প্রকৃতি বন্দনায় বন্দে আলী মিয়া

প্রকৃতি যেমন কোনোদিন পুরনো হয় না, বন্দে আলী মিয়ার কবিতাও যেন তাই।

আবু আফজাল সালেহআবু আফজাল সালেহ
Published : 2 Jan 2023, 06:21 AM
Updated : 2 Jan 2023, 06:21 AM

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক প্রতিভাবান কবি বন্দে আলী মিয়া (১৯০৬-১৯৭৯)। গত শতকের ত্রিশ দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত লেখালেখি করেন তিনি, সমৃদ্ধ করেন বাংলা সাহিত্যকে।

মানুষের জীবনযাপন, প্রকৃতি, সামাজ ও রাজনীতির প্রেক্ষাপট ছিল তার সাহিত্যচর্চার মূল বিষয়। সাহিত্যের এ দিকপাল ছিলেন মানবতাবাদী। তার সাহিত্য ভাণ্ডারে এ মনোভাবের পরিচয় পাই। ১৯২৭ সালে কলকাতা থেকে শিশুতোষ বই ‘চোর জামাই’ প্রকাশের পর ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বন্দে আলী মিয়া সাহিত্যচর্চা করেছেন, লিখেছেন প্রায় দুইশ বই। 

বন্দে আলী মিয়াকে বলা হয় বাংলা শিশুসাহিত্যের অন্যতম রথী। চিত্রশিল্পেও খ্যাতি ছিল তার, ছিলেন ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমির প্রথম মুসলিম ছাত্র। তরুণ বয়সেই তার কবিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের (এসএসসি) পাঠ্য তালিকায় যুক্ত হয়, সক্ষম হয় সমকালীন পাঠকের প্রশংসা ও মনোযোগ আকর্ষণে।

‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর/ থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।' 'আমাদের গ্রাম’ শিরোনামে জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত এ কবিতার কবির নাম কারও অজানা নয়- বন্দে আলী মিয়া। ‘আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইয়াছে প্রাণ’ এ অংশটি ছোটবেলায় আমরা অনেকেই না-বুঝে বলেছি ‘আলু দিয়ে বায়ো দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ’, কতই না মজার ব্যাপার ছিল!

কবি আল মাহমুদ নিজেকে আলাদা করেছেন প্রকৃতির কাছে হাত পেতে। বন্দে আলী মিয়া তার আগেই এ পথে হেঁটেছেন।

এ কবির জন্ম ১৯০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর পাবনা শহরের রাধানগরের নারায়ণপুর মহল্লায়। তিনি একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। পাকিস্তান সরকার থেকে প্রাইড অফ পারফরম্যান্স পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি। তার কবিতায় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রকৃতি বন্দনা।

চর নামেই তার তিনটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ আছে- ‘ময়নামতির চর’ (১৯৩২), ‘পদ্মানদীর চর’ (১৯৫৩) এবং ‘মধুমতীর চর’ (১৯৫৩)। আরও উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে- ‘অনুরাগ’ (১৯৩২) ও ‘ধরিত্রী’ (১৯৭৫)। নামগুলো দেখলেই বোঝা যায় প্রকৃতি নিয়েই কবির বসতঘর। শিশুদের জন্য তার গ্রন্থ সংখ্যাও কম নয়- ‘চোর জামাই’ (১৯২৭), ‘মেঘকুমারী’ (১৯৩২), ‘মৃগপরী’ (১৯৩৭), ‘বোকা জামাই’ (১৯৩৭), ‘ডাইনী বউ’ (১৯৫৯), ‘রূপকথা’ (১৯৬০), ‘কুঁচবরণ কন্যা’ (১৯৬০), ‘শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা’ (১৯৬৩) ও ‘সাত রাজ্যের গল্প’ (১৯৭৭)। নাম শুনেই তো বইগুলো পড়তে ইচ্ছে করে, তাই না!

'এ-পারের এই বুনো ঝাউ আর ও পারের বুড়ো বট/ মাঝখানে তার আগাছায় ভরা শুকনো গাঙের তট…উৎসব শেষে খাঁ খাঁ করে হায় শূন্য বালির চর/ এ পারের পানে চাহিয়া ওপার কাঁদে শুধু রাত ভর।’ ‘ময়নামতির চর’ কবিতায় ঘিরে রয়েছে প্রকৃতি। বটগাছ, ঝাউবন, নদী, পাখি, আকাশ, বাতাস, বিল-ঝিল, চর, নদীর তীর, বাঁশি, বলাকা, শিশির, বক, লতা-পাতা ও গাছপালা প্রভৃতি তার কবিতায় অনায়াসে চলে এসেছে। প্রকৃতির সরলমাখা জীবন ওঠে এসেছে কবিতার শরীরে।

বাংলাদেশের গ্রামের সৌন্দর্য, সহজ সরল মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন বন্দে আলী মিয়া। গ্রামে রয়েছে মাঠভরা ধান, জলভরা দীঘি, কুলকুল বয়ে যাওয়া নদী, মাথার উপর বলাকার সারি, বাঁশঝাড় আর জলাশয়। পাখপাখালি, গাছগাছালি দিয়ে মোড়া আমাদের গ্রাম। এছাড়া পাঠশালায় যাওয়ার পথের দৃশ্য, মায়ের আদর, খেলাধুলা প্রভৃতি নিয়ে কবিতা সাজিয়েছেন তিনি। ফলে শিশুদের কাছে অনিন্দ্য হয়ে উঠেছে তার কবিতা।

প্রকৃতির গভীরে তাকালে আমরা যেন সবকিছু আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি। নগরের মতো প্রকৃতিতে তাড়াহুড়ো নেই, তার সবকিছুই যেন সম্পন্ন হয় সঠিক সময়ে। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আমরা পাই প্রকৃতির ছোঁয়া। কবি আল মাহমুদ নিজেকে আলাদা করেছেন প্রকৃতির কাছে হাত পেতেই। বন্দে আলী মিয়া তার আগেই এ পথে হেঁটেছেন।

প্রকৃতিকে ভালোবাসলে তবে আমরা সব জায়গায় এর সৌন্দর্য দেখতে পাই। প্রকৃতির নিয়মে রয়েছে নিরাময়- রাতের পরে সকাল আসে এবং শীতের পর আসে বসন্ত। এ নিয়মে রয়েছে সুর আর ছন্দ। কবিতায়ও সুন্দর সুন্দর মিল দিয়ে সুর তৈরি করেছেন বন্দে আলী মিয়া। ছন্দে ছন্দে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের গ্রাম, প্রকৃতি। যেমন-

“খাঁচার দুয়ার আলগা পাইয়া উড়ে গেছে পাখি বনে,

ছোট কালো পাখি উড়ে গেছে দূর নীল নভ অঙ্গনে।

শূন্য খাঁচাটি অনাদরে হোথা পড়ে আছে এক ধারে,

খোকা বসি পাশে অশ্রুসজল চোখ মোছে বারে বারে।

একদা খোকন দূর দেশে গিয়ে এনেছিল এক পাখি,

সারাদিন তারে করিত যতন সযতনে বুকে রাকি।

সহসা পাখিটি কালে ডানা মেলি উড়ে গেল দূর দেশে,

তারি শোকে আজ খোকার নয়ন অশ্রুতে যায় ভেসে।” (পাখি)

মীর মশাররফ হোসেনের (১৮৪৭-১৯১২) পর বাংলা সাহিত্যে যে কয়জন মুসলিম সাহিত্যিক সাহিত্যচর্চা করে খ্যাতি লাভ করেছেন বন্দে আলী মিয়া তাদের অন্যতম।

আলো-ছায়া-রঙ যেন প্রকৃতির হাসি। প্রকৃতি নিজেই যেন শিল্প। প্রকৃতির যে একটা তাল-লয় আছে, তা যেন কবিতায় নিয়ে এসেছিলেন কবি। প্রকৃতি তো বেড়াতে যাওয়ার জায়গা নয়, এটা আমাদেরই বসবাসের জায়গা।

“তোমারে পাই জ্যোৎস্না রাতের

 অলস ঘুমের মাঝে

 আমার বাঁশী তোমার জ্যোৎস্না

 গভীর সুরে বাজে।

...তোমারে পাই শরৎ প্রাতে

 শিশির-ছেঁচা ফুলে

 নৃত্য তব উছলি উঠে

 নদীর কূলে কূলে।

...অশোক শাখে মুছেছে তব

 চরণ রাঙা লেখা

 আমের নব মঞ্জরীতে 

 কখনো দেছ দেখা।’ (প্রিয়া)

প্রকৃতির মাঝে গেলে আমরা ভালো হয়ে উঠি, প্রকৃতিকে জানলে প্রকৃতিকে ভালোবাসলে আমরা কখনই ব্যর্থ হবো না। প্রকৃতির সৌন্দর্য যেন উপহার।

“খোকার বাড়ি কমলডাঙার গাঁয়

শালিক ঘুঘু ডাকে সেথায় সবুজ পাতার ছায়।

সেইখানেতে ফোটে শালুক চলনবিলের জলে

পানকৌড়ি ডুব ভাঙিয়া সাঁতার দিয়া চলে,

সেই বিলেতে দাম বেঁধেছে কলমীকাজল লতা

সেথায় বসে ডাহুক বক জানায় মনের কথা।” (খোকন যাবে বাণিজ্যে)

প্রকৃতি যেমন কোনোদিন পুরনো হয় না, বন্দে আলী মিয়ার কবিতাও যেন তাই। মীর মশাররফ হোসেনের (১৮৪৭-১৯১২) পর বাংলা সাহিত্যে যে কয়জন মুসলিম সাহিত্যিক সাহিত্যচর্চা করে খ্যাতি লাভ করেছেন বন্দে আলী মিয়া তাদের অন্যতম। বিশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ এ সাহিত্যিকের লেখার বিষয়- বৈচিত্র্য, প্রকাশভঙ্গি, ইতিহাস চেতনা তাকে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ১৯৭৯ সালের ১৭ জুন রাজশাহীতে মারা যান এ কবি।

বন্দে আলী মিয়াকে নিয়ে জীবনী-সংক্রান্ত বই প্রকাশিত হয়েছে একটি- বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত গোলাম সাকলায়েনের ‘বন্দে আলী মিয়া’। বইটি ছোট পরিসরে লেখা হলেও তথ্যসমৃদ্ধ। কবি ও কথাসাহিত্যিক আলাউদ্দীন আল আজাদের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি দুই খণ্ডে প্রকাশ করেছে ‘বন্দে আলী মিয়া রচনাবলী'।এছাড়া বন্দে আলী মিয়ার শিশুসাহিত্য সম্পর্কে একটি বই লিখেছেন তসিকুল ইসলাম, শিরোনাম ‘শিশুসাহিত্যে বন্দে আলী মিয়া’।

কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!