বিশ্ব শিশু দিবস সামনে রেখে রোববার কক্সবাজারের রয়েল টিউলিপ সি পার্ল বিচ রিসোর্টে এই আলোচনার আয়োজন করে বাংলাদেশে শিশু সাংবাদিকতার প্রথম ওয়েবসাইট ‘হ্যালো’। ‘ঝুঁকিতে রোহিঙ্গা শিশু’ শিরোনামে এই আয়োজনের সঙ্গে ছিল জাতিসংঘের শিশু তহবিল-ইউনিসেফ।
কক্সবাজারের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া ২০ জন শিশু সাংবাদিক এ আলোচনায় অংশ নেয়, যারা প্রশিক্ষণ শেষ করেই শনিবার বালুখালি ও কুতুপালং ক্যাম্প ঘুরে রোহিঙ্গা শিশুদের দুর্দশার চিত্র ধারণ করেছে ভিডিওতে।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, সোমবার বিশ্ব শিশু দিবসে জাতিসংঘের দায়িত্ব দেওয়া হবে শিশুদের, ইউনিসেফেও তেমন উদ্যোগ নেওয়া হবে।
“আমাদের (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের) মূল বার্তা কক্ষেও তোমাদের পদচারণা থাকবে। তোমরা যখন ঢাকায় যাবে, তখন দেখবে, তোমাদের জন্য আলাদা ডেস্ক আছে।”
আলোচনায় উপস্থিত শিশুদের কাছে তৌফিক ইমরোজ খালিদী জানতে চান, তাদের যদি সোমবার সব রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়, কী করবে তারা। কোথায় কোন ধরনের পরিবর্তন তারা আনবে।
এই প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে শিশু সাংবাদিকদের প্রায় সবাই তুমুল উৎসাহের সঙ্গে জবাব দিতে হাত তোলে। তবে শেষ পর্যন্ত সুযোগ পায় তিনজন।
কক্সবাজারের সৈকত বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লামিয়া আক্তার জানায়, শনিবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে সে দেখছে গর্ভবতী মায়েদের কষ্ট।
“আমি দেখেছি, গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টির ব্যবস্থা হচ্ছে না। আমি অনেকের বাসায় ঘুরে ঘুরে এটা দেখেছি।
“মহিলারা লজ্জায় খাবার নিতে আসতে চায় না। আমি দায়িত্ব পেলে তাদের বাসায় বাসায় পুষ্টি পৌঁছে দিতাম।”
ইউনিসেফের পক্ষে এ আলোচনায় অংশ নেন সংস্থার মুখপাত্র শাকিল ফয়জুল্লাহ। অনুষ্ঠানটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং এর ফেইসবুক পাতায় দেখানো হয় সরাসরি।
অনুষ্ঠানের শুরুতে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, জাতিসংঘ বলছে- এ পর্যন্ত ছয় লাখ ১৩ হাজার মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে; বর্মি সেনাবাহিনীর জাতিগত নিপীড়নের মুখে তারা তাদের পিতৃপুরুষের আবাসভূমি আরাকান বা রাখাইন থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
“বাংলাদেশ সরকারের হিসেবে এই সংখ্যা আরও কিছু বেশি। জাতিসংঘ শিশু তহবিল বা ইউনিসেফ বলছে এই ছয় লাখ ১৩ হাজারের ষাট শতাংশই শিশু। আর দেশান্তরি হতে গিয়ে বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা খুব কম নয়।”
ইউনিসেফ বলে আসছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া এই শিশুদের অনেকেই মারাত্মক পুষ্টিহীনতার শিকার। নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক ক্ষত নিয়ে তারা বাংলাদেশে পৌঁছেছে। নিরাপদ পানির সঙ্কটের কারণে সংক্রামক রোগের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তারা।
আলোচনার এক পর্যায়ে শিশু সাংবাদিক নওরিন হুদা অমির কথাতেও এ বিষয়টি আসে। ক্যাম্পে নিরাপদ খাবার পানি আর পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার সঙ্কটের যে চিত্র সে আলোচনায় তুলে ধরে।
পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি ঠেকাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে- আলোচনায় তা জানতে চান তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
ইউনিসেফের শাকিল ফয়জুল্লাহ বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন খাবার পানি লাগে ৯০ লাখ লিটার। এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিরাপদ পানি সরবরাহ করা কঠিন।
“সবাই (সহায়তা সংস্থা) আসার পর অনেক টয়লেট তৈরি করেছে। সম্প্রতি জানতে পেরেছি, সেই সময়কার টয়লেটের ৩৮ শতাংশ এখন ব্যবহারের উপযোগী নয়, কারণ বিপুল সংখ্যক মানুষ সেগুলো ব্যবহার করে।”
পানি ও পয়নিষ্কাশনে বড় ঝুঁকি থেকে গেলেও রোহিঙ্গা শিবিরে মাত্র এক মাস সময়ের মধ্যে প্রায় ৭ লাখ মানুষকে কলেরার টিকা দেওয়ার কর্মসূচি শেষ করতে পারাকে একটি বড় সফলতা হিসেবে দেখছেন শাকিল ফয়জুল্লাহ। তিনি জানান, সংখ্যার দিক দিয়ে এটাই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কলেরার টিকাদান কর্মসূচি।
কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইদুল ইসলামের চোখে লেগেছে অল্প বয়সী শিশুদের ভারী শ্রমের বিষয়টি। লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নেওয়া থেকে শুরু করে যার যার ঘরে পানি নিয়ে যাওয়ার কাজটি অনেক ক্ষেত্রেই করতে হয় তাদের।
এই শ্রম ঠিক টাকার জন্য না হলেও বয়স অনুযায়ী তাদের জন্য কষ্টসাধ্য বলে মনে হয়েছে শিশু সাংবাদিক সাইদুলের কাছে।
সাইদুল বলে, অনেক সময় পরিবারের বেশি বয়সী সদস্যদের বদলে ত্রাণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় শিশুদের পিঠে, অথচ তাদের শরীর এখনো ওই মাপের বোঝা বহনের উপযুক্ত নয়।
“আমি দেখেছি শিশুরা কীভাবে ভারী বস্তু বহন করছে।… তাদের বাবা থাকার পরও তাদের ওই ভারী বস্তু বহন করতে দেওয়া হচ্ছে। আমি চেষ্টা করতাম শিশু শ্রম ওখানেই বন্ধ করতে।”
শিশু সাংবাদিকরা জানায়, কোনো কোনো পরিবারে একাধিক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ থাকায় তারা অনেকবার ত্রাণ নিতে পারছে। আবার কোনো কোনো পরিবারে তেমন কেউ না থাকায় তারা ঠিকমত ত্রাণই পাচ্ছে না।
ত্রাণ নিয়ে এই ‘অব্যবস্থাপনা’ বন্ধে একটি প্রস্তাব রাখে সদ্য প্রশিক্ষিত শিশু সাংবাদিক জান্নাতুন নাঈম জেরিন।
ক্যাম্পের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে সে বলে, সেখানে রোহিঙ্গাদের ছাউনির নম্বরসহ পরিবারগুলোকে চিহ্নিত করার একটা ব্যবস্থা ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে। দায়িত্ব পেলে ত্রাণ বিতরণে শৃঙ্খলা ফেরাতে এটাকেই সে কাজে লাগাবে।
তার মতে, প্রত্যেক পরিবারকে কার্ড অনুযায়ী ত্রাণ দেওয়া গেলে এক পরিবার থেকে একজনের বেশি ত্রাণ নিতে পারত না। অন্যদিকে ত্রাণের লাইনে দাঁড়ানোর মত সামর্থ্যবান কেউ যে পরিবারে নেই, তাদেরও ত্রাণ দেওয়া যেত।
আলোচনায় অংশ নেওয়া ৯ কিশোরী আর ১১ কিশোর কক্সবাজারের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী। গত শুক্রবার রয়েল টিউলিপেই তাদের শিশু সাংবাদিকতা, ভিডিও ধারণ ও সম্পাদনার প্রশিক্ষণ শেষ হয়।
এরপর শনিবার রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে ঘুরে রোহিঙ্গা শিশু আর তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছে তারা।
ত্রাণ, পানি আর পয়নিষ্কাশন ছাড়াও কক্সবাজারে বন উজাড় করে বসতি স্থাপন, রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষাজীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা, এইডস ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা, কিশোরী মায়েদের কষ্ট, কঠিন মানসিক আঘাত এবং মিয়ানমারে ফেরা নিয়ে তাদের ভাবনার কথা আলোচনায় তুলে ধরেছে এই শিশু সাংবাদিকদের দল।