অভিধানে শব্দের একটি অর্থ যেমন পাই তেমন একটি শব্দের একাধিক অর্থও পাই।
Published : 19 Jun 2023, 04:10 PM
অভিধান হলো ভাষার শব্দ সংগ্রহমূলক গ্রন্থ। আমরা অভিধানে শব্দের একটি অর্থ যেমন পাই তেমন একটি শব্দের একাধিক অর্থও পাই। শব্দের অর্থ সবসময় একইরকম থাকে না। কালের পরিক্রমায় একটি শব্দ একাধিক নতুন নতুন অর্থ পরিগ্রহ করে।
ভুক্তিশব্দের সঙ্গে অর্থের সবসময় যে মিল থাকে এমনটিও নয়। এজন্যই অভিধান হলো শব্দের রহস্যঘেরা এক বিস্ময়কর জগৎ। এতে অবগাহন করে নিরবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক স্থাপন করে শব্দের মণিমুক্তা কুড়াতে হয়। ভুক্তিশব্দের সঙ্গে অর্থ গঠনের যে বোঝাপড়া তার পেছনে কাজ করে মানুষের বহুবিচিত্র সব চিন্তাভাবনা। এ সূত্র ধরেই আমরা জানবো এমনই কিছু শব্দের অর্থের গল্প।
কোথাও আগুন লাগলে প্রথমেই যাদের কথা মনে পড়ে, তারা হলেন অগ্নিনির্বাপক বাহিনী। এর পাশাপাশি আমরা বলি দমকল বাহিনী। আর ইংরেজিতে বলা হয় ফায়ার সার্ভিস বা ফায়ার ব্রিগেড। কিন্তু এই আগুন নেভানোর সঙ্গে ‘দমকল’ শব্দটির সম্পর্ক কোথায়? কেন এই অগ্নিনির্বাপক বাহিনীকে আমরা ‘দমকল বাহিনী’ শব্দটি দিয়ে চিহ্নিত করি। তবে চলো এ বিষয়ে তোমাদের কৌতূহলের আগুন ‘দমকল’ বাহিনী দিয়ে নিভিয়ে আসি!
ফারসি ‘দম’ এবং সংস্কৃত ‘কলা >কল’ শব্দ সহযোগে তৈরি হয়েছে ‘দমকল’ শব্দটি। এর অর্থ আগুন নেভানোর যন্ত্রচালিত পাম্পবিশেষ যা দিয়ে পানি নিক্ষেপ করা হয়। একইসঙ্গে অগ্নিনির্বাপক গাড়িও এর অর্থপরিধির অন্তর্ভুক্ত। দমকল শব্দটি আমরা বাংলা ভাষায় প্রথম পাই ১৭৮২ সালে অগুস্তাঁ ওসাঁর শব্দকোষ থেকে।
এবার আসি কেন এ নামকরণ। এর ইতিহাস বলতে প্রায় দেড়শো বছর পিছিয়ে যেতে হবে। তখনকার কলকাতা শহরে আগুন লাগলে, দমকল বিভাগে খবর যেতে যেতে আর ঘোড়ায় টানা জলের গাড়ি আসতে আসতে ৯৫ শতাংশ পুড়ে যেত। তার জন্য ব্রিটিশ সরকার শহরের মোড়ে মোড়ে ফায়ার ব্রিগেডকে সতর্ক করার জন্য যন্ত্র বসানোর ব্যবস্থা করলেন। যন্ত্রটি তৈরির কারিগর ছিলেন ব্রিটিশ অফিসার ক্যাপ্টেন বার্নাড অ্যান্সন ওয়েস্টব্রুক।
তার তৈরি এ যন্ত্রে দেখা যায়, একটি লাল রঙের লোহার বাক্সের ভেতর কাচ দিয়ে ঘিরে রাখা একটা দম দেওয়া মেশিন। এ মেশিনের তার সরাসরি সংযুক্ত করা হলো অগ্নিনির্বাপক অফিসের সঙ্গে এবং নির্দেশ জারি করা হলো কোথাও আগুন লাগলে, নিকটবর্তী মেশিনের কাচ ভেঙে দম মেশিনের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ৩-৪ বার দম দিতে হবে। দম দেওয়ার ফলে মেশিন এক সংকেত পাঠাতো ওই অগ্নিনির্বাপক বিভাগে। যার ফলে ওই বিভাগ সহজেই সংকেত পর্যবেক্ষণ করে অতি দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সক্ষম হতো।
ওই দম দেওয়া যন্ত্র, যার হাতল ঘোরালেই মাটির নিচে পাতা তারের মাধ্যমে ফায়ার ব্রিগেডের কাছে খবর চলে যেত, সেই থেকেই এ বাহিনীর নাম দমকল বাহিনী। প্রকৃতপক্ষে দম দেওয়া কল দিয়ে ডাকা হয় যে বাহিনীকে তা-ই দমকল বাহিনী।
এছাড়াও আরেকটা কারণ আছে এ নামকরণের। সেটি হলো ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িতে যে জলের পাম্পগুলো থাকত, সেগুলোও চালাতে হতো হাতল ঘুরিয়ে অর্থাৎ দম দিয়ে। প্রকৃতপক্ষে এই দুটো দম দেওয়া যন্ত্রের ফলেই ফায়ার ব্রিগেডের বাংলা নাম হয়ে গেল ‘দমকল’। আর এটি শুধু কলকাতায় নয়, ব্রিটিশরা ঢাকাতেও একই রকম যন্ত্র বসিয়েছিল আগুন নেভানোর যথাযথ সংকেত পাওয়ার জন্য।
আমাদের যাপিত জীবনে একটি অতি পরিচিত শব্দবন্ধ হলো ‘ওত পাতা’। জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে আমরা প্রায় সবাই যেমন ওত পেতেছি তেমন ওতে ধরাও পড়েছি। আবার বাস্তব জীবনে না হলেও কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় এ শব্দবন্ধের দেখা পেয়েছি অনেকবার। তোমাদের কী মনে হয়?
সাধারণভাবে আমরা ‘ওত পাতা’ বলতে বুঝি আক্রমণের জন্য বা কারো গোপন কার্যকলাপ অকস্মাৎ ধরে ফেলার জন্য সতর্কতার সঙ্গে প্রতীক্ষা করা। কিন্তু কোথা থেকে এলো এ ‘ওত’ শব্দটি। ‘ওত পাতা’ ক্রিয়া বিশেষ্যের অর্থ যা বুঝি তার সঙ্গে ‘ওত’ শব্দটির সম্পর্ক ঠিক কতটুকু! তবে চলো জেনে নিই সবিস্তারে। আমরা সচরাচর ‘ওত পাতা’ অথবা ‘ওত পেতে থাকা’ কথাটি বাগধারায় প্রকাশ করে থাকি। আক্রমণের জন্য ওত পেতে থাকার কাজটি একাধারে মানুষও যেমন করে ঠিক তেমনি প্রাণিজগতের বিভিন্ন প্রাণীও কিন্তু করে থাকে।
‘ওত’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘ওতুবৎ’ শব্দ থেকে, যার মানে হলো ‘ওতুর মতো’। সংস্কৃত শব্দ ‘ওতু’র অর্থ হলো বিড়াল। তাই শিকার ধরার জন্য বিড়ালের মতো নিঃশব্দে বসে থাকাই হলো ‘ওত পাতা’। বিড়াল কীভাবে শিকারের জন্য ওত পেতে থাকে সে দৃশ্য আমাদের অচেনা নয়। আর এই বিড়ালের আদলেই আমরাও কাউকে আক্রমণ বা কারো গোপন কর্মকাণ্ড অকস্মাৎ ধরে ফেলার জন্য যে সতর্কতার সঙ্গে প্রতীক্ষা করি এটিই ওত পাতা। কী শব্দের রহস্য জানা হয়ে গেল তো! এ খেলা ভারি মজার!
বাতাসা একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হালকা গোলাকার মিঠাইজাতীয় খাদ্যবিশেষ। চ্যাপটা আকারের ২-৪ সেন্টিমিটার ব্যাসবিশিষ্ট এই খাবারটি চিনি অথবা গুড় থেকে জাত। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে এর প্রচলন সবচেয়ে বেশি। একসময় মুড়ি ও বাতাসা দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হতো। শহরাঞ্চলে খুব একটা দেখা না গেলেও গ্রামাঞ্চলে এখনো এই রীতি মাঝে মাঝে চোখে পড়ে।
তবে প্রাচীনকাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বাতাসাকে দেবতার প্রসাদ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। অনেক মন্দিরে ‘হরির লুট’ নামে বাতাসা প্রসাদ হিসেবে ছড়িয়ে দেওয়ার রীতি এখনো প্রচলিত, যা মন্দিরে মন্দিরে ‘হরিলুট’ নামে পরিচিত। এই হরিলুট নিয়ে আরেকদিন গল্প বলবো, কেমন? এবার চলো বাতাসার স্বাদ নিই!
সাধারণত পৌষসংক্রান্তিতে মুড়ি, বিন্নি ধানের খই, তিল্লা, কদমা, উখড়া, খেলনার পাশাপাশি বাতাসাও পরিবেশন করা হয়। দোলযাত্রা, রথ, হরিনাম সংকীর্তন, অষ্টমীস্নান প্রভৃতি ধর্মানুষ্ঠানকেন্দ্রিক মেলায় বাতাসা এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবধরনের পূজায়ও বাতাসার উপস্থিতি লক্ষণীয়। এ তো গেলো বাতাসার প্রয়োজনীয়তার কথা। কিন্তু কীভাবে হলো বাতাসার নামকরণ। বাতাসের সঙ্গে কী এর সম্পর্ক আছে? তবে চলো জানি বাতাসায় বাতাসের তারতম্য সম্পর্কে!
বাতাসা কবে থেকে, কীভাবে বাংলা অঞ্চলে চালু হলো তার ইতিহাস খুব একটা জানা যায় না। তবে আভিধানিক শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অনুসরণ করলে বাতাসার সঙ্গে বাতাসের ব্যুৎপত্তিগত সংযোগ পাওয়া যায়। ‘বাতাসা [বাতাস+আ১২, হি, ঠ বতাসা] বি. চিনির ফাঁপা মিষ্টদ্রব্যবিশেষ।’ অর্থাৎ বাতাসা গুড় বা চিনি দিয়ে এমনভাবে তৈরি যেখানে এর ভেতরটা বুদবুদের সাহায্যে ফাঁপা অংশ তৈরি করে। আর সে ফাঁকা অংশে বাতাস ভর্তি থাকে। সেই বায়ু বা বাতাস থেকেই এই বাতাসা নামের উৎপত্তি।
বাতাসা দুই প্রকারের হয়। একটি হলো ফুল বাতাসা অর্থাৎ ক্ষুদ্রাকৃতি বাতাসা আর অপরটি হলো ফেনি বাতাসা বা বড়ো বাতাসা। রঙের দিক থেকেও বাতাসা দুই রকমের হয়ে থাকে। চিনির তৈরি বাতাসা হয় সাদা আর গুড়ের তৈরি বাতাসা হয় হলুদাভ। একটি ছোটো বাতাসায় ক্যালরির পরিমাণ প্রায় ১০০ শতাংশ।
কবি-সাহিত্যিকদের একাধিক রচনায় বাতাসার উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলা ভাষায় প্রথম বাতাসা শব্দটি পাওয়া যায় অক্ষয়কুমার দত্তের রচনায় আনুমানিক ১৮৫০ সালে [‘বাংলা একাডেমি বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’, ২য় খণ্ড, ২০১৩, পৃ. ২০০৩]। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শুভদৃষ্টি’ গল্পে পিতলের রেকাবিতে করে বাতাসা নিয়ে বিয়ের সম্বন্ধ আনার কথা বলেছিলেন নবীন বাঁড়ুজ্যে। এ গল্পে বর্ণিত বাঙালির অতিথি আপ্যায়নের এই রীতিই যেন আমাদের আতিথেয়তার শাশ্বত পরিচয়।