স্বাধীনতাযুদ্ধের দিনগুলোতে বাঙালির পাশে দাঁড়ানো বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা জানাতে রোববার আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ; ধর্মান্ধ নয়। তারা একাত্তরের চেতনায় উদ্ধুদ্ধ; ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণে তারা বদ্ধপরিকর।”
সম্মাননা নিতে আসা বিদেশি অতিথিদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এই সংগ্রামে আমরা আপনাদের সমর্থন ও শুভেচ্ছা চাই। আমি নিশ্চিত ১৯৭১ সালে বাংলার মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে যেভাবে আপনারা সমর্থন দিয়েছিলেন, আজকেও একইভাবে একটি দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে আপনাদের নৈতিক সমর্থন প্রয়োজন। আশা করি, এই সমর্থন আমরা পাব।”
একাত্তরে এ দেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন এবং সে সময় বিদেশি বন্ধুদের অবদানের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের বিদেশি মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা বাংলাদেশের নিরীহ জনগণের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। আপনারা নিজ নিজ দেশের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির উপরও প্রভাব বিস্তার করতে সহায়তা করেন।”
সেই অবদানের জন্য তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অনেক বন্ধুই ইতোমধ্যে আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন। আমি তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আপনাদের অনেকেরই বয়স হয়েছে। তবু আপনারা কষ্ট করে এখানে উপস্থিত হয়েছেন, এজন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো এবং যুক্তরজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লর্ড হ্যারল্ড উইলসনের পক্ষে কিউবার রাষ্ট্রদূত ও হ্যারল্ড উইলসনের ছেলে অধ্যাপক রবিন উইলসন ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ গ্রহণ করেন।
একাত্তরের পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশি যৌথ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ জেনারেল জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুসহ ৬৭ বিদেশি বন্ধুকে দেয়া হয় ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’।
শেখ হাসিনা বলেন, “আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে যেমন এক নজিরবিহীন রক্তপাত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ; তেমনি নজিরবিহীন আমাদের বিদেশি বন্ধুদের অকুণ্ঠ সমর্থন।”
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানান।
“এই অনুষ্ঠান আমরা উনার (জিল্লুর রহমান) প্রতি উৎসর্গ করলাম”, বলেন তিনি।
বিদেশি বন্ধুদের সহায়তার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব বিদেশি বন্ধুরা সহযোগিতা করেছিলেন, বিজয় অর্জনে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য।”
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালির উপর অসম যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। তারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা শুরু করে।
“সেই দুঃসহ কঠিন সময়ে বাংলাদেশের বিপন্ন, অত্যাচারিত ও অসহায় মানুষের আর্তি আপনাদের বিচলিত করেছিল। বহুদূরে থেকেও স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারকামী একটি জনগোষ্ঠীর পাশে এসে দাঁড়াতে আপনারা বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করেননি।”
সরকার প্রধান বলেন, “গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ এমন কোন ঘৃণ্য অপরাধ নেই যা বাঙালি জাতির ওপর নেমে আসেনি। বাঙালি জাতির সেই ক্রান্তিকালে আপনাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার বড় বেশি প্রয়োজন ছিল।”
“আমরা এজন্য আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ এবং চিরঋণী। আপনাদের এই অবদান, এই ঋণ পরিশোধ করার নয়।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী এমন কোনো অপরাধ নেই, যা এ দেশের জনগণের ওপর নেমে আসেনি।
“আমাদের জনগণ যখন মরণপণ মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত, সেসময় আমরা বিদেশি বন্ধুদের কাছ থেকে অকুণ্ঠ সমর্থন পাই। আমাদের সংগ্রাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক জনসমর্থন পায়। বিশ্ব গণমাধ্যমে আমাদের দুঃখ-দুর্দশা ব্যাপক প্রচার পায়।”
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধুদের সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা সম্মাননা দেয়া হয় ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। গত বছরের ২৫ জুলাই তার পূত্রবধূ সোনিয়া গান্ধীর হাতে এই সম্মাননাপত্র তুলে দেয়া হয়।
এরপর গতবছর ২৭ মার্চ দ্বিতীয় পর্বে ৮৩ জন, তৃতীয় পর্বে গত ২০ অক্টোবর ৬১ জন, গত ১৫ ডিসেম্বর চতুর্থ পর্বে ৬০ বিদেশি বন্ধু এবং গত ৪ মার্চ ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সম্মাননা দেয়া হয়।