'৫০ বছর আগের বারুয়া মাঝিকে মনে পড়ে’

‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নিজের শৈশব–কৈশোরের গল্প শুনিয়েছেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক কবি মাজহার সরকার।

কিডজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Feb 2023, 05:47 AM
Updated : 10 Feb 2023, 05:47 AM

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম অগ্রণী সেলিনা হোসেন (১৪ জুন, ১৯৪৭)। বাংলাদেশ নামে স্বাধীন এ ভূখণ্ড সৃষ্টির যে দীর্ঘ ইতিহাস, তার পৃষ্ঠার ভেতরই যেন তার বেড়ে ওঠা। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘নীল ময়ূরের যৌবন’, ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’, ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’-সহ তার মোট উপন্যাসের সংখ্যা ৩৫। এছাড়া লিখেছেন ১৩টি গল্পগ্রন্থ, ২২টি শিশু-কিশোরগ্রন্থ, ১০টি প্রবন্ধগ্রন্থ ও ১৩টি সম্পাদনা গ্রন্থ।

অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে ‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নিজের শৈশব–কৈশোরের গল্প শুনিয়েছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত এ কথাসাহিত্যিক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক কবি মাজহার সরকার। 

জীবনের ৭৫ বছর পেরিয়ে এসেছেন আপনি, সাহিত্যচর্চা করছেন প্রায় ৫৫ বছর ধরে। আপনার লেখালেখির শুরুটা বলবেন?

আমার সাহিত্যচর্চা শুরু একটা প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার মাধ্যমে, একটা গল্প লিখে। সালটা ১৯৬৪, রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি। রাজশাহীতে সব কলেজ শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটা সাহিত্য প্রতিযোগিতা হয়েছিল। আমাদের কলেজ থেকে আমাকে সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে মনোনীত করা হয়। গল্প লেখা, কবিতা, আবৃত্তি, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতাসহ মোট সাতটি ক্যাটেগরি ছিল। ছয়টিতে ফার্স্ট হই, একটিতে থার্ড।

স্কুল-কলেজের কোনো শিক্ষকের কথা কি মনে পড়ে? কিংবা সাহিত্যচর্চার শুরুতে কোন অনুপ্রেরণার কথা?

আমাদের কলেজের শিক্ষক আব্দুল হাফিজ, তিনি ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে তিনিই আমার নাম পাঠিয়েছিলেন। তাকে গিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম, ‘স্যার, আমি আগে কখনও গল্প লিখিনি। গল্প কীভাবে লিখতে হয় তা তো জানি না!’ স্যার ধমক দিয়ে বললেন, ‘তোমাকে ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড হতে তো বলিনি! প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করো, অংশগ্রহণ করাই বড় কথা। আর গল্প লিখতে চেষ্টা করো।’ স্যারের কথামতো গল্প লিখে জমা দিলাম। ফলাফল যখন প্রকাশিত হলো, অবাক হয়ে দেখলাম আমার নামটা সবার প্রথমে!

বলা হয়, মানুষ মূলত তার শৈশবেই বসবাস করে। একজন লেখক তার লেখার উপকরণ ছেলেবেলা থেকেই পায়?

আমি প্রকৃতির ভেতর বড় হয়েছি। শৈশবের সেইসব স্মৃতি আমার লেখায় সাহায্য করে। তখন আমরা থাকতাম বগুড়ায়। আমাদের বাড়িতে ‘তারা’ নামে একটি মেয়ে কাজ করত। বয়স্ক এক লোকের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছিল। লোকটা ওকে প্রায়ই মারতো। সেই স্মৃতি এখনও অনেককিছু বুঝতে সাহায্য করে। আরেকবার এক বুড়ো মা এসে আব্বাকে বললেন, ‘আমার ছেলে আমাকে ভাত দেয় না।’ আব্বা ওই ছেলেকে খোঁজ করে আনালেন। লোকজনকে বললেন, ‘ওর পেটে একটি কাঁঠাল বেঁধে দিয়ে পুরো গ্রাম ঘোরাও। দেখুক ভার বইতে কী কষ্ট!’ মনে আছে ছেলেটি বলেছিল, ‘আমারই তো ভাত জোটে না, আমি মাকে কী করে চালাবো!’ ওর একটা সন্তান ছিল। তার মনে হয়েছে, মায়ের চেয়ে এ শিশুটিকে খাওয়ানো বেশি জরুরি। এ সম্পর্কগুলো আমাকে নানাভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। শৈশব থেকে পাওয়া এ গল্পগুলোই আমাকে লেখার প্রেরণা দিয়েছে।

আপনার সাহিত্যে নানাভাবে নদী এসেছে। নামের সঙ্গেই নদী আছে এমন কিছু বই আছে আপনার- ‘এক রুপোলি নদী’, ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘নদীটির ঘুম ভেঙেছে’ ইত্যাদি। ‘মেয়রের গাড়ি’ উপন্যাসে একটা চরিত্রই আছে ‘নদী’ নামে। আপনার শৈশবে-কৈশোরের সেই নদীটার কথা বলবেন?

নদী বাংলাদেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ, মুক্তিযুদ্ধই তার প্রমাণ। আমাদের বাড়ির পাশে খেয়াঘাটে এক মাঝি ছিল, বারুয়া মাঝি। সেই মাঝি খেয়া পারাপার করতো। আমরা প্রায় আট-দশজন ছেলেমেয়ে একসঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম, আশপাশে যত অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল দেখতে চলে যেতাম। গাছে উঠতাম। ফল পাড়তাম, দূর থেকে যদি কেউ দেখতো বকা দেবে ভেবে একদম উপর থেকে লাফ দিয়ে নেমে যেতাম। একদিন বড়ুয়া মাঝিকে বললাম, ‘কাকা আমাদের একটু নদী পার করে দেবে! আমরা দেখে আসি ওপারের মাটি কীরকম, গাছগুলো কীরকম! ওখানের গাছ থেকে একটা ফল পাড়বো।’ মাঝি বলতো, ‘উঠ! উঠ তো উঠ!’ আমরা উঠে পড়তাম। বড়রা বলতো, 'ওদের যে নৌকায় উঠিয়েছিস, ওরা কি তোকে পয়সা দেবে!’ মাঝি উত্তর দিতো, ‘আরে রাখেন, ওরা মাটি দেখবে গাছ দেখবে, নিজের দেশ দেখবে। আমি ওদের একটু পার করে দিয়ে আসি, তারপর আপনাদের পার করে দেবো।’ সেদিন সেই বারুয়া মাঝিকে মনে হয়েছিল তিনি আমার একজন শিক্ষক, যিনি অন্যদের শেখাতে চান, শিশুদের বড় করতে চান। আমি তাকে একজন শিক্ষকের মর্যাদায় রেখেছিলাম। এখনও আমার মনে আছে তার কথা। বারুয়া মাঝি ছোট্টখাট্টো কালো নিম্নবর্গের একজন হিন্দু। যখন ঈদ আসতো আমি মাকে বলতাম, ‘মা, গরুর মাংস রান্না করো না। তুমি মুরগি রান্না করবে, তাহলে আমি বারুয়া কাকাকে খাওয়াবো।’ এগুলো আমার ছোটবেলার সঞ্চয়।

আপনার জন্ম সাতচল্লিশ সালে। দেশভাগ, পাকিস্তানের জন্ম, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, নতুন পতাকা- বাংলাদেশ নামে স্বাধীন এ ভূখণ্ড সৃষ্টির যে দীর্ঘ ইতিহাস, তার পৃষ্ঠার ভেতরই যেন আপনার বেড়ে ওঠা। আপনার লেখনিতে তাই কি সংগ্রাম ব্যাপারটা নানাভাবে মুখ্য হয়ে ওঠে?

বগুড়ায় থাকার সময়কার একটা ঘটনা। করতোয়া নদীর তীরে একটা মাঠ ছিলো, মাঠের পর আবার নদী। বাঁশ-খড়ের তৈরি অল্পকিছু ঘরবাড়ি ছিল। একবার দেখলাম যে আগুন লেগেছে একটা বাড়িতে। আমরা বাচ্চারা দৌড় দিয়ে গেলাম সেদিকে। আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, কুণ্ডুলী পাকিয়ে ধোঁয়া উড়ছে আকাশের দিকে। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, একজন নারী তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। আগুন জ্বলছে, কিন্তু এর মধ্যেই সে ঘরে ঢুকে ধানের বস্তাটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে আসছে। খুব বিস্মিত হয়েছি। চালগুলো পুড়ে গেলে তারা কী করে খাবে, তখন তো না খেয়ে মরতে হবে। এ ভাবনা থেকেই সে আগুনের মধ্যে ঢুকে চালের বস্তা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। এই যে সাহস করা, এটা একটা বড় দিক। এ দৃশ্য এখনও আমার চোখে লেগে আছে। সংগ্রামশীল মানুষের এসব দিক আমাকে সাহস যুগিয়েছে।

১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় আপনার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’। আমরা যতটুকু জানি এ বইয়ের গল্পগুলো আপনার ছাত্রাবস্থায়ই লেখা। প্রথম বইটি কীভাবে প্রকাশিত হলো?

হাফিজ স্যারের অনুপ্রেরণায় আমার এ বইটি প্রকাশিত হয়। ১৯৬৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাই, স্যার আমাকে লেখালেখি বন্ধ না করে চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। স্যারের এ কথা আমি মনে রাখি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও গল্প লিখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা অনেক পত্রিকা বের করতো, আমি সবখানে একটি গল্প লিখতাম। এমএ পাশ করার পর গল্পগুলো দিয়ে একটা বই প্রকাশ করতে বলেন হাফিজ স্যার। আমার দুই চোখে পানি এসে যায়। স্যার বললেন, ‘তোমার প্রকাশিত বই থাকলে জীবনবৃত্তান্ত অন্য সবার চেয়ে আলাদা হবে। চাকরি পেতেও কাজে লাগবে।’ অবশেষে স্যারই ছাপাখানা ঠিক করে দিলেন, ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘উৎস থেকে নিরন্তর’। তার পরের বছর বাংলা একাডেমিতে চাকরি হয় আমার।

আপনার সাহিত্যচর্চার বড় একটা অংশ জুড়ে আছে শিশু-কিশোররা। তাদের জন্য লিখেছেন ২২টি বই। ২০ বছরেরও বেশি সময় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘ধানশালিকের দেশ’ কিশোর পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছেন। অবৈতনিক নিয়োগে শিশু একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন কয়েক দফা। শিশুকিশোরদের মননশীল করে তুলতে অভিভাবক-শিক্ষক-সংগঠকদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?

শিশু-কিশোরদের বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, তাদের গল্প-উপন্যাস পড়তে দিতে হবে। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়াতে হবে যেন তাদের চেতনাগত দিকটা সংহত হয়। প্রবলভাবে মনে করি শিশু-কিশোরদের প্রতি যদি দায়বদ্ধতা না থাকে, পাঠ্যসূচিতে যদি সুচিন্তা জাগ্রত করবার উপকরণ না থাকে তাহলে তাদের বোধের জায়গাটা নেমে যাবে। শিশুদের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটানো পরিবারের দায়িত্ব। পরিবার তো এককভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে না। সংগঠনগুলো শিশুদের নিয়ে নানা উদ্যোগ নিতে পারে- ওদের দিয়ে গল্প পড়ানো, পড়িয়ে জিজ্ঞেস করা তুমি কী বুঝেছো, নিজেদের একটা গল্প মুখ দিয়ে বলানো, গল্প লেখানো, ওদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করা। এতে করে যদি ওদের চেতনাগত দিকটা একটু আলোকিত করা যায়।

৭৪-এর কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের অন্যতম প্রস্তাব ছিল একমুখী শিক্ষাক্রম চালু করা। দেশে এখন বাংলা, ইংরেজি, আরবি মাধ্যম ছাড়া আরও কয়েক ধরনের নজরকাড়া পদ্ধতি দেখা যায়। যেমন- ‘ক্যাডেট মাদ্রাসা’, ‘ইংলিশ ভার্সন’, ‘ইংরেজি মাধ্যমে মাদ্রাসা’ ইত্যাদি। ভাষা শেখার গোড়াতেই এ গলদ দূর করতে আপনার সুপারিশ কী?

আমি তো বলি যে, আমাদের মাদ্রাসা-ইংরেজি মাধ্যম এসব কোনকিছু না করে প্রাথমিক স্কুলগুলোতে একই ধরণের শিক্ষাক্রম চালু করে সেভাবে শিশুদের বড় করতে। তারপর ভবিষ্যতে কেউ যদি আরবি-ইংরেজি বিষয়ে পড়তে চায় সে ব্যবস্থা তো কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছে।