরিপক্ক নলেজ, সেটা আমরা কাজে লাগাই নাই। শুধু যাত্রী থেকে (টাকা) তুলছি। কলকাতাতেইতো ১৭% নন-অপারেশনাল সার্ভিস থেকে আসছে। তাহলে আমি কেন পারলাম এতদিন পর এসে।”

ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে কৌশলী হওয়া প্রয়োজন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এখন যারা ঝুলে ঝুলে যাচ্ছে, লেগুনাতে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে? পাঁচ টাকায় যাওয়া যায়। এদের কাছে কমফোর্ট থেকেও টাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্রুপটাকে অ্যাট্রাক্ট করতে না পারলে (মেট্রোরেলের) নিচের রাস্তায় কিন্তু কিলবিল করবে।

“হোক ওই সনাতনী পদ্ধতি, কমফোর্ট নেই। কিন্তু একেকজনের অগ্রাধিকার একেক রকম। ডেমোগ্রাফির বটমে যারা আছে, এরা দেখবে তার জন্য ভাড়াটা দুবেলা অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে কি না। সুতরাং তারা আগের মতই যাবে এবং বিভিন্নভাবে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। যে শৃঙ্খলা আসার কথা, প্রত্যাশা অনুযায়ী সেটা হবে না।”

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য বলেছেন, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি ও দ্রুত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর কথা বিবেচনায় নিয়ে ভাড়ার এই হার নির্ধারণ করা হয়েছে।

বুধবার আগারগাঁও মেট্রো স্টেশনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আমি একটা কথা ইন-জেনারেল বলি, এখন যে অবস্থা ঢাকা সিটিতে, আপনি উত্তরা থেকে কমলাপুরে আসবেন, ১০০ টাকায়। কত মিনিটে আসছেন? ৩৮ মিনিটে। তাহলে কোথায় লস হল?

“প্রতিটি আনন্দের সঙ্গে যন্ত্রণা থাকে। ভাড়া একটা বিষয়, এটা কখনো জেনারেলি একসেপ্টেবল হবে না, কোথাও। কিন্তু বাস্তবে সবাই একসেপ্ট করবে। মিনিমাম রিকশা ভাড়া এখন ২০ টাকা, এটা কি ভাবেন?”

আর ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, “আপনাকে একটু দেখতে হবে, কোন মেট্রোরেলটা কোন সময়ে হয়েছে। আপনি নিশ্চয় কলকাতার মেট্রোতে চড়েছেন, এটা কখন হয়েছে এটা একবার একটু চিন্তা করে দেখেন।… কলকাতার মেট্রোরেলের কী ফ্যাসিলিটিজ আছে এখানকার মেট্রোরেলের কী ফ্যাসিলিটিজ আছে, সেটা আপনি দেখেন। এই মেট্রোরেল কতটুকু সময় সাশ্রয়ী, সেটা আপনি একটু দেখে নেবেন।”

গার্ডের ভূমিকায় প্রধানমন্ত্রী

ওবায়দুল কাদের জানান, বুধবার বেলা ১১টায় উত্তরার ১৫ নম্বর সেক্টরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানস্থলে যাবেন প্রধানমন্ত্রী। ধাপে ধাপে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা শেষে দুইশ জন আমন্ত্রিত অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে মেট্রোরেলে চেপে তিনি আগারগাঁও প্রান্তে যাবেন।

পদ্মাসেতুর উদ্বোধনের আদলে মেট্রোরেল উদ্বোধনের দিনও একটি সুধী সমাবেশ হবে। উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরে সেই অনুষ্ঠানে মেট্রোরেলের ফলকের একটি প্রতিরূপ উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী।

“বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে পয়রা অবমুক্তকরণ ও ফায়ারওয়ার্কসের পরিকল্পনা থাকলেও সেটা বাদ দেওয়া হয়েছে। বেলা ১১টা ২০ মিনিটে মোনাজাত হবে,” বলেন ওবায়দুল কাদের।

তিনি জানান, সুধি সমাবেশ শুরু হবে ১১টা ২৫ মিনিটে। ডিএমসিটিএল এমডি এম এ এন ছিদ্দিকের সঞ্চালনায় সেখানে কয়েকজন বক্তব্য দেবেন।

“সচিব সাহেব স্বাগত বক্তব্য দেবেন, জাপানের রাষ্ট্রদূত বক্তব্য দেবেন। এরপর সভাপতির বক্তব্য দেব আমি। ১২টা ২৫ মিনিটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেবেন। এরপর এরিয়াল ভিউ প্রদর্শনী হবে। থিমসং পরিবেশন হবে।”

সুধী সমাবেশে বক্তব্য শেষে উত্তরা উত্তর স্টেশন পরিদর্শন করবেন শেখ হাসিনা। মূল ফলক পরিদর্শন করে ফলকের পাশে একটি তেঁতুল গাছের চারা রোপন করবেন। এরপর সেখান থেকে প্ল্যাটফর্মে উঠে টিকিট মেশিন ব্যবহার করে টিকেট কিনবেন।

ওবায়দুল কাদের বলেন, “সেখানে তাকে মেট্রোরেল ও প্ল্যাটফর্মগুলো সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হবে। প্ল্যাটফর্মে প্রধানমন্ত্রী সবুজ পতাকা নেড়ে বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেলের চলাচলের শুভ সূচনা করবেন। স্মারক হিসাবে সবুজ পতাকায় স্বাক্ষর করবেন।”

পরে প্রধানমন্ত্রী তার জন্য সংরক্ষিত কোচের দরজায় ফিতা কেটে ট্রেনে উঠবেন। ট্রেন তিনি আমন্ত্রিত অতিথির সঙ্গে কুশল বিনিময় করবেন। তারপর আগারগাঁও স্টেশনে নেমে প্রধানমন্ত্রী সেখান থেকে গণভবনে ফিরবেন।

মেট্রোরেলের উদ্বোধন উপলক্ষে এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেলের উদ্বোধন দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে একটি ‘অনন্য মাইলফলক’।

“মেট্রোরেলের যাত্রা ঢাকা মহানগরীর যাতায়াত ব্যবস্থায় ভিন্ন মাত্রা ও গতি যোগ করবে। নগরবাসীর কর্মঘণ্টা সাশ্রয় হবে। প্রকল্পটি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।

“মেট্রোরেল চালুর মাধ্যমে ঢাকা মহানগরী তথা দেশের যোগাযোগ ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশেষ করে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও এর সুফল পাওয়া যাবে।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে মেট্রোরেলকে বর্ণনা করেন বাংলাদেশের ‘গর্ব ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক’ হিসেবে।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেলের উদ্বোধন ঢাকা মহানগরবাসীর বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্ন। ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট লাইন-৬ এর উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের শুভ উদ্বোধনের মাধ্যমে মহানগরবাসীর সেই স্বপ্ন পূরণ হল। মেট্রোরেল উদ্বোধনের এ মাহেন্দ্রক্ষণে আমি দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।”

প্রথম মেট্রোরেল উদ্বোধনের বাণীতেই দেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেল নির্মাণ শুরুর সুখবর দিয়ে তিনি বলেন, “পরিকল্পনা অনুযায়ী শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের আওতায় চারটি মেট্রোরেল লাইনের নির্মাণ বিভিন্ন পর্যায়ে বাস্তবায়নাধীন আছে। আগামী মাসেই বাংলাদেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ শুরু হতে যাচ্ছে।”

মেট্রোরেলের যাত্রা পথে

২০১৬ সালে ২৬ জুন এমআরটি-৬ প্রকল্পের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাড়ে ছয় বছর পর তিনিই এ নতুন বাহনের উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন।

ঢাকায় অসহনীয় হয়ে ওঠা যানজট নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগিতায় ২০০৫ সালে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) প্রণয়ন করে বাংলাদেশ সরকার। ২০ বছর মেয়াদি (২০০৪-২০২৪) ওই পরিকল্পনায় মেট্রোরেল, বাসভিত্তিক উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা-বিআরটিসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ আসে।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ।জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে সমীক্ষা পরিচালনার পর সবার আগে ‘এমআরটি লাইন-৬’ নির্মাণের সুপারিশ আসে। পরের বছরই ওই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করে জাইকা।

ওই সমীক্ষায় প্রথমে উত্তরা থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। পরে তা পরিবর্তন করে মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত (২০.১০ কিলোমিটার) করার সিদ্ধান্ত হয়।

২০১১ সালে ‘ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬ নির্মাণ’ প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। পরের বছরের ১৮ ডিসেম্বর একনেক সভায় প্রকল্পটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা।

এর মধ্যে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা জাপান সরকারের আর বাকি ৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিলে থেকে যোগান দেওয়ার কথা ছিল। ২০২৪ সালে মধ্যে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল সে সময়।

উড়াল এই মেট্রোরেল বাস্তবায়নে ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জাইকার সঙ্গে ঋণ চুক্তি করে সরকার। সে বছরই সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি (ডিএমটিসিএল) নামে বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণকারী কোম্পানি গঠন করা হয়।

২০১৫ সালে জাপানের সহায়তায় এসটিপি সংশোধন (আরএসটিপি) করে মেট্রোরেলের রুট সংখ্যা বাড়ানো হয়। পরের বছরের ২৬ জুন এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নির্মাণকাজ উদ্বোধনের কয়েক দিনের মাথায় ঢাকার হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার কারণে কাজ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও ফলে সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন আশ্বাসে কাজ পুনরায় চালু হয়।

২০১৬ সালের শেষ ভাগে মেট্রোরেলের ডিপো নির্মাণে কাজ শুরু হয়। পরের বছর দুটি প্যাকেজের মাধ্যমে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে পাইলিংয়ের কাজ শুরু করে।

প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতার ৫০ বছরে মেট্রোরেল উদ্বোধনের ইচ্ছা প্রকাশ করলেও বাধ সাধে কোভিড মহামারী। লকডাউনের কবলে পড়ে পিছিয়ে যায় নির্মাণকাজ। ফলে শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আর স্বপ্নের পথচলা শুরু করা সম্ভব হয়নি।

এর মধ্যে গত ১৯ জুলাই মাসে প্রকল্পটির মেয়াদ দেড় বছর এবং প্রায় ১১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয় একনেক সভায়। ফলে মোট ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা।

সংশোধিত প্রস্তাব অনুযায়ী মতিঝিল থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত আরও ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার মেট্রোরেল বাড়ানো হবে। সেই অতিরিক্ত কাজসহ প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

মিশে আছে শোক

ঢাকার মেট্র্রো রেলের প্রকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শোকের ঘটনাও। নির্মাণকাজ উদ্বোধনের কিছুদিন পর ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় সাত জাপানি নাগরিক নিহত হন।

ওই হামলায় মোট ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল জঙ্গিরা। দুই নারীসহ সাত জাপানি নাগরিকের মধ্যে ছয় জন ছিলেন দুটি মেট্রো রেল প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত।

গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল প্রকল্প পর্যন্ত এমআরটি-১ এবং নারায়ণগঞ্জের ভুলতা থেকে বাড্ডা, মিরপুর গাবতলী, ধানমণ্ডি, বসুন্ধরা সিটি (পান্থপথ) হয়ে হাতিরঝিল লিংক রোড পর্যন্ত এমআরটি-৫ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাছাইয়ের কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন তারা।

ওই হামলার পর জাইকা ও ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদুতসহ বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করা বেশির ভাগ জাপানি নিজ দেশে ফিরে যান। পরে বাংলাদেশের তরফ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে সেপ্টেম্বরে জাপানিদের ফিরিয়ে আনা হয়।

হামলায় নিহতদের মধ্যে হিরোশি তানাকা, হিদেকি হাশিমতো ও নোবুহিরু কুরোসাকি ছিলেন ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্টস গ্লোবাল লিমিটেডের কর্মকর্তা। আর নিহত ওকামুরা মাকোতো, ইউকো সাকাই, শিমোদায়রা রুই ছিলেন এএলএমইসি করপোরেশনের কর্মকর্তা।

বাকি একজন কোহিও ওগাসাওয়ারা ছিলেন কাটাহিরা অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যুক্ত। তবে মেট্রো রেলের কাজে তার সম্পৃক্ততা ছিল না।

এছাড়া হলি আর্টিজানে হামলায় আহত হয়েছিলেন যানজট নিরসনের জন্য প্রণয়ন করা কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার (এসটিপি) সংশোধন দলের প্রধান ওয়াতানা বি তামাকি। এমআরটি লাইন-১ ও ৫-এর সম্ভাব্যতা যাছাই দলের প্রধানও ছিলেন তিনি।

জাপানি নাগরিকদের নামে মেট্রো রেল স্টেশনের নামকরণের আলোচনা এক সময় উঠলেও প্রথম মেট্রোরেলের বেলায় তা হয়নি। চলতি বছরের জুলাইয়ে উত্তরার দিয়াবাড়িতে মেট্রো রেল ডিপোতে নিহতদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে ‘জীবন উৎসর্গকারী’ এই জাপানিদের স্মৃতির প্রতি ‘গভীর শ্রদ্ধা’ জানিয়েছেন।

মিরপুর-উত্তরায় খুশির জোয়ার

দেশের অন্যতম বড় এ অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নগরবাসীকেও কম তিতিক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি।

যে পথ দিয়ে ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের পথ গেছে, বলতে গেলে সেটা রাজধানীর মেরুদণ্ড। রাস্তার মাঝ বরাবর দখল করে সেখানে বসানো হয়েছে উড়াল রেলপথের পিয়ার, নির্দিষ্ট দূরত্বে নির্মাণ করা হয়েছে স্টেশন। চারপাশে রাখা ছিল নির্মাণ সামগ্রী। 

ফলে টানা কয়েক বছর চলাচলের পথ ছিল সরু, যার অবশ্যম্ভাবী ফল হল অসহনীয় যানজট। আর এর ফলে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে মিরপুরবাসীকে। 

সেই দীর্ঘ কষ্টের দিন পেরিয়ে মেট্রো রেল পেয়ে খুশির কথা জানিয়েছেন মিরপুর, উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। তবে পুরো সুবিধা পেতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে তাদের।

গণপরিবহনে চড়লে ভোগান্তি পোহাতে হবে, এই বাস্তবতা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না ঢাকাবাসীর। সেখানে মেট্রোরেল চালু হলে নারী, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীরা বিশেষভাবে উপকৃত হবে বলে মনে করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক।

বাসে চড়ার যে ঝক্কি, তা থেকে রেহাই মিলবে জেনে ‘স্বপ্নের মত’ মনে হচ্ছে মিরপুর-১১ নম্বরের বাসিন্দা বিথি আক্তারের।

সম্প্রতি পড়াশোনোর গণ্ডি পেরোনো এই নারী বলেন, “বাসে যে ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়, আসন পাওয়া নিয়ে লড়াই করতে হয়, আর ধাক্কাধাক্কির কথা নাই বা বললাম; ট্রেনে এ ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পাব আশা করি।”

নারীবান্ধব সুযোগ-সুবিধা যেন ঠিকমত ধরে রাখা হয়, সে দাবি জানিয়ে বিথি আক্তার বলেন, “নারীদের জন্য আলাদা কোচ রাখা হবে শুনেছি, এটাতো আমাদের কাছে স্বপ্নের মত।

“জানতে পেরেছি, ওখানে বাচ্চাদের ডায়াপার পরিবর্তনসহ আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা আর নানা রকম নারীবান্ধব সুযোগ-সুবিধা থাকবে। অন্য পরিবহনে চলার ক্ষেত্রে এসব তো ভাবাও যায় না।”

মিরপুর ১২ নম্বরে বাসস্ট্যান্ডের কাছেই একটি স্টেশনারি দোকানে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা রোমানের সঙ্গে। তার কথায়, এই মেট্রোরেল নির্মাণ কাজের সময়ে মিরপুরবাসীকেই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। আর এখন সবার আগে তারাই মেট্রোরেলের সুফল ভোগ করতে যাচ্ছে।

পথ আর সময়ের হিসাব তুলে ধরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখান থেকে বাসে মিরপুর ১০ কিংবা আগারগাঁও আইডিবি যেতে আগে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা লেগে যেতে। এখন আমরা চলে যাব কয়েক মিনিটে। ভাড়া যাই হোক, এখন মানুষের সময়েরও একটা মূল্য আছে।

“সেই হিসাবে আপনি বলতে পারেন- মেট্রোরেল এই এলাকার মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় বিপ্লবের সূচনা করবে। মিরপুর থেকে উত্তরাগামী বাসের যাত্রীও কম না। কালশী, ইসিবি, কুড়িল, বিমানবন্দর হয়ে উত্তরা যাওয়ার ঝামেলা এখন আর কেউ নেবে বলে মনে হয় না। সোজা মেট্রোরেলে চেপে দিয়াবাড়ি নেমে যাবে; সেখান থেকে যাবে যার যার গন্তব্যে। এতে খরচও বাঁচবে, সময়ও বাঁচবে।”

ইন্দিরা রোডের বাসিন্দা তাহমিনা সুলতানা চাকরি করেন মিরপুর ১২ নম্বরে একটি বেসরকারি ব্যাংকে। মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজের সময়টার কথা মনে করে এই নারী বলেন, “এই কাজ কতদিনে শেষ হবে সেই অপেক্ষায় ছিলাম। এমনও দিন গেছে অফিসে যেতে দুই-আড়াই ঘণ্টা সময় লেগে গেছে। গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি।"

শুধু পথের কষ্ট নয়, মিরপুরের বইখাতার দোকানি রাজিব শেখের ব্যবসাও লাটে উঠতে বসেছিল উন্নয়ন কাজের যন্ত্রণায়। তার মত রাস্তার পাশের সব দোকান আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকেই ভুগতে হয়েছে গত কয়েক বছর। বিক্রি কমে যাওয়ায় অনেক দোকান বন্ধও হয়ে গেছে।

“মেট্রোরেলের কাজ শেষ হওয়ায় গত কিছুদিন ধরে ভালো আছি। মেট্রোরেল চালু হলে এই এলাকা আগের চেয়ে দ্বিগুণ সরগরম হবে। এখানে অনেক নামকরা স্কুল-কলেজ আছে। পাশেই ক্যান্টনমেন্ট এলাকা। রোকেয়া সরণির দুই পাশেও বড় জায়গা নিয়ে আবাসিক এলাকা। আমাদের বেচাবিক্রিও বাড়বে।”

শেরেবাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসনুভা ইসলামের বাসা পল্লবীতে। নির্মাণ কাজের সময়টায় যানজটে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হলেও এখন মেট্রোরেল চালু হওয়ার খবরে আনন্দের শেষ নেই তার।

তাসনুভা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললো, "মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বর থেকে আমার স্কুলে যেতে অনেক সময় লেগে যেত। আগারগাঁও পর্যন্ত আসতে দেড় থেকে দুই ঘন্টা সময় যেত। এখন মেট্রোরেল চালু হলে আমার অনেক সময় বেঁচে যাবে।

“আর মেট্রোরেলে যাতায়াত করাটাও সেইফ হবে। আমার খুবই ভালো লাগছে। কবে যে রেলে চড়ে স্কুলে যাব, সেই অপেক্ষায় আছি।"

অপেক্ষায় আছেন আগারগাঁও তালতলার মোজাম্মেল হোসেনও, যার অফিস যাতায়াতেই দিনে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা ঝরে যায়।

তিনি বললেন, “এখন আর বিধ্বস্ত হয়ে অফিসে পৌঁছাতে হবে না। খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বাসায় ফিরতে হবে না। পরিবারকে আরেকটু বেশি সময় দিতে পারব। এইটুকুতো টাকা দিয়ে কেনা যাবে না।” 

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন জাফর আহমেদ, কামাল তালুকদার, ফয়সাল আতিক ও কাজী নাফিয়া রহমান]