বিয়ে মানেই সমাধান নয়

একেকজন পুরুষ যেন একেকটি ট্রাভল এজেন্সি! তা না হলে এদেশের মেয়ে অভিভাবকদের বহুল ব্যবহৃত বচন ‘বিয়ের পর যেখানে খুশি যাও’- এটা বলার ভরসা তারা পায় কীভাবে!

তৃপ্তি গমেজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2018, 05:02 AM
Updated : 8 March 2018, 05:03 AM

এদেশে খুব কম নারীই আছে যারা এই ধরনের কথা শুনেনি। আবার মেয়ে সন্তানের অভিভাবক হলে একসময় শুনতে হয়, ‘মেয়ের তো বয়স হয়ে যাচ্ছে, বিয়ে দেবেন না’- যেন বিয়ে হলেই সব সমাধান। 

‘স্বর্ণ-রৌপ্য অলংকারে যক্ষপুরীতে নারী করিল তোমায় বন্দিনী, বল কোন সে অত্যাচারী?’- আজ থেকে বহু বছর আগে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নারী পুরুষের সমতা ও নারীর স্বাধীনতার গুরুত্ব বুঝতে পারলেও আমরা কেনো জানি এখনও তা মেনে নিতে পারিনি।

বয়স বিশ ছাড়িয়েছে মানেই মেয়েকে এখন বিয়ে দিতে হবে। ‘বিয়ে করবা কবে? এখনও বিয়ে করো না কেন?‘ এ ধরণের কথা শুনেনি এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, আর মেয়ে যদি শিক্ষিত হয় তাহলে তো কোনো কথাই নেই।

প্রাপ্ত বয়স্ক অবিবাহিত মেয়ের বাবা মা পাড়া-প্রতিবেশির হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে একটা পর্যায়ে তারাও সন্তানকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া শুরু করে।

অথচ একটা ছেলের ক্ষেত্রে দেখা যায় ভিন্ন অবস্থা।

বর্তমানে নারীরা পড়াশুনা বা কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে না থাকার পরেও তাদের স্বাধীন চলাফেরা নিয়ে দেখা যায় কার্পণ্য। এর পেছনে নিরাপত্তাকে কারণ হিসেবে দেখানো হলেও তা সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্যও নয়। অনেক নিরাপদ বিষয় এমনকি নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও নারীদের অন্যের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয়।

ধরা যাক, কোনো মেয়ে কোথাও বেড়াতে যাবে। সেক্ষেত্রে তাকে পর্যায়ক্রমে বাসার বড়দের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। অনুমতি পেলে ভালো আর না হলে পরিকল্পনা বাতিল। আবার অনেক সময় এমনও শুনতে হয়- এখন না, বিয়ে করে বরের সঙ্গে বেড়াতে যেও।

এই বিষয়গুলো সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হলেও অধিকাংশ মেয়ের ক্ষেত্রেই ঘটে।

এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়েও কেউ যদি বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করে তাহলে একদল তাকে বলে সাহসী আর অন্যদল তাকে বলে বেয়াদপ। যেন প্রতিনিয়তই নারীকে কোনো না কোনো ভাবে অন্যের কাছে পরিক্ষিত হতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, সমাজকল্যাণ বিভাগের শিক্ষার্থী মাশরুবা বিনতে মোশাররফ বন্ধুদের সঙ্গে দেশে ও দেশের বাইরে বেড়াতে গিয়েছেন বহুবার। তার মায়ের হাতেই সংসারের হাল।

স্বাধীনভাবে বেড়ানোর ক্ষেত্রে কোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন কিনা জানতে চাইলে মাশরুবা বলেন, “আমি কোথায় যাচ্ছি কাদের সঙ্গে যাচ্ছি তা আমার বাসায় জানিয়ে যাই এবং যে বন্ধুদের সঙ্গে যাই তাদেরকে আমার বাসার সবাই ভালো মতো চেনে। তাই কখনও কোনো অসুবিধায় পড়তে হয়নি। অথবা মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় নি।”

তিনি আরও বলেন, “তবে যেখানে যাচ্ছি সেই জায়গার নিরাপত্তা ও সামাজিক অবস্থা নিয়ে মা অনেকটা চিন্তা করেন যেটা সব পরিবারের জন্যই স্বাভাবিক। আর বাবা না থাকায় আমার স্বাধীন চলাফেরার উপর যদি কোনো চাপ আসে অথবা অন্যরা যদি তা খারাপ ভাবে দেখেও থাকে, মা তাতে কান না দিয়ে আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।”

বিয়ের আগে ও পরে বেড়াতে যাওয়া এবং নারীর স্বাধীনতা বিষয়ে ঢাকা ট্রিবিউনয়ের বিনোদন বিভাগের সম্পাদক রূম্পা সাইদা বলেন, “স্বাধীনতা দেওয়ার কিছু নেই এটা উপভোগ করতে হয়। মেয়েরা স্বাধীনতার জন্য কেবল বিদ্রোহই করছে, এত বিদ্রোহ করলে উপভোগ করবে কীভাবে। তাই নিজে আসলে কি চাই, সেটা বুঝে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিলেই হল।”

তার মতে- “বর্তমানে আমরা কেবল পোশাকে আধুনিক হচ্ছি, মানসিকতায় না। স্লিভলেস পরা বা স্কুটি চালানোই কেবল যদি আধুনিকতা হয় তবে সেটা ভুল হবে। আমার কী দায়িত্ব, আমি কী চাই, কীভাবে সদ্ধান্ত নেব- এসব কিছু যখন একজন ব্যক্তি নির্দ্বিধায় করতে পারবে তখনই সে আধুনিকতার পরিচয় দিতে পারবে।”

“আমি নিজের মতো বেড়াতে পছন্দ করি। আমার ছোট সন্তানকে তার বাবার কাছে রেখে আমি বেড়াতে গিয়েছি, এর জন্য অনেকে আমাকে নানা রকমের প্রশ্নও করেছেন। আমি আমার সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বেড়াতে গিয়েছি এখানে দোষের কিছু নেই। একই কাজ কোনো বাবা করলে তাকে এতটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে হত না।”

“ইচ্ছাটাই আসল কথা। নিজের দায়িত্ব পূরণ করে কেউ যদি তার ভালোলাগার কাজ করে এতে অন্যের বাধা দেওয়ার কিছু নেই। আর যারা দোষ ধরার তারা সবসময়ই ধরবে। তাই তাদের পরিবর্তন করার চেষ্টা না করে নিজের মতো করে নিজের জীবন কাটানোর দিকে মনযোগ দেওয়াই ভালো।”

তবে এটাও মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। যেমন দেশ তেমন বেশ। অর্থাৎ নিজেকে শালীন রেখে নিজের মতো বেড়াতে যাওয়া বা জীবনযাপন করা দোষের কিছু নয়।

সমাজ রাতারাতি পরিবর্তন হবে না। তবে এর সুত্রপাত ঘটেছে। বর্তমানে অনেক স্বাবলম্বী ও সংস্কৃতিমনা নারী দেখা যায়, যা নারীদের সচেতনতারই ইঙ্গিত করে, এমনটাই মন করেন ‘উইমেন রাইটস অ্যান্ড জেন্ডার ইকুইটি’, অ্যাকশন এইড, বাংলাদেশ’য়ের ব্যবস্থাপক কাশফিয়া ফিরোজ।

তিনি বলেন, “মেয়েদের উপর বিয়ের চাপ আসার অন্যতম প্রধান কারণ হল অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা। অনেক পরিবার ভাবে, মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হলে তাতে আর্থিক চাপ কমে আসবে। আবার অনেক পরিবার অসচেতন বলেই মনে করে যে মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া মানে হল তার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা। এই ধ্যান ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।”

“একমাত্র আত্মসচেতনতার মাধ্যমেই নারীরা নিজেদের অবস্থার উন্নতি করতে পারবে। যে কাজই করুন তা নিজের জন্য করুন, নিজেকে ভালোবেসে করুন। অন্যের খুশির জন্য বা অন্যকে ভালো রাখার জন্য কোনো কিছু করে স্বস্তি পাওয়া যায় না তাই পড়াশুনা, কাজ, বেড়ানো অথবা বিয়ে সবকিছুই নিজের ভালো চিন্তা করে করতে হবে। তাহলে কখনও পেছন ফিরে তাকাতে হবে না”

“অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হলে যে কেউ নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারা মানে হচ্ছে স্বাধীনতা। বেশি শিক্ষিত হলে বা বয়স বেড়ে গেলে পরে ভালো পাত্র পাওয়া যাবে না এসব ভেবে তাড়াহুড়া করে বিয়ে না করে শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হয়ে বিয়ে করাটা অনেক বেশি ভালো”, বললেন কাশফিয়া।

তিনি আরও মনে করেন নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা ও নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার মাধ্যমেই ব্যক্তি স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়।

মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া অথবা বিয়ের চাপ সৃষ্টি করার পেছনে কী ধরনের মানসিক বিষয় কাজ করে জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন  বলেন, “এর পেছনে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও বাবা মেয়ের দায়িত্ব পূরণ করার অনুভূতি বেশি প্রভাব রাখে। বাবা-মা মনে করেন যে, কন্যা সন্তানকে যত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া হবে সে তত তাড়াতাড়ি সামাজিকভাবে একটা নিশ্চিত জীবন পাবে।”

আসলে এটা কোনো সমাধান নয়।

কন্যা সন্তানকে বিয়ে দেওয়ার আগে সে বিয়ের জন্য শারীরিক, মানসিকভাবে প্রস্তুত কিনা, তার ক্ষমতায়ন, দায়িত্ব গ্রহণ ও পালন করার মতো পরিপক্কতা এসেছে কিনা তা যাচাই করে বিয়ের বিষয়ে বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করেন, ডা. হেলাল।

তবে অবস্থা পাল্টাচ্ছে। অনেক মেয়ে এখন নিজেদের মতো করে ভ্রমণ করেন। বিভিন্ন ভ্রমণ-বিষয়ক দল গড়ে উঠেছে। যেখানে ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গে কাজ করছেন। ‘কুড়িতেই বুড়ি’ প্রবাদ ঢাকা পড়েছে। এখন অনেক নারী সাবলম্বী হয়ে নিজের পছন্দ মতো বিয়ে পিঁড়িতে বসছেন কিংবা নিজের মতো জীবন কাটাচ্ছেন।

প্রতীকী ছবির মডেল: বিনি, অর্পা, ইমু এবং অনন্যা। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক।

আরও পড়ুন