চট্টগ্রাম থেকে চেন্নাই

বঙ্গোপসাগরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। দক্ষিণ ভারতের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত চেন্নাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে সুপরিচিত চিকিৎসা গন্তব্য হিসেবে।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 August 2018, 12:18 PM
Updated : 24 August 2018, 12:18 PM

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’য়ের চট্টগ্রামের সংবাদদাতা মিঠুন চৌধুরী সম্প্রতি চেন্নাই ঘুরে এসে সেখানকার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন।

ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের চেন্নাই অ্যাপোলো হাসপাতাল ও শঙ্কর নেত্রালয় এবং ভেলোরের ক্রিস্টিয়ান মেডিকেল কলেজ এই তিনটি হাসপাতালই বাংলাদেশ থেকে যাওয়া চিকিৎসা প্রার্থীদের পছন্দের শীর্ষে।

চেন্নাই বিমানবন্দর সড়ক

মারাত্মক রোগের চিকিৎসার জন্য যেমন যাওয়া হয় তেমনি স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্যও চেন্নাই যান বাংলাদেশিরা। ডাক্তার দেখাতে গিয়ে সময়-সুযোগ পেলে চলে ঘোরাঘুরিও।

চেন্নাই শহরে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো অনেক কিছুই আছে। সেরকম একটি আকর্ষণ সমুদ্র সৈকত মেরিনা বিচ। চেন্নাই শহরের মৈলাপুরে এই বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত। চেন্নাইয়ের রাজনীতিতেও এই সমুদ্র সৈকত গুরুত্বপূর্ণ। এই সৈকতের কাছে দক্ষিণ ভারতীয় স্থাপত্য শৈলীর এক অনবদ্য নিদর্শন কপালেশ্বর মন্দির।

মেরিনা বিচ ভারতের বৃহত্তম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ সমুদ্র সৈকত। চেন্নাই শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও আছে এই সৈকত ঘেষা মেরিনা বিচ ড্রাইভ ঘেঁষে।

মৈলাপুর কপালেশ্বর মন্দির।

চেন্নাই যাওয়ার অনেক পথ, অনেক বাহন। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা-কলকাতা হয়ে ট্রেনে অথবা বিমানে চড়ে যেতে পারেন চেন্নাই। ঢাকা থেকেও সরাসরি বিমানে যাওয়া যায়।

বাবা-মাকে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে বাসে চড়ে বেনাপোল স্থল বন্দর দিয়ে যাই কলকাতা শহরে। কলকাতায় দুদিন বিশ্রাম নিয়ে রওনা হই চেন্নাইয়ের উদ্দেশ্যে। যাত্রার সময় ঠিক করা থাকলে দেশে থাকতেই ট্র্যাভেল এজেন্সির মাধ্যমে আগাম ট্রেন ও বিমানের টিকেট কেটে রাখতে পারেন।

কলকাতা নিউমার্কেট এলাকার মারকুইজ স্ট্রিটে ভালো ও মাঝারি মানের নানান হোটেল পাবেন। মান ও আকার ভেদে ৮শ’ থেকে ২ হাজার রুপি ভাড়া পাবেন হোটেলের রুম। কলকাতা থেকে করমন্ডল এক্সপ্রেস, চেন্নাই মেল, কন্যাকুমারি এক্সপ্রেসসহ কয়েকটি ট্রেন ছেড়ে যায় চেন্নাইয়ের উদ্দেশ্যে। 

মৈলাপুর কপালেশ্বর মন্দিরের পেছনের পুকুর

কলকাতার হাওড়া স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেন আপনাকে পৌঁছে দেবে চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশনে। প্রায় ১,৬৫০ কিলোমিটার দূরের চেন্নাই শহরে যেতে ২৬ ঘণ্টা থেকে ২৮ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে ট্রেনে। শ্রেণি ভেদে জনপ্রতি ৬৭০ থেকে সাড়ে ৪ হাজার রুপির টিকেট আছে এসব ট্রেনে।  

একটু আগে ট্রেন বা বিমানের টিকেট কাটলে খরচও পড়বে কম। ভারতে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান ভাড়া খুব বেশি নয়। কলকাতার নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি খুব সুন্দর। আকারেও বড়। ঘুরে ঘুরে দেখতে পারেন বিমানবন্দরের বিভিন্ন অংশ।

চেন্নাই অ্যাপোলো বা শঙ্কর নেত্রালয়ে চিকিৎসা নিতে বিমানবন্দরে পৌঁছে প্রি-পেইড ট্যাক্সি ঠিক করে নিতে পারেন। অথবা বিমানবন্দর থেকে বের হলে অটোরিকশা আর ট্যাক্সিক্যাব পাওয়া যায়। গন্তব্য অনুসারে ভাড়া ঠিক করে নিতে হয় দরদাম করে।

চেন্নাই মেরিনা বিচ সৈকতে

ভেলোর যেতে চাইলে ট্যাক্সিক্যাবই ভাল। ভাড়া পড়বে ১ হাজার ২শ’ রুপির মতো। আর চেন্নাই অ্যাপোলো বা শঙ্কর নেত্রালয়ের আশপাশের গন্তব্যে ট্যাক্সিক্যাবের ভাড়া ৪শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ রুপি। অটোরিকশার ভাড়া ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ রুপি।

গন্তব্য থাউজেন্ড লাইটস এলাকা। এখানকার গোলাম আব্বাস আলী খান স্ট্রিট হল বাংলাদেশি পযর্টকদের প্রথম পছন্দের জায়গা। আর আছে সংলগ্ন মডেল স্কুল রোড। এই জায়গটা চেন্নাইয়ের ট্যাক্সি চালকদের কাছে পরিচিত বাঙালি পাড়া হিসেবে।

বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি ঠিক করার সময় তাই ‘বাঙালি পাড়া’ বললেই চলবে। মডেল স্কুল রোড আর গোলাম আব্বাস আলী খান স্ট্রিটে শ’খানেক হোটেল। নন এসি রুমের ভাড়া ৮শ’ থেকে ৯শ’ রুপি। এসি রুমের ভাড়া ১ হাজার ২শ’ থেকে ১ হাজার ৪শ’ রুপি (ডবল বেড)। দু্একটা হোটেল ঘুরে আর রুম দেখে যাচাই করে নিতে হয়।

চেন্নাই মেরিনা বিচ সৈকতে

চেন্নাই অ্যাপোলো হল গ্রিম্স রোডের গ্রিম্স লেনে। বাঙালি পাড়া খ্যাত গোলাম আব্বাস আলী খান রোড থেকে হেঁটে পাঁচ-সাত মিনিটে পৌঁছে যাবেন হাসপাতালে। আর শঙ্কর নেত্রালয় দুই কিলোমিটার দূরে। অটোরিকশায় চলে যেতে পারবেন সহজে।

চেন্নাইতে খাবার নিয়ে একটু বিপত্তিতে পড়েন বাংলাদেশিরা। সেখানকার মানুষ মূলত নিরামিষভোজী। তাদের রান্নার প্রক্রিয়ার ভিন্নতার কারণে সেসব খাবার বাংলাদেশের মানুষের মুখে রুচে না। গোলাম আব্বাস আলী খান রোড ও মডেল স্কুল রোডে দুয়েকটা বাঙালি খাবারের হোটেল আছে। কিন্তু সেগুলোর খাবারও খুব বেশি ভালো মানের নয়। তাই অনেকেই হোটেল রুমে নিজেরা রান্নার আয়োজন করেন।

মেরিনা বিচ সংলগ্ন সড়কের পাশে মহাত্মা গান্ধীর ভাস্কর্য

চেন্নাই অ্যাপোলোতে নিজস্ব ক্যান্টিন আছে। তবে সেখানকার খাবারও তাদের পদ্ধতিতে রান্না করা। হাসপাতালের বাইরে আছে ঝুপড়ি দোকান। সেখানে সকার-বিকাল চা-নাস্তা সেরে নিতে পারবেন।

শুরুতেই চিকিৎসার কাজ শেষ করে নিয়ে হাতে সময় থাকলে কিছুটা ঘোরাফেরা করেন বাংলাদেশিরা। চেন্নাইতে গেলে সবাই ঘুরতে যায় তেমনি একটি স্থান মেরিনা বিচ।

বাঙালি পাড়া থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করেই চলে যেতে পারবেন মেরিনা বিচে। বাসে বা ভাড়ার মোটর সাইকেলেও যাওয়া যায়। দক্ষিণে বেসান্ত নগর থেকে উত্তরের সেন্ট জর্জ গির্জা পর্যন্ত বিস্তৃত মেরিনা বিচ। সকালে সূর্যোদয় আর সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখতে মূলত পর্যটকরা এই সৈকতে আসেন। মেরিনা বিচ রোডেই দেখতে পাবেন মহাত্মা গান্ধী ও দ্যা ভিক্টরি অব লেবার নামের দুটো বিখ্যাত ভাস্কর্য। সৈকতের দক্ষিণ প্রান্তে আছে বাতিঘর।

চেন্নাই অ্যাপোলো হাসপাতাল।

মেরিনা বিচ অনেকটা বাংলাদেশের সৈকতগুলোর মতোই। সাগরের পানিও আমাদের কক্সবাজারের মতো। সৈকতের একপাশে সারি সারি নৌকা বাঁধা। আছে জেলেদের আনাগোনা। তবে এই সৈকতে পানিতে নামা নিষেধ।

তারপরও শিশু-কিশোররা কেউ কেউ হাঁটু পানিতে নেমে মজা করছেন। এখানে আছে ভাড়ায় ঘোড়ায় চড়ার সুবিধা। নানান স্ট্রিট ফুড আর গহনা বিক্রি হয় সৈকতের ভাসমান দোকানগুলোতে। সন্ধ্যায় দেখতে পাবেন উত্তর দিকে দূরে বন্দরের হলুদাভ বাতিগুলো জ্বলে উঠছে।

নোয়াখালী থেকে চার বন্ধু মেডিকেল চেকআপের জন্য চেন্নাই অ্যাপোলোতে আসেন। চিকিৎসার কাজ শেষে আসেন মেরিনা বিচে। সেখানেই কথা হয় তাদের সঙ্গে।

তাদেরই একজন সাইফুল ইসলাম বলেন, “এখানে এসে দেখি বাংলাদেশের অনেকে এসেছেন। সবাই মূলত ডাক্তার দেখাতে আসেন। এতদূর এসে একটু ঘুরে দেখব না। তাই বেড়াতে বের হলাম। সৈকতটা সুন্দর ছিমছাম।”

চেন্নাই বিমান বন্দর

ফেরার আগে দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্য শৈলীতে তৈরি কপালেশ্বর মন্দির ঘুরে দেখতে পারেন। পৌরাণিক মূল মন্দিরটি ছিল সাগর তীরের কোথাও। বর্তমান মন্দিরও প্রায় চারশ বছর আগের। মূল ফটক আর প্রতিটি ভবনের চূড়ায় কারুকাজ অবশ্যই নজর কাড়বে। মন্দিরের পেছনে পুকুরের মাঝে নকশাকরা স্থাপনা দেখতে পাবেন।

চেন্নাই বিখ্যাত আরেকটি কারণে- কাঞ্জিভরম শাড়ি। এক হাজার রুপি থেকে লক্ষ রুপি দামের শাড়ি কিনতে পাবেন চেন্নাইতে। অটোরিকশা বা ট্যাক্সির চালককে বললেই নিয়ে যাবে কোনো একটি বিপনি কেন্দ্রে। এত সব আকর্ষণের কারণে সাগর তীরের এই শহর এখন বাংলাদেশিদের অন্যতম পছন্দের মেডিক্যাল ট্যুরিজম গন্তব্য।