মগড়া নদীর পাড়ে লোকজন হুট করে থমকে যায়। একি! ঘোড়দৌড়ে জিতেছে তো ওই গরুটা!
Published : 16 Nov 2023, 10:44 AM
বেলা এগারোটাতেও পৌষের হিম আড়মোড়া ভাঙ্গেনি মগড়া নদীর পাড়ে। দীঘল মাঠে তখন জমে গেছে হাজারো লোকজন। বাঁশ লাগিয়ে তাদের সীমানা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
সবাই নেত্রপুর গ্রামবাসী নয়। আশপাশের গ্রাম থেকেও লোকজন এসেছে। কারো কারো শহরে থাকা স্বজনও চলে এসেছে। লোকজনের ঠেলাঠেলি যত বাড়ছে কুয়াশা তত সরে যাচ্ছে নদীর ভেতরে। আড়াই মাইল মাঠের এক প্রান্তে এক সারি ঘোড়া দাঁড়িয়ে।
ওরা স্থির দাঁড়িয়ে নেই। খুর ঠুকছে। আগুপিছু করছে। মাথা ঝাঁকিয়ে চিঁহিঁ চিঁহিঁ করছে। সওয়ারিরা কেউ কেউ লাগাম হাতে ঘোড়ার পিঠে মালিশ করছে। কেউ ছোলাভরা হাত বাড়িয়ে রেখেছে। ঘোড়া একবার খাচ্ছে। একবার খাচ্ছে না। সওয়ারিরা লাফিয়ে উঠে বসছে এবার ঘোড়ার পিঠে। আর একটু পরেই শুরু হবে ঘোড়দৌড়।
ওদিকে বাঁশের ওপাশে ভিড়ে চঞ্চল হয়ে উঠেছে একটা ধলা গায়ে কালো ফুটকি দেওয়া গরু। পটকার আওয়াজ হতেই লোকজন হই হই করে উঠল। মাঠের ঘোড়াগুলো কান খাড়া করে ফেলেছে। সওয়ারিরা মুখে বিচিত্র আওয়াজ করলে কয়েকটা ঘোড়া সামনে ছুট দিল। আর কয়েকটা উল্টো দিকে ঘুরে গেল। একজন সওয়ারি পড়ে গেল। তারপর হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে ঘোড়াটাকে বহু কসরতে বাগে এনে পিঠে বসে ছুটল। ততক্ষণে বাকি ঘোড়াগুলো এগিয়ে গেছে। একটা ঘোড়া ওই প্রান্তের লালফিতা ছিঁড়ে ফেলে আবার উল্টো পথে টগবগ টগবগ আওয়াজ তুলে ফিরছে।
মহীন এসে ধপাস করে গরুটার পেটে ভর দিয়ে শুয়ে পড়ে। শালিকগুলো ফুরুৎ করে উড়ে যায়। গরুটা চমকে ওঠে।
লোকজনের শীত কেটে গেছে। তারা চিৎকার করছে। কাঁধে শিশু তুলে লাফাচ্ছে। শিস দিচ্ছে। হাততালি দিচ্ছে। ধলা গায়ে কালো ফুটকি দেওয়া গরুটা একবার ডানে ছুটছে। একবার বামে। একবার মাথা গলিয়ে দিচ্ছে ভিড়ের ভেতরে। কে যেন গরুটার গলার দড়ি ধরে টান দিল। টেনে টেনে নিয়ে চলল। আয় বেটা আয়! তুই আবার আইছস ঘোড়ার দৌড়ানি দ্যাখতে! তোরে আইজকাও বাইন্ধা রাখুম গোয়ালে।
গরুটা যেতে চাইছে না। গেরস্ত ওকে হিড়হিড় করে টানছে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দড়ি ফসকে গেল গেরস্তের হাত থেকে। গরুটা ছুট দিল। চলে এলো বাড়ির পেছনে অশ্বত্থ গাছের পাশে। এখানে ঘাস আছে। চরে বেড়ানো যায়। পুকুর আছে। জলে মুখ ডুবিয়ে রাখা যায়। গরুটার মন খারাপ। ঘাস খেলো না। জল খেলো না। অশ্বত্থের ধারে চার পা মুড়ে আধশোয়া হয়ে মুখটা এলিয়ে দিল মাটিতে। এভাবে কতক্ষণ কেটে যায়। দুচারটা শালিক এসে গরুটার গায়ে বসে। গরুটা নড়ে না।
মহীন এসে ধপাস করে গরুটার পেটে ভর দিয়ে শুয়ে পড়ে। শালিকগুলো ফুরুৎ করে উড়ে যায়। গরুটা চমকে ওঠে। মহীন কাঁদছে। গরুটা নাক দিয়ে ফোঁস করে বাতাস ছাড়ে। ঘাড়টা ঘুরিয়ে মহীনের কাছে মুখ নিয়ে যায়। নিশ্চয়ই গেরস্ত কিছু বলেছে আজ। লোকটা বড় চিরচিরে মেজাজের। মহীনের কান্না থেমে যায়। গরুটার দিকে তাকিয়ে বলে, বাবা তোমাকেও বকেছে বুঝি? সে তো হরদমই বকে। তোমাকে কী বলেছে আজ?
গেরস্তের কথা মনে করে গোঁও গোঁও করে ওঠে গরুটা। বড় হয়ে কে কী হতে চায় সেই রচনা লিখে নিয়ে যেতে বলেছে মহীনের ক্লাসে। স্কুল থেকে ফিরে বাবাকে সে কথা বলেছিল মহীন। আরও বলেছিল, আমি বড় হয়ে কবি হতে চাই। কবির চোখে দেখব এবার জগৎটাকে। কবি হওয়ার কথা লিখব রচনাতে।
গেরস্ত তাই শুনে রেগে যায়। বলে, তোরে লেখাপড়া শিখাইতেছি যেন তুই ডাক্তার নাইলে জজ-ব্যারিস্টার হইতে পারস। তা যদি নাও হইতে পারস, তাইলে চাষার পোলা চাষা হবি। কবি হইলে কি প্যাটে ভাত জুটবো? সেসব কথা মনে করে মহীন আবার কাঁদতে কাঁদতে নাক টানে। হাতের তালু ডলে ডলে চোখ মোছে। গরুটা গম্ভীর গলায় বলে, গেরস্ত লোকটা ওরকমই। আমিও কতবার ঘোড়দৌড়ে দৌড়াতে চেয়েছি। আমাকে গেরস্ত তুই-তোকারি করে বলত, গরু হয়েছিস ... গরুর মত থাকবি।
গরুটা হাল না ছেড়ে ছুটতে থাকে। মহীন লাগাম ধরে গরুটার পিঠে ঝুঁকে বসে সামনে তাকিয়ে আছে। ওরা প্রাণপণে ছুটছে। বাঁশের সীমানায় উপচে পড়ছে লোকজন।
গরুটার কাজল পরানো দিঘির সমান চোখে জল ছলছল করে সেসব অপমান মনে করে। মহীন গরুটার গলা জড়িয়ে ধরে। প্রাচীন অশ্বত্থ তলায় ওরা একে অন্যের দুঃখ ভাগ করে নেয়। মন খারাপ হলে ঘুম পায়। গরুর গায়ে হেলান দিয়ে মহীন ঘুমিয়ে যায়। গরুটাও ঘাসে গা এলিয়ে দুঃখী দুঃখী চোখে ঘুম আটকে রাখতে পারেনি। মগড়া পাড় থেকে ভেসে আসা ঢোল-করতাল আর তালি ওদের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়।
মহীন তড়াক করে বসে তুড়ি বাজালো। ইউরেকা! তুমি ঘোড়দৌড়ে দৌড়াবে। দেখো আমি কী করি। গরুটা কিছু বুঝল না। মহীন পকেট থেকে সাদা কাগজ আর কলম বের করে। সাদা কাগজ ফর ফর করে ছিঁড়ে ফেলে। চোখা করে ভাঁজ দেয়। ভাঁজ করা সাদা কাগজে কলম দিয়ে কালো বড় বড় ফুটকি এঁকে দেয়। গরুটার কান টেনে ওই কাগজ বসিয়ে দেয় ডগাতে। নিমিষে গরুটা বদলে গেল। এবার গায়ের কালো সোয়েটার খুলে উল ছাড়িয়ে নিল মহীন। গরুটার লেজের গোড়ায় উলগুলো আটকে দিল।
গরুটা উঠে দাঁড়ালো। মহীনও উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে দিতে লাফাচ্ছে। গরুটাকে এখন নাদুসনুদুস ঘোড়ার মত লাগছে। গরুর পিঠে চড়ে বসে মহীন বলে, কি! ছুটতে পারবে তো? ছুটতে ছুটতে মগড়া নদীর পাড়ে আসে ওরা। মাঠের প্রান্তে আরেক সারি ঘোড়া দাঁড়িয়েছে। আরেক পর্ব ঘোড়দৌড় হবে। গরুটাকে নিয়ে মহীনও ঢুকে যায় ওই সারির মধ্যে। ব্যান্ডপার্টির বাদকরা ট্রাম্পেটে ফুঁ দিতেই ঘোড়ার সারি খুরের আওয়াজ তোলে। গরুটা ভড়কে যায়। ততক্ষণে সামনে এগিয়ে গেছে ঘোড়ার দল।
গরুটা হাল না ছেড়ে ছুটতে থাকে। মহীন লাগাম ধরে গরুটার পিঠে ঝুঁকে বসে সামনে তাকিয়ে আছে। ওরা প্রাণপণে ছুটছে। বাঁশের সীমানায় উপচে পড়ছে লোকজন। ওরা দেখছে ধলা গায়ে কালো ফুটকি দেওয়া অদ্ভুত একটা ঘোড়া প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। গরুটা মাঠে ধুলো উড়িয়ে এগোচ্ছে। পাশ কাটাচ্ছে একেকটা ঘোড়াকে। আর একটু সামনেই টকটকে লাল ফিতা। গরুটার জেদ চেপে যায়। ওই লাল ফিতায় গুঁতো দিতেই হবে ওকে। এই তো আর একটু।
টান টান করে ধরে রাখা লাল ফিতাটার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গরুটা। মহীনও পড়ে যায় মাটিতে। ধড়ফড় করে উঠে জামা থেকে ধুলো ঝাড়ে। গরুটাও সামনের ভাঁজ করা হাঁটু সোজা করে দাঁড়ায়। এদিকে গরুটার কালো উলের লেজ খুলে গেছে। কাগজের কানও মুচড়ে গেছে। মগড়া নদীর পাড়ে লোকজন হুট করে থমকে যায়। একি! ঘোড়দৌড়ে জিতেছে তো ওই গরুটা!
কেউ একজন নীরবতা ভেঙ্গে করতাল বাজিয়ে এগিয়ে আসে। লোকটা সেই গেরস্ত। গরুটার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় গেরস্ত। গরুটার গলা জড়িয়ে ধরে। তারপর মহীনের দিকে ফিরে হেসে বলে, কি রে তুই কবি হইতে চাওয়ার রচনাডা লেইখা শেষ করোস নাই এহনও? মহীন দৌড়ে এসে গেরস্ত বাবাকে জড়িয়ে ধরে। আর দৌড়ে জেতার আনন্দে গরুটা গোঁও গোঁও করে ওঠে। থেমে থাকা ঢোল বেজে ওঠে। মগড়া পাড়ে লোকজন হুল্লোড় করে ওঠে।