সম্মাননা পেলেন ৬৯ বিদেশি বন্ধু

একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের দিনগুলোতে বাঙালির পাশে দাঁড়ানো আরো ৬৯ বিদেশি বন্ধুকে সম্মাননা জানিয়েছে বাংলাদেশ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 March 2013, 11:31 PM
Updated : 29 May 2016, 01:31 PM

এই বন্ধুদের মধ্যে রয়েছেন কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো ও যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লর্ড হ্যারল্ড উইলসন (মরণোত্তর)।

রোববার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তাদের প্রতিনিধিদের হাতে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননার’ ক্রেস্ট তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

আর একাত্তরের পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশি যৌথ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুসহ ৬৭ বিদেশি বন্ধুর অবদান স্মরণ করে দেয়া হয় ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’।

এবারই প্রথম ১৩ জন পাকিস্তানি নাগরিককে বন্ধুত্বের স্বীকৃতি হিসাবে এই সম্মাননা দেয়া হলো, যারা একাত্তরে নিজেদের দেশের অবস্থানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাঙালির ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছিলেন।     

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এটি ছিল বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননার ষষ্ঠ পর্বের অনুষ্ঠান। অনেককেই এবার মরণোত্তর এই সম্মাননা দেয়া হয়। তাদের পক্ষে তাদের পরিবারের সদস্য বা প্রতিনিধিরা সম্মাননাপত্র গ্রহণ করেন।   

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। প্রথমে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বিদেশি বন্ধুদের পরিচিতি ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানের কথা তুলে ধরেন।

রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে সম্মাননা তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “এই অনুষ্ঠান আমরা উনার (জিল্লুর রহমান) প্রতি উৎসর্গ করলাম।”

একাত্তরে ভূমিকার জন্য বিদেশি বন্ধুদের বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে যেমন এক নজিরবিহীন রক্তপাত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ; তেমনি নজিরবিহীন আমাদের বিদেশি বন্ধুদের অকুণ্ঠ সমর্থন।”

যুদ্ধাপরাধের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বিচার বন্ধে কোনো জঙ্গিবাদী কৌশল বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেবে না জানিয়ে এ সংগ্রামেও একাত্তরের বিদেশি বন্ধুদের সমর্থন চান প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “এই সংগ্রামে আমরা আপনাদের সমর্থন ও শুভেচ্ছা চাই। আমি নিশ্চিত ১৯৭১ সালে বাংলার মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে যেভাবে আপনারা সমর্থন দিয়েছিলেন, আজকেও একইভাবে একটি দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে আপনাদের নৈতিক সমর্থন প্রয়োজন। আশা করি, এই সমর্থন আমরা পাব।”

এবার ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ পেয়েছেন কিউবার নেতা যিনি একাত্তরে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। 

কাস্ত্রোর পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন কিউবার রাষ্ট্রদূত।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পার্টির লর্ড হ্যারল্ড উইলসন ছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিরোধী দলীয় নেতা। সেই অন্যায্য যুদ্ধে পাকিস্তানকে কোনো ধরনের সহযোগিতা না দেয়া এবং পাকিস্তানের হাতে বন্দি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তুলে ধরেন।   

হ্যারল্ড উইলসনের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে সম্মাননা গ্রহণ করেন তার ছেলে অধ্যাপক রবিন উইলসন।

যারা ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ পেয়েছেন, তাদের মধ্যে ভারতের সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা হিরণ্য কুমার ভট্টাচার্য মুক্তি বাহিনীর প্রশিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষক নেতা অধ্যাপক মৃন্ময় ভট্টাচার্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন করেন। আগরতলার চিকিৎসক ও ক্রীড়া সংগঠক রূপেন্দ্র চন্দ্র ভৌমিক সীমান্তে অসুস্থ ও আহত শরণার্থীদের জন্য বাড়িয়ে দেন সহায়তার হাত।

সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমীয় কে চৌধুরী তার সহকর্মী ও বন্ধুদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সহায়তায় অর্থ সংগ্রহ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ছবি এঁকে প্রদর্শনী করে সংগৃহীত অর্থ বাংলাদেশের তহবিলে জমা দেন চিত্রশিল্পী ধীরাজ চৌধুরী; বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে দারুণ ভূমিকা রাখে তার সেসব ছবি।

একাত্তরে ত্রিপুরার সোনামুড়ার মহকুমা অফিসার ও লেখক হিমাংশু মোহন চৌধুরী বাংলাদেশি শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেন। আগরতলার শরণার্থী শিবিরগুলোতে বন্ধু হয়ে বাংলাদেশিদের পাশে দাঁড়ান সমাজসেবী শিক্ষক ও সাহিত্যিক রাখাল চন্দ্র রায় চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে তার লেখা ‘মরণ সাগরে জীবন সূর্য’ সমাদৃত হয়।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক চিফ অব স্টাফ জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরী একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির মাধ্যমে শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন সমাজকর্মী সন্দ্বীপ দাস। অধ্যাপক ও লেখক মিহির কান্তি দেব শরণার্থীদের কাছ থেকে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশ এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অনুষ্ঠান প্রচারের পাশাপাশি শরণার্থীদের জন্য খাবার ও ওষুধ সংগ্রহে ভূমিকা রাখেন। চিত্রশিল্পী জগদিশ চন্দ্র দের আঁকা ছবিতে ফুটে ওঠে পাকিস্তানিদের নির্যাতন ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা। 

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিন মাস বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনী করে বাংলাদেশের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন যাদুকর পি সি সরকার জুনিয়র। মুক্তিযুদ্ধের সেই সব দিনে নিয়মিত বেতন না পেয়েও কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশনে বাংলাদেশের জন্য নিরলস কাজ করে যান কমিশনের ভারতীয় কর্মী মুনশী মোহাম্মদ ফজলে কাদের। ব্যাপক করতালির মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা পদক নেন তিনি।

একাত্তরে জনমত গঠন ও বাংলাদেশি শরণার্থীদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন পশ্চিমবঙ্গের অধ্যাপক ধ্রুব জ্যোতী লাহিড়ী, ভারতের মানবাধিকার কর্মী উৎপলা মিশ্র, ত্রিপুরার ব্যবসায়ী, সমাজসেবী ও লেখক মোহনলাল সাহা। সাংবাদিক হিসাবে এবং নাটক লিখে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ান টাইমস অব আগরতলার জ্যোতি প্রসাদ সাইকিয়া।

পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্য সচিব চন্দ্র শেখর শ্যামল শরণার্থীদের জন্য খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রিয়দর্শন সেন শর্মা বাংলাদেশের জন্য সংগ্রহ করেন অর্থ। আর ভারতীয় নৌ বাহিনীর পেটি অফিসার সিমন সিং যাদব মুক্তিবাহিনীর নৌ কমান্ডোদের সঙ্গে খুলনা ও মংলায় অপারেশনে অংশ নেন।

পূর্ব রণাঙ্গনের যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও চূড়ান্ত অভিযানের নেতৃত্ব দেন জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। তখনকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিলেও যৌথ বাহিনীর পক্ষে তিনিই সই করেন।

অরোরার পক্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল মহিন্দর সিং যখন প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নিচ্ছিলেন, তখনো তালি দিচ্ছিলেন সকলে। সাংবাদিক কামাল লোহানীসহ অনেকে অরোরার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে দাঁড়িয়ে তালি দিতে থাকেন।

পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের লাখ লাখ শরণার্থীকে খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসা যোগানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যান। ভারতীয় লেখক-সাহিত্যিকদের পক্ষ থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন লেখক আবু সায়ীদ আইয়ুব। বংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করেন এবং নীতি প্রণয়নে সহায়তা করেন অধ্যাপক অর্জুন সেনগুপ্ত।

বাংলাদেশকে সহায়তার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সহায়ক সমিতি গঠিত হয়, তার কার্যকরী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক পূর্ণেন্দু কুমার বসু। ভারতের সাংবাদিক কবিতা বোস জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। শিলংয়ের সাংবাদিক পর্শনাথ চৌধুরী শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাদ্য যোগান। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীদের সংগঠিত করে সচতনা সৃষ্টি করেন ভারতের চলচ্চিত্র প্রযোজক হরি সাধন দাশগুপ্ত।

ভারতের সাবেক মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি, সমাজসেবী কৃপেণ রঞ্জন ঘোষ, মানবাধিকার কর্মী ইপ্সিতা গুপ্ত, কলাকাতার সমাজেসেবী লেডি রানু মুখোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক উপ মুখ্যমন্ত্রী বিজয় সিং নাহার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অনীল কুমার সরকার, ভারতের সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী নন্দিনী সৎপতি, সাংবাদিক জিতেন্দ্র চন্দ্র পাল এবং আলোকচিত্রী ও চিত্র সাংবাদিক রঘু রাই পদ্মশ্রী শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে এবং জনমত গঠন করে বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিকা রাখেন।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর গুর্খা রাইফেলসের রাইফেলম্যান পতিরাম গুরুং মহাবীরচক্র মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। মেজর জেনারেল অ্যান্থনি হ্যারল্ড অ্যাডওয়ার্ড মিশিগান চুয়াডাঙ্গায় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। পাকিস্তান হিলি ঘাঁটিতে সম্মুখ সমরে শহীদ হন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৮ গার্ড রেজিমেন্টের সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট শমসের সিং সামরা।

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় নৌ অপারেশনের কেন্দ্রে থাকা নৌ জাহাজ ভীক্রান্তের অধিনায়ক ভাইস অ্যাডমিরাল স্বরাজ প্রকাশ মহাবীর চক্র। তার নেতৃত্বে সাগরপথে পাকিস্তানিদের রসদ সরবরাহের পথ বন্ধ করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগত সিং খাদকারের নেতৃত্বে মেঘনা নদী অতিক্রম করে ঢাকায় প্রবেশ করে যৌথবাহিনী।

এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ায় ইন্ডিয়ান রেড ক্রস সোসাইটির পশ্চিমবঙ্গ শাখাকেও মৈত্রী সম্মাননা দেয়া হয়েছে। 

নেপালি কংগ্রেসের সদস্য নারায়ণ খাড়কা ও দেশটির সাবেক মন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা ড. রাম শরণ মহৎ একাত্তরে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখেন। নেপাল পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক দিল বাহাদুর লামা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেন মুক্তিযোদ্ধাদের।

একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী যখন এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল, তখন পাকিস্তানেও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন কেউ কেউ।      

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী যে বর্বর নিধনযজ্ঞ চালায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বেগম নাসিম আখতার ছিলেন তার প্রত্যক্ষদর্শী। মার্চের শেষ সপ্তাহে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে দাঁড়িয়ে যান লাহোরের মল রোডে। বাঙালির ওপর সংগঠিত গণহত্যার প্রতিবাদ করে গ্রেপ্তার হন। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে কথা বলায় তার পরিবারকেও বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। তার সেই ভূমিকা স্মরণ করেই তাকে দেয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা।

লাহোরের মল রোডে সেই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বেগম তাহিরা মাজহার আলী। তিনিও গ্রেপ্তার হন সেদিন। বিভিন্ন ফোরামে বাঙালির ওপর নির্মম গণহত্যা ও অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরেন এই মানবাধিকারকর্মী।

২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পর তার মুক্তি দাবিতে জেনারেল ইয়াহিয়াকে খোলা চিঠি লেখেন পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মালিক গোলাম জিলানী। এজন্য তাকেও কারাগারে যেতে হয়েছিল।

মালিক গোলাম জিলানীর পক্ষে তার মেয়ে আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী আসমা জাহাঙ্গীর যখন সম্মাননা নিতে মঞ্চে আসেন, তাকে বুকে টেনে নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সাংবাদিক ও কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির পক্ষে কলম ধরেন। বাংলাদেশে গণহত্যা ও নিপীড়িত মানুষের দুঃখ-যাতনা নিয়ে কবিতা ও নিবন্ধ লেখেন পাকিস্তানের এই কবি ও সাংবাদিক। ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার ভয়াবহতা দেখে দৈনিক জং পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন অধ্যাপক ও সাংবাদিক ওয়ারিস মীর।

তার পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন তার ছেলে হামিদ মীর; যিনি বিশ্বাস করেন, পাকিস্তানেও একদিন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে। করতালির মধ্য দিয়ে তাকে স্বাগত জানান সম্মাননা অনুষ্ঠানে সমবেতরা।

১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে অবস্থান নিয়ে চাকরিচ্যুত হন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পাইলট ও কবি আনোয়ার পীরজাদো। এজন্য সামরিক আদালতে তাকে সাত বছরের কারাদণ্ডও দেয়া হয়।

বাংলাদেশের মানুষের ওপর গণহত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়নের প্রতিবাদে কবিতা লিখে সামরিক আদালতে কারাদণ্ডের পাশাপাশি বেত্রাঘাত সহ্য করতে হয় মানবাধিকারকর্মী আহমদ সালিমকে। পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা ও কবি হাবিব জালিব পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বিভিন্ন ফোরামে বক্তব্য দেন। এজন্য তাকে কারাগারে যেতে হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন করেন পাকিস্তানি দার্শনিক একবাল আহমেদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য বার বার জেনারেল ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মীর গাউস বকস বিজেঞ্জো। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দলগতভাবে অবস্থান নেন তিনি।

সম্মাননা জানানো হয়েছে কাজী ফয়েজ মোহাম্মদকে, একাত্তরে যিনি ছিলেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও বঙ্গবন্ধুর সহযোগী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আত্মগোপনে থেকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার গণহত্যা বন্ধ ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য চেষ্টা চালান তিনি।

শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে এবং তার মুক্তির দাবিতে পাকিস্তানের ৪৪ জন বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতা যে বিবৃতি দিয়েছিলেন সেটি তৈরি করেছিলেন শামিম আশরাফ মালিক। তার স্ত্রী নাসিম আখতারও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যাপক সোচ্চার ছিলেন।

আর বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পক্ষ নেয়ায় পাকিস্তানে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়, তাদের হয়ে আইনি লড়াই চালান জাফর মালিক। এজন্য পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বিড়ম্বনার মুখোমুখি হন তিনি।

জাপানের অধ্যাপক ও সমাজসেবী তোমিয়ো মিজোকামি ও হেইজি নাকামুরা বাংলাদেশের জনগণের ওপর পকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন নিজের দেশের সংবাদপত্রে। শরণার্থীদের জন্য সংগ্রহ করেন অর্থ। 

যুক্তরাষ্ট্রের পুরাতত্ত্ব বিশারদ ডেভিড নালিন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত টানতে অনশন করেন। বাংলাদেশের শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশার চিত্র ফুটে ওঠে মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড কবিতায়।

যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গুস্তাভ এফ পাপানেক ও অধ্যাপক হানা পাপানেক মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন করেন এবং বাংলাদেশকে সহায়তার জন্য ইউএসএআইডির নথিপত্র তৈরি করে দেন।

অস্ট্রেলিয়ার ফ্লিন্ডার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি শরণার্থীদের অবস্থা তুলে ধরে সভা ও সমাবেশের আয়োজন করেন অধ্যাপক হারবার্ট ফেইথ। রেডক্রসের হয়ে ঢাকায় এসে একাত্তরে বাংলাদেশিদের পাশে দাঁড়ান সুইডিশ বিমানবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ভেন লামপিল। এক যুদ্ধশিশুকে দত্তক হিসাবেও গ্রহণ করেন তিনি।

তাদের প্রতিনিধিরা এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মননা গ্রহণ করেন।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধুদের সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা সম্মাননা দেয়া হয় ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। গত বছরের ২৫ জুলাই তার পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধীর হাতে এই সম্মাননাপত্র তুলে দেয়া হয়।

দ্বিতীয় পর্বে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা ৮৩ জন বিদেশিকে গত ২৭ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ দেয়া হয়।

তৃতীয় পর্বে গত ২০ অক্টোবর আরো ৬১ জন বিদেশি বন্ধুকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা জানানো হয়।

চতুর্থ পর্বে গত ১৫ ডিসেম্বর ৬০ বিদেশি বন্ধুকে সম্মাননা জানায় বাংলাদেশ।

আর সর্বশেষ গত ৪ মার্চ ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাতে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ তুলে দেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান।