গাছের এতিমখানা

রেললাইনের ভেতর যে গাছগুলো জন্মায় হারু মামা সেগুলো তুলে এনে খুব যত্ন করে টবে লাগান, সার দেন, পানি দেন। বড় আপা ঠাট্টা করে বলেন 'হারু মামার এতিমখানা'।

মনজুর শামসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 July 2022, 09:44 AM
Updated : 23 July 2022, 10:11 AM

বৃষ্টি যত জোরে নামছে তৃণা ততই খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। আর ততই রাগে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে শুচির।

মিঠু ও বাবলু বেঞ্চের ওপর দিয়ে দৌড়ে ক্লাসের এ-মাথা ও-মাথা ছোটাছুটি করছে। এতে শুচির রাগ আরও বেড়ে গেলেও মুখে বলতে পারছে না কিছুই। ডাকাবুকা এই দুই ডানপিটেকেই এড়িয়ে চলে সে। ভয়ও পায়। ওরা মেরেও জেতে, নালিশ করেও জেতে।

পুরো ক্লাসটা খালি পেয়ে ওদের দাপাদাপি আরও বেড়ে গেছে। তার ওপর অঝোর ধারায় বৃষ্টি! ওদের এখন রোখে সাধ্য কার? শুচি তাই তৃণার ওপরেই এক হাত নিল।

‘অতো খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসার কী হলো? বাসায় যাবি কীভাবে ভেবে দেখেছিস? সব্বাই তো চলে গেল! ওই দেখ আকাশ আরও কালো হয়ে আসছে।’

তৃণাদের এই ফুলকুঁড়ি নার্সারি স্কুলটি গোপীবাগ সেকেন্ড লেনে। সকাল সাড়ে সাতটায় তৃণা যখন স্কুলে এসেছিল তখন সবে স্কুলের টিনশেড ঘরটার পাশের বড় আমগাছটার মগডালে নরম-হলদে রোদ এসে পড়েছে। আকাশ ঝরঝরে পরিষ্কার। শ্রাবণের সকালের সেই পরিষ্কার নীল আকাশ কালো মেঘে ঢেকে অন্ধকার নেমে এলো ঘণ্টা দুয়েক পরেই। ঠিক ওদের স্কুল ছুটি হওয়ার আগে আগে। অন্য সবার অভিভাবক আসায় রেইনকোট পরে নয়তো বাবা-মা বা অন্য কোনো অভিভাবকের ছাতার নিচে মাথা গলিয়ে চলে গেছে অনেকক্ষণ হলো। শুধু ওদের তিনজনের অভিভাবকের এখনও কোনো দেখা নেই। হয়তো বৃষ্টিতে আটকে পড়েছে। দারোয়ান গেট লাগিয়ে দিয়েছে। দুবার দুজন বুয়া এসে ধমকে গেছে, ‘চুপচাপ বইয়া থাহো! বাপ-মায়ের তো খবর নাই!’

একসময় তৃণার খিলখিল হাসিও থেমে গেল। শুচির পাশে এসে গালে হাত দিয়ে বসে পড়ল। এরই ভেতর রাস্তায় পানি জমে গেছে। মিঠু আর বাবলু রাফখাতার পুরনো পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে সে পানিতে। কিছুদূর ভেসে কাত হয়ে আধডোবা হয়ে স্রোতের তোড়ে চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছে সেগুলো।

‘চল, আমরাও নৌকা বানিয়ে ভাসাই!’ তৃণা প্রস্তাব দিতেই তার দিকে কটমটিয়ে তাকাল। ‘আচ্ছা তুই কী, বল তো? গল্প করিস না, হুড়োহুড়ি করিস না, টিফিন পিরিয়ডে খেলতেও বের হস না। তুই কি জাপানি রোবট ডল?’ এবার বেশ রাগের সঙ্গেই বলে সে।

‘আমার পেছনে লেগেছিস কেন? তোর কি একটুও ভয় করছে না? বাসায় ফিরব কী করে সে চিন্তায় ভেবে মরছি, আর তুই কিনা দিব্বি হাসি-তামাশা করছিস! চুপচাপ বসে থাক।’

‘তুই একটা ভীতু বেড়ালছানা। বৃষ্টি থামলে বাবা অথবা মা ঠিকই এসে বাসায় নিয়ে যাবে। ও নিয়ে অতো ভাবাভাবির কী আছে?’ বলেই তৃণার মনে পড়ে গেল ব্যাগের পকেটে কাল কয়েকটা চকোলেট লুকিয়ে রেখেছিল। এক ছুটে নিজের বেঞ্চে গিয়ে ব্যাগ থেকে সেগুলো নিয়ে এলো সে। একটি নিজের মুখে পুরে বাকি দুটো শুচির হাতে গুঁজে দিল সে।

সেদিন বৃষ্টি কমে যেতেই যার যার বাবা-মার সঙ্গে ওরা বাসায় ফিরেছিল। দিনে দিনে সেই বৃষ্টিতে আটকা পড়ার কথা ভুলেও গিয়েছিল তৃণা। শুধু ভুলতে পারেনি শুচির হারু মামার এতিমখানার কথা। এক শুক্রবার বিকেলে সে তাই বুবুকে অনেক বলে-কয়ে রাজি করিয়ে বেড়াতে গেল শুচিদের বাসায়।

এবার এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠল শুচির মুখে। ‘আচ্ছা তোর কি দুনিয়ার কিছুই ভালো লাগে না?’ তৃণা জানতে চাইল।

‘কে বলল লাগে না। এই যে তোর চকোলেট খেতে ভালো লাগছে।’

‘আর কী ভালো লাগে তোর?’

‘আর ভালো লাগে হারু মামার এতিমখানা।’

‘এতিমখানা?’

‘হ্যাঁ! তুই একদিন আসিস আমাদের বাসায় তোকে দেখাতে নিয়ে যাব। তোরও ভালো লাগবে।’

সেদিন বৃষ্টি কমে যেতেই যার যার বাবা-মার সঙ্গে ওরা বাসায় ফিরেছিল। দিনে দিনে সেই বৃষ্টিতে আটকা পড়ার কথা ভুলেও গিয়েছিল তৃণা। শুধু ভুলতে পারেনি শুচির হারু মামার এতিমখানার কথা। এক শুক্রবার বিকেলে সে তাই বুবুকে অনেক বলে-কয়ে রাজি করিয়ে বেড়াতে গেল শুচিদের বাসায়।

ওরা থাকে আড়াই লেনে আর শুচিদের বাসা থার্ড লেনে। শুচি তো ওকে পেয়ে খুশিতেই আটখানা! নিজের সব পুতুলগুলো বের করে বলল, ‘চল খেলি।’

‘আরে ধুৎ! আমি কি খেলতে এসেছি নাকি? চল তোর হারু মামার এতিমখানা দেখব।’

‘তো বেশ, চল।’

শুচিরা থাকে চারতলায়। সে তৃণাকে ছাদের দিকে নিয়ে চলল। ‘কিরে, তুই ছাদে যাচ্ছিস কেন? এতিমখানায় চল।’

‘এতিমখানাতেই তো যচ্ছি। হারু মামার এতিমখানায়। ছাদের চিলেকোঠায় থাকেন হারুমামা। আজ তিনি বাড়িতেই আছেন। ভয় পাবি না কিন্তু! বড় মজার মানুষ আমার এই হারু মামা। ঘরে রেডিও-টেলিভিশন কিচ্ছু রাখেন না। তবে ভাবিস না গান-বাজনা পছন্দ করেন না। গার শোনার ইচ্ছে হলে অডিও-ভিডিওর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন। সেখানে লাউডস্পিকারে বাজতে থাকা গান শুনে মনে ভরিয়ে তবেই ফিরে আসেন। বিআরটিসির বাস ছাড়া আর কোনো বাসে চড়েন না। বলেন, ‘গাঁটের পয়সা যদি দিতেই হয় তবে সরকারকে দেওয়াই ভালো। অন্য বাসগুলোর মালিকরা তো সব লাফাঙ্গা, মাস্তান!’ তোকে দেখে অবশ্য খুশিই হবেন।

ছাদে উঠে তৃণাকে এদিক-সেদিক তাকাতে দেখে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে শুচি। শেষে বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে তৃণা, ‘কিরে, কোথায় তোর হারু মামার এতিমখানা?’

এবার ছাদজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা টবগুলোর দিকে দেখিয়ে শুচি বলে, ‘এই তো! এটাই হারু মামার এতিমখানা। এই যে টবগুলোতে উচ্ছে, বেগুন, টমেটো, লাউ, শসাগাছ দেখছিস এসব নিয়েই হারু মামার এতিমখানা। সব গাছের চারাই হারু মামা গোপীবাগ বাজারের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইন থেকে এনেছেন। সবজিওয়ালাদের দোকানের পাশে রেললাইনের ভেতর যে গাছগুলো জন্মায় হারু মামা সেগুলো তুলে এনে খুব যত্ন করে টবে লাগান, সার দেন, পানি দেন। বড় আপা ঠাট্টা করে বলেন হারু মামার এতিমখানা।’

হারু মামা তার ঘরে ছিলেন না। হয়তো কোথাও বেড়াতে গেছেন। তৃণা একটি লতিয়ে ওঠা লাউগাছের কাছে এগিয়ে যেতেই চিরিক-চিরিক শব্দে গান গাইতে গাইতে উড়ে গেল দুটি দোয়েল পাখি। আজব এই এতিমখানায় ঘুরতে ঘুরতে তৃণার মনটা খুব ফুরফুরে হয়ে উঠল। শুচিকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তোর মামা থাকলে একবার সালাম করে যেতাম।’

মনজুর শামস: অনুবাদক ও লেখক, একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় গবেষক হিসেবে কর্মরত