আমি ফুটবল খেলা শুরু করি ২০১১ সালে। তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মায়ের নামে চালু হয় ‘বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট’, সেখান থেকে আমার উঠে আসা।
আমার স্কুলের নাম ‘৩৬ নং উত্তর পাথালিয়া বিদ্যালয়’। স্কুল থেকে শিক্ষকরা আমাকে খেলার জন্য বাছাই করে। ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতাম আর সেখান থেকে আমাকে বাছাই করা হয়। তারপর গ্রাম থেকে ইউনিয়নে খেলতে যাই। যখন উপজেলাতে খেলতে গেলাম তখন আমার কোচ গোলাম রায়হান বাপন স্যারের সহযোগিতা পাই। আমি যেখান থেকে এসএসসি পাশ করছি সেই সূতী ভিএম পাইলট মডেল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, লতিফ স্যার এবং অনেক বড় ভাইয়ারা যারা আমাদের স্কুলের আশপাশে থাকেন, তারা আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন।
আমি যখন স্কুল টিমের হয়ে খেলি তখন আমাদের উপজেলা চেয়ারম্যান ইউনুস তালুকদার ঠান্ডু স্যার আমাকে যথেষ্ট পরিমাণ সহযোগিতা করেছেন। যখন যা লাগতো খেলার সামগ্রী, বুট কেনা, বল কেনা থেকে শুরু করে অনেককিছু। এমনকি বাপন স্যারের কথা এলে অনেককিছু বলতে হয়। কারণ আমার যখন টাকা থাকতো না, বাপন স্যার আমাকে অনেকগুলো টাকা দিতো। এমনকি দুই-তিনদিনের জন্য টাকা দিয়ে রাখতো। কারণ আমার বাড়ি সাত থেকে আট কিলোমিটার দূরে ছিল, ওখান থেকে যাতায়াত করতাম। যখন আমার কাছে টাকা থাকতো না, তখন বাপন স্যার দিতো কিংবা বাবার কাছে চাইতাম, না থাকলে অন্য কারও কাছে চাইতাম।
ফুটবলের জন্য অনেক পিটুনি খেয়েছি। মনে হয় রেগুলার খেতাম। কারণ যখন সন্ধ্যা হয়ে যেতো তখনও আমি বাড়ি আসতাম না, ফুটবলে মগ্ন থাকতাম। আমাদের হিন্দু পরিবার, ওই সময়টায় আমাদের সন্ধ্যা বাতি দিতে হয়। সন্ধ্যা বাতির দায়িত্বটা আমারই ছিল, যদি না দিতাম মা বকা দিত। যদি বেশি দেরি করতাম তাহলে কী বলবো, মারতো। আসলে তখন সময়টা খুবই কষ্টের ছিল। কারণ আমি বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে।
যখন ক্যাম্পে আসি তখনকার একটা কাহিনি বলি। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক ফুটবল শুরু হচ্ছে, আমি ক্যাম্পে ওঠি। তখনই আমার মায়ের অ্যাপেন্ডিসাইটিসের অপারেশন হয়। তখন মা হাসপাতালে, আর আমাকে ক্যাম্পে আসতে হয়েছে। ক্যাম্পে আসতেই হবে এরকম একটি পরিস্থিতি ছিল। তো ওই সময়ে আমার খুব কষ্ট লেগেছে যে মায়ের পাশে থাকতে পারছি না, মায়ের যত্ন নিতে পারছি না। অবশেষে মায়ের অপারেশন হয়, ওটা একটু বেশি মনে পড়ে আর কি!
ক্যাম্পে আমরা যারা ছিলাম সবাই বাবা-মা ছাড়া ছিলাম। আর ম্যাডাম-স্যাররা তো আছেনই, তারা আমাদের নিজের সন্তান বা ছোট ভাই-বোনের মতো স্নেহ ও মায়া-মমতা দিয়ে এখানে রেখেছেন। তারাও অনেক পরিশ্রম করেছেন আমাদের পেছনে, মনেই করতে দেননি যে এখানে আমরা বাবা-মা ছাড়া আছি।
আসলে আমাদের সিনিয়র টিমে কোন সাফল্য ছিল না। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ হচ্ছে আমাদের প্রথম সাফল্য। আমাদের সঙ্গে যারা ছিলেন স্যার-ম্যাডাম-কর্মকর্তা আর যারা নারী ফুটবলের সঙ্গে আছেন তারা সবাই এই সাফল্যের অংশীদার। দুটি ম্যাচ আমাকে অনেক ভুগিয়েছে, কারণ আমি গোল করতে পারিনি। এটা আমার জন্য কোন সমস্যা ছিল না, কিন্তু আমি ওই দুটি ম্যাচ ভালো খেলতে পারিনি এটাই দুঃখ ছিল। খেলোয়াড় হিসেবে আমার ভালো খেলতে না পারাটা ভালো দেখায় না, এটা উপলব্ধি করতে পেরেছি এবং নিজেকে যাচাই করেছি। যখন ভারতের সঙ্গে ম্যাচটা হয়েছিল তার আগে ভাবছিলাম আমার ভালো খেলতে হবে, তারপর আমি টিমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খেলতে পেরেছি এবং নিজের পারফরমেন্স শো করতে পেরেছি। নিজে গোল করেছি এবং গোল করিয়েছি। আমি ভাবছি যে চান্স পেলে গোল করবো, কিন্তু কখন জোড়া গোল হবে এটা আসলে বলা যায় না, কখন কোন সময়ে কয়টা গোল হয়ে যায় কেউ বলতে পারে না।
একটা সময় অনেকে অনেক কথা বলতো। মেয়ে মানুষ হয়ে কেন ফুটবল খেলছি এমন প্রশ্ন আসতো। এমনকি নিজের কাছের মানুষও বলতো, শুধু যে পাড়া-প্রতিবেশী তা নয়। আত্মীয়-স্বজনরা মা-বাবাকে বলতো যে, মেয়েকে কেন ফুটবল খেলতে দিচ্ছো? কয়েকদিন পর তো বিয়ে দিতে হবে! বড় হয়ে গেছে! বিয়ে দিতে পারবা না। -এরকম নানা ধরণের কথা বলতো। তো বাবা যদি না-ও বলতো মা এসে বলতো এরকম কথা বলছে মানুষ। আমাকে আসলে এসব কথা দমিয়ে রাখতে পারেনি। আর আমি ছোট্ট থেকেই সাইকেল চালাতাম। সাইকেল নিয়ে স্কুলে যেতাম, স্কুল থেকে আসতাম। অনেকে অনেক কথা বলতো, মেয়ে মানুষ হয়ে সাইকেল চালাচ্ছি কেন! আমি এসব কথায় কান দিতাম না। মানুষ একবার-দুইবার-তিনবার বলবে, কিন্তু পরবর্তীতে আমি কোন উত্তর দিচ্ছি না বলে তারা এমনিতে থেমে যাবে।
আমাকে আসলে এসব কথা কখনও আটকাতে পারেনি। বাড়ি থেকে যখন বের হয়েছি তখন বাবা-মা-কাকা, আমার ছোট ভাই এবং এলাকায় যারা আছেন সবাই আমাকে সার্পোট করছে। স্কুলে আসার পর তো সব দায়িত্ব টিচারদের উপর থাকে। তখন আমার কোচ আমাকে বলতো, ‘সবার আগে ডিসিপ্লিন মেনে চলবা। মানুষের একটা মনোভাব আছে সেটা নিয়ে চলবা, মানুষ যদি কিছু বলে তোমার কিছু বলার দরকার নাই। তুমি শুধু মাথা নিচু করে আসবা, আবার মাথা নিচু করে চলে যাবা।’ স্যার শুধু আমাকে এ কথাটাই বলতো।
মেয়েদের উদ্দেশে একটা কথাই বলা যে, এখন যেহেতু নারীরা ফুটবলে অনেক এগিয়ে আছে, ঘরে বসে না থেকে মেয়েরা যেন ফুটবলে আসে। আমরা যেন নারী ফুটবলকে ভালোবাসি। যেসব অভিভাবকদের মেয়েরা ফুটবল খেলতে ইচ্ছুক আমরা যেন বাধা না দিই, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিয়ে তাদের ফুটবলে আগ্রহী করে তুলি।