জুটুন মামা নাকি মরুভূমির জাহাজের তলায় পড়েছেন; এই খবরটা বুবুনদের দিয়ে গেলো রন্টি।
Published : 15 Apr 2024, 09:15 AM
ফুটবল মাঠের পাশ দিয়ে হাঁটতে পারেন না জুটুন মামা। কেবলই পা উঠে যায়! তিনি বাতাসে উড়ে উড়ে হাঁটেন! বুবুন জানতে চায়, ও মামা, তুমি এমন হাওয়ায় ভেসে সামনে পা চালাচ্ছো কেন?
আরে, বলিস না! মাঠে ফুটবল খেলা দেখলে আমার পা-ও ফুটবলের গায়ে গিয়ে পড়তে চায়। তাই তো এমন হাওয়ায় ভাসি। একবার কী হয়েছে জানিস, বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা চলছিলো। আমিও টিভির সামনে বসছি খেলা দেখতে। ব্রাজিলের রোনালদিনহো যখনই গোলপোস্টের সামনে বল নিয়ে যায় তখনই আমার পা চলতে থাকে।
তো পা চালাতে চালাতে এমন জোরে চালালাম সামনের ছোট টেবিলটায়; আর কিছু মনে নেই! পরদিন জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাসপাতালে। সেই থেকে আমি খেলা দেখতে বসলে তোর নানাভাই আমার পা বেঁধে রাখেন চেয়ারের সঙ্গে! আচ্ছা শোন, এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখতে তো কাতার যাচ্ছি। হায়া কার্ডও পেয়ে গিয়েছি।
বুবুনরা তো অবাক। বলেন কি মামা! জুটুন মামা একটা মুচকি হাসি দিয়ে জামার কলারটা টেনে বুক টান টান করে দাঁড়ায়। মামার এই খবরে তারা খুব খুশি। জুটুন মামাকে বুবুনরা চুপিচুপি একটা আবদার করে ফেলেছে তাৎক্ষণিক। জুটুন মামাও তাদের পিঠ চাপড়ে বলেন, নিজের জন্য কিছু করতে পারি আর না পারি তোদের আবদার রক্ষা করবোই! সেই জুটুন মামা নাকি মরুভূমির জাহাজের তলায় পড়েছেন; এই খবরটা বুবুনদের দিয়ে গেলো রন্টি। তার আগে রটে গেলো কলোনিতে।
বাতাসের আগে যেন বুবুনদের কলোনিতে কথা ছড়ায়! এই সেদিনও ছাদ থেকে তৃষা আপুর মোবাইলটা পড়ে গেলো। নিচে পড়ার আগেই পাড়ায় রটে গেলো সেই খবর। সে যাক, বুবুনরা বিশ্বাসই করতে পারছে না। এ কী করে সম্ভব? মরুভূমির জাহাজখ্যাত উটের গতিবিধি যার নখদর্পণে, এক কুঁজো, দুই কুঁজো উট নিয়ে যার বিস্তর গবেষণা, সে কিনা পড়লো মরুভূমির জাহাজখ্যাত উটের পায়ের তলায়!
জুটুন মামা মরুভূমিতে যাননি আগে কখনও। তাতে কি; তিনি তার সাড়ে তেতাল্লিশ বছর জীবনের প্রায় সাড়ে বেয়াল্লিশ বছরই কাটিয়ে দিয়েছেন মরুভূমি বিষয়ক ভাবনা-চিন্তায়! এই সেদিনও কাতার যাওয়ার আগে বলে গেলেন, কাতারের মরুভূমি ওম সাইদের সোনালি বালুরাশির মাঝে মাঝে যে বালুর পাহাড়, মানে যে ধু ধু প্রান্তরে ঢেউ খেলে বালু, ঠিক তার উল্টো দিকেই পারস্য উপসাগরের নীলাভ জলরাশি।
এই মরুভূমি আর সাগরের জলের খেলা দেখতে তাঁবু গাড়ে মানুষ। সেসব তাঁবুতে থাকেন আরবেরা। থাকেন পর্যটকরা। থাকবো আমিও। জিপ গাড়ি আর কোয়াড বাইক নিয়ে মরুভূমিতে চলে ডেজার্ট সাফারি। চলে বালুর এক ‘দেয়াল’ থেকে আরেক ‘দেয়ালে’ ওঠানামার রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা। সেই অভিযাত্রায় যোগ দেবো মরুভূমির জাহাজখ্যাত উটের পিঠে চড়ে। কেবল চড়বোই না, উটের জকি হয়ে ছোটবো। রাতের মরুভূমি কী যে সুন্দর; তা বলে বোঝানো যাবে না! তার উপরে তখন থাকবে জোছনা। উটের পিঠে চড়ে খোলা আকাশের নিচে জোছনা দেখার অপূর্ব সুযোগ কীভাবে মিস করি বলো? বুবুনরা বলেছিলো, তুমি হবে উটের জকি?
বুবুন সবাইকে নিয়ে বালির মাঠে বসে বলে, ভেবে দেখ, কলোনির রাস্তা দিয়ে একটা উটের বাচ্চার গলায় দড়ি লাগিয়ে আমরা টেনে নিয়ে আসছি বালির মাঠের দিকে। আর এই দৃশ্য দেখার জন্য মানুষ রাস্তার দু’পাশে জড়ো হয়েছে।
মামা বলেন, তা নাহলে কি! শোন, এ আমার জন্য কোন ব্যাপার! সাহস আর কৌশল জানা থাকলেই হয়। দুটোই আমি বুকপকেটে নিয়ে চলি বুঝলি? তাছাড়া আমার ওজন হচ্ছে পাখির মতো! উটের পিঠে বসলেই উট ধেই ধেই করে দৌড়াবে! তো এই ধেই ধেই করে মরুভূমির জাহাজ দৌড়ানো জুটুন মামা পড়েছেন উটের পায়ের তলায়! ভাবা যায়! অথচ জুটুন মামা কাতার যাওয়ার আগে বুবুনদের একটা আবদার রাখবেন বলে কথা দিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তোদের জন্য একটা উটের বাচ্চা নিয়ে আসবো। সেই থেকে বুবুনরা উটের বাচ্চার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে।
তারা উটের বাচ্চার জন্য কলোনির শেষের দিকে বালির মাঠে একটা জায়গাও ঠিক করে নিয়েছে। কাঁটাওয়ালা গাছ খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে শেষে একটা ক্যাকটাস গাছ লাগিয়েছে। মরুভূমির উটেরা নাকি কাঁটাগাছ খেতে পছন্দ করে! অরণ্যের দাদা ভাই বলেছেন, গ্রাম থেকে তোদের জন্য একটা কাঁটা মান্দার গাছ পাঠাবো। মাঠের কোণে তারা একটা গর্তও খুঁড়েছে, পানি জমিয়ে রাখার জন্য। পরে বুবুন বলে, উট তো পেটের ভেতরেই পানি জমিয়ে রাখতে পারে ১৫ দিন! এইখানে গর্ত করার কী দরকার। পরে সেই গর্ত আবার বালি দিয়ে ঢেকে দিয়েছে।
উট নিয়ে তাদের ভাবনার শেষ নেই। বুবুন সবাইকে নিয়ে বালির মাঠে বসে বলে, ভেবে দেখ, কলোনির রাস্তা দিয়ে একটা উটের বাচ্চার গলায় দড়ি লাগিয়ে আমরা টেনে নিয়ে আসছি বালির মাঠের দিকে। আর এই দৃশ্য দেখার জন্য মানুষ রাস্তার দু’পাশে জড়ো হয়েছে। অনেকে বিল্ডিংয়ের জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে দেখছে। ভাবতেই যেন বুক ফুলে উঠছে, তাই না?
অথচ সেই ফোলা বুক ফুটো বেলুনের মতো মিইয়ে এলো জুটুন মামার মরুর জাহাজের তলায় পড়ার খবরে। তাই বলে এই খবর শুনে তো আর বসে থাকা যায় না। তারা বালির মাঠ থেকে দলবেঁধে গেলো রন্টিদের বাড়ি। রন্টিই যে খবরটা দিলো তাদের। এর মধ্যে বুবুন বুদ্ধি করে বাসা থেকে বাবার মোবাইলটা নিয়ে এলো। রন্টিদের ওয়াইফাই কানেক্ট করে দিলো জুটুন মামার হোয়াটসঅ্যাপে কল। রিং হতেই মামা কল রিসিভ করে বলেন, ইয়া আল্লাহ, ইয়া আল্লাহ, মাফি কলবিক, আনতা মজনু, জামালুন, জামালুন!
বুবুনরা কিছুই বুঝতে পারে না। ফের কল করে অরণ্য। এবার মোবাইলটা কানে ধরে বুবুন। কল রিসিভ করেই কাঁদো কাঁদো গলায় মামা বলেন, আমি আর মরুভূমিতে আসবো না। উটের পিঠেও চড়বো না। দয়া করে আমাকে দোহায় হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দিয়ে আসুন। এই বলে ভ্যাঁ-অ্যা-অ্যা কেঁদে ওঠে জুটুন মামা। বুবুন এ-পাশ থেকে বলে, মামা, আমি বুবুন। কী হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন? তুমি নাকি উটের তলায় পড়েছো?
মামা ফুঁপিয়ে উঠে বলেন, সে আর বলিসনারে বুবুন, অল্পের জন্য উটের পায়ের তলায় পিষে যাইনি! আমাকে বাঁচা-আ-আ...! কী বলো মামা! উটের পায়ের তলায় পড়লে কেমন করে? শুনেছি মরুভূমিতে যারা উটের জকি হয় তারা অনেক টাকা পায়; তুমিও তো নিশ্চয় উটের জকি হতে গিয়ে উটের পায়ের তলায় পড়েছো! তাহলে তুমিও তো অনেক টাকা পাবে। সেই টাকা দিয়ে আমাদের জন্য একটা উটের বাচ্চা কিনে নিয়ে এসো মামা। প্লিজ, প্লিজ প্লিজ-ই...।
কথা শেষ হওয়ার আগেই টুট-টুট-টুট। কল কেটে যায়। অরণ্য বলে, দেখিস, মামা ঠিকই উটের বাচ্চা নিয়ে আসবে আমাদের জন্য। তখনই দৌড়ে ছাদে আসে রন্টির ছোট বোন তৃণা। সে তাদের হাতে রন্টির মায়ের মোবাইলটা দিয়ে বলে, দেখো ভিডিওটা। বুবুনরা জড়ো হয়ে দেখে, রন্টির ছোট চাচা একটা ভিডিও পাঠিয়েছেন কাতার থেকে। তিনি সেখানেই থাকেন। কাতারের চকবাজারে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করেন। মাঝে মধ্যে মরু সাফারিতে যান। কিছুদিন আগে মরু সাফারিতে গিয়ে এই ভিডিও ধারণ করেছেন। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে এক লোক মরুভূমির উটের পিঠে উঠতে গিয়ে স্লিপার থেকে যেমন করে মানুষ পড়ে তেমনি ছ্যাররর করে পড়ে যাচ্ছে! পড়েই সেন্সলেস হয়ে যায়। তারপর থেকে আবোল-তাবোল বকছে!
অরণ্য চেঁচিয়ে বলে, আরে এটাই তো জুটুন মামা। বুবুনরা বলে হ্যাঁ এই তো, উটের টি-শার্ট। এই টি-শার্টটাই জুটুন মামাকে আমরা ভ্রমণে যাওয়ার আগে অনলাইন শপ থেকে কিনে গিফট করেছিলাম। অরণ্য, বুবুন, রন্টি আর তিতলিও চিনতে পারে টি-শার্টটা। ছোট্ট তৃণা বলে, এই ভীতুর ডিমটা তোদের জন্য আনবে উটের বাচ্চা? যাই আসল রহস্যটা সবাইকে জানাই!