চিম্বুকের সকাল যেন বিস্ময় জাগানিয়া। ভোরের আলো ফোটার সাথে চিম্বুক রেঞ্জে কেবলই মেঘের সমুদ্র।
Published : 10 Dec 2024, 03:37 PM
যতদূর চোখ যায় সফেদ মেঘ। বিস্তৃত চিম্বুক রেঞ্জে মেঘের সম্ভাষণ থাকে সারা বছরই। তবে সদ্য বিদায়ী হেমন্তের চিম্বুক পর্যটকদের বিমোহিত করেছে।
ভোর থেকে শুরু করে মধ্য দুপুর চিম্বুক রেঞ্জের এপার ওপার মেঘের উপস্থিতি। চিম্বুক ছুঁয়ে যারা নীলগিরি, থানচি, রুমার দিকে যাচ্ছেন- পথ চলতে চলতে তাদের মনে হবে- যেন মেঘের ওপরে ভাসছেন।
বান্দরবান শহর থেকে চিম্বুক পাহাড়ের দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। হেমন্তের মধ্য দুপুরে আরেক পাহাড়িয়া শহর খাগড়াছড়ি থেকে আমাদের যাত্রা শুরু।
খাগড়াছড়ি থেকে চিম্বুকের দূরত্ব ১শ ৫৮ কিলোমিটার। একটানা এত লম্বা ভ্রমণের ক্লান্তি এড়াতে মাঝপথে রাতযাপনের ব্যবস্থা করা হল।
পরদিন সকালেই রওনা হলাম চিম্বুকের উদ্দেশ্যে। অনেকটায় অপ্রচলিত সড়ক ধরে যাত্রা শুরু। রাঙামাটি-বান্দরবান সড়ক এড়িয়ে গ্রামীণ পিচটালা মৃসণ সড়ক ধরে এগিয়ে চলছে আমাদের মটরবাইক।
যারা মটরসাইকেল চালাতে পারেন ভালো, পাহাড়ে ভ্রমণের জন্য তাদের জন্য সেরা মাধ্যম হতে পারে এই দুই চাকার যন্ত্র। গণপরিবহনের সংকট আর বাড়তি ভাড়ার ভোগান্তি এড়ানো যায় সহজেই।
সুখবিলাস, রাজার হাট, ফুলতলীসহ ‘নস্টালজিক’ জনপদ পেরিয়ে বান্দরবান শহরে পৌঁছাতে প্রায় দেড় ঘন্টার বেশি সময় লেগেছে।
সকালে বান্দরবান শহর খুব স্নিগ্ধ। তেমন ভিড়ভাট্টা নেই। শহরের একপ্রান্তে মধ্যাহ্ন ভোজের পর্ব শেষ করলাম। ‘মার্মা হোটেল’য়ে প্রচলিত অপ্রচলিত বেশ কয়েক পদের রান্নায় উদরপূর্তি করে চিম্বুকের পথে রওনা দিলাম।
বান্দরবান শহর ছেড়ে যেতেই পাহাড়ি সড়কের সূচনা। থানচি রুমা বাস স্টেশন পেরোতেই উঁচু পাহাড় ধরে পথচলা।
পাহাড়ের সরু সড়ক ছুঁয়ে কিছুদূর যেতেই চোখ আটকে গেল! মিলনছড়ির সম্মুখ থেকে পাখির চোখে দেখা মেলে সাঙ্গু নদী।
সাঙ্গু বাংলাদেশের অন্যতম খরস্রোতা নদী। বর্ষায় এটি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। হেমন্তের মিষ্টি দুপুর সাঙ্গুর সাথে ছবি তোলা শেষে আবারও যাত্রা শুরু।
হেমন্তের পথ সব রঙিন হয়ে ওঠে চেনা অচেনা বুনো ফুলে। বান্দরবান থেকে চিম্বুক পুরো পথজুড়ে হলুদ, লাল, নীল, সবুজ বুনো ফুল ফুটে আছে। বেশিরভাগই অচেনা সুন্দর ফুল। পাহাড়ি সড়কের পিঠঘেঁষে থাকা এসব ফুল দেখে মুগ্ধ হবেন যে কোনো পথিক!
ফুলের রাজ্য পেরিয়ে দুপুর দেড় টায় পৌঁছে যাই চিম্বুক পাহাড়ে।
চিম্বুকে রাতযাপনের আয়োজন খুবই সীমিত। কোনো বেসরকারি রির্সোট নেই।
চিম্বুক পর্যটন কেন্দ্রটি জেলা প্রশাসনের আওতাধীন। জেলা প্রশাসন থেকে ইজারা নিয়ে একটি রেস্তোরাঁ পরিচালিত হয়। সাথে থাকার মতো কয়েকটি কক্ষ বিশিষ্ট রির্সোট আছে।
এছাড়া সরকারি আরেকটি সংস্থার পরিদর্শন বাংলো রয়েছে। সেখানেই আমাদের রাতযাপনের জন্য আগে থেকে কক্ষ বরাদ্দ ছিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আড়াই হাজার ফুট ওপরে এত সুন্দর স্থাপনা থাকবে সেটা ভাবনার বাইরে ছিল।
বাংলোর তত্ত্বাবধায়ক মেনরাও ম্রো আমাদের স্বাগত জানালেন। চিম্বুক গিরি নিবাস মুগ্ধকরা এক স্থাপনা। চার কক্ষ বিশিষ্ট এই বাংলো থেকে পাখির চোখে পুরো চিম্বুক রেঞ্জ দেখা যায়।
৩৬০ ডিগ্রি কাঠামোতে তৈরি পরিপাটি চিম্বুক গিরি নিবাস সবচেয়ে উঁচু চূড়ায় হওয়া কারণে এটি অনন্য।
ভ্রমণ ক্লান্তিকে সঙ্গী করেই বিকেলে রওনা হলাম নীলগিরির উদ্দেশ্যে। হেমন্তে সবুজ পাহাড় আক্ষরিক অর্থেই নীল হয়ে ওঠে।
চিম্বুক থেকে নীলগিরির দূরত্ব প্রায় এক ঘন্টার কাছাকাছি। পথে পথে বিরতির কারণে সময় একটু বেশিই লাগে।
চিম্বুক থেকে নীলগিরির সড়ক যেন ফুলে ফুলে মোড়ানো। চোখে পরে লিপস্টিক ট্রি মতো দুর্লভ গাছ। পথের পাশেই ফুটে আছে অনিন্দ্য সুন্দর এই ফুল।
নব্বইয়ের দশকে খ্রিস্টান মিশনারির হাত ধরে বিদেশি এই ফুল চিম্বুক পাহাড়ে আসে। বেশ কিছু লিপস্টিক ট্রি চোখে পড়ল।
নীলগিরি থেকে দূরের পাহাড়গুলো দেখে যে কেউ মুগ্ধ হবেন। যতদূর চোখ যায় কেবলই পাহাড় আর পাহাড়। কোথাও কোনো জনবসতি নেই। সুউচ্চ পাহাড়ের সাথে দিগন্ত মিশে গেছে।
নীলগিরি ছেড়ে চিম্বুক ফেরার সময় পশ্চিমের আকাশে নিভে যাচ্ছে ‘সোনার সিংহ’। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দর্শনের অভিজ্ঞতা সবসময়ই অনন্য।
নীলগিরি থেকে চিম্বুক ফেরার সময় কেবলই শূন্যতা। পাহাড়ি কোনো যানবাহন নেই। আমাদের গাড়ি ছুটছে চিম্বুকের দিকে।
আকাশজুড়ে তখন পূর্ণিমার চাঁদ। পূণির্মায় পাহাড় আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। চাঁদের আলোয় রাতের পাহাড়ও অনেকটা দেখা যায়।
মেঘের সমুদ্র দেখার অপেক্ষায় রাত নামল চিম্বুকে।
ভোর হতেই পূবের আকাশে মেঘ আর মেঘ। সুবিস্তৃত চিম্বুক রেঞ্জে মেঘ দেখা এবারই প্রথম। মেঘের ওপরে ভেসে উঠছিল দিনের সূর্য। চিম্বুক থেকে সূর্যোদর দেখার অপেক্ষার তৃষ্ণা অবশেষে পূরণ হল।
যারাই ছুটছে সামনের দিকে তারা মেঘের এই সৌন্দর্য্য দেখে অবাক বিস্ময়ে মুগ্ধ হচ্ছেন।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি বাস যোগে বান্দরবান শহর। বান্দরবান শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পর্যটন কেন্দ্র। শহর থেকে সিএনজি অটো রিকশা, মাহেন্দ্র, পিকআপ, জিপ, থানচিগামী বাসে করে চিম্বুকে যাওয়া যায়।
চিম্বুকে থাকার ব্যবস্থা খুবই সীমিত। জেলা প্রশাসনের একটি রেস্টহাউস রয়েছে। ভাড়া পড়বে ৪ থেকে ৭ হাজার টাকা।
আরও পড়ুন
শ্রীমঙ্গলে যে দুটি জায়গায় যাওয়া পণ্ডশ্রম