হঠাৎ ব্যাগ থেকে টুপ করে যেন কী একটা পড়লো। শুভ্র দেখলো বেঞ্চে তারই পাশে ছায়ার মতো কী যেন একটা বসে আছে।
Published : 22 Mar 2024, 10:40 PM
টিফিন পিরিয়ডে স্কুলব্যাগ থেকে টিফিন বক্স বের করতেই হতভম্ব হয়ে গেল শুভ্র। এতো হালকা লাগছে কেন টিফিন বক্স? শুভ্রর বাবা প্রতিদিন টিফিন বক্স সাজিয়ে দেয় শুভ্রকে। আজ বক্স ভরে খাবার দিয়েছিল বাবা। কোথায় গেল সেসব খাবার!
টিফিনবক্স কানের কাছে নিয়ে ঝাঁকাল শুভ্র। ঠক ঠক আওয়াজ হচ্ছে। মনে হচ্ছে ভেতরে খুব হালকা কিছু একটা আছে। কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই টিফিনবক্সের মুখ খুলল শুভ্র! সে কী! বক্সের ভেতরে আছে শুধু আধখাওয়া একটা খেজুরের বিচি! মনে হচ্ছে যেন কেউ একজন দাঁত দিয়ে কামড়ে খেয়েছে খেজুরের বিচির বাকি অংশটুকু।
কী আশ্চর্য! শুভ্র জানে আজ টিফিনে বাবা নুডলস, একটি সিদ্ধ ডিম আর তিনটি খেজুর দিয়েছিলেন বাবা। কোথায় গেল খাবারগুলো! ওগুলো কী ব্যাগে পড়ে গেল নাকি?
এরই মধ্যে টিফিন বক্স হাতে প্রায় সবাই ক্লাশ থেকে বের হয়ে গেছে। ক্লাশরুম একেবারে ফাঁকা। ব্যাগের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে গভীর মনোযোগে খাবার খুঁজছে শুভ্র। নাহ! ব্যাগে কোনো খাবার পড়ে নেই। তবু নিশ্চিত হতে ব্যাগ থেকে একে একে বইখাতা, তোয়ালে, পেন্সিল বক্স, হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর রেইনকোট নামিয়ে বেঞ্চে রাখল শুভ্র। তারপর ব্যাগটি উল্টিয়ে ঝাড়তে শুরু করল সে।
হঠাৎ ব্যাগ থেকে টুপ করে যেন কী একটা পড়লো। শুভ্র দেখলো বেঞ্চে তারই পাশে ছায়ার মতো কী যেন একটা বসে আছে। দেখতে অনেকটাই মানুষের মতো। কিন্তু লম্বায় অনেক ছোট। শুভ্রর দিকে তাকিয়ে সে মিটিমিটি হাসছে।
শুভ্র অবাক হয়ে জানতে চাইলো, ‘তুমি কে?’ সে উত্তর দিল, ‘কী আজব ছেলে রে বাবা! তুমি আমাকে চেন না? আমি ভূতের বাচ্চা। আমার নাম কিটকট। মানুষরা শুনেছি আমাদের দেখলে অনেক ভয় পায়। কিন্তু তুমি তো দেখছি কোনো ভয়ই পেলে না আমাকে দেখে। মানুষরা কেন যে আমাদের দেখলে ভয় পায়, বুঝি না আমি। আমরা কিন্তু আর আগের মতো মানুষের ঘাড় মটকে খাই না। মানুষের রক্ত, মাংস এইসব খাবার আজকাল আর চলে না আমাদের। আমরা তোমাদের মতোই রান্না করা খাবার খেতে ভালোবাসি। ভূতগ্রামে আজকাল অনেক ফাস্টফুডের দোকান হয়েছে কিন্তু। ফাস্টফুড আমাদের দারুণ পছন্দ।’
শুভ্র ভূতের বাচ্চা দেখে যত না অবাক হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি অবাক হয়েছে ভূতদের ফাস্টফুড খাবার কথা শুনে। শুভ্র বললো, ‘তার মানে তুমিই আমার টিফিন খেয়েছ?’ কিটকট মাথা নেড়ে বলল, ‘দারুণ ছিল তোমার টিফিন। কিন্তু তোমার যন্ত্রণায় শেষ করতে পারলাম না খেজুরগুলো।’
শুভ্র বলল, ‘শেষ করতে পারলাম না মানে? কিছুই তো বাকি রাখনি। আমি কী টিফিন খাব একবার ভেবেছ? খেজুরের বিচিটা পর্যন্ত খেয়ে নিয়েছ।’ কিটকট বলল, ‘আধাখানা বিচি খাওয়া বাকি ছিল কিন্তু।’
একথা বলেই টিফিন বক্সে থাকা খেজুরের আধাখানা বিচির উপর চোখ পড়ল কিটকটের। মুহূর্তেই আধাখাওয়া খেজুরের বিচিটি মুখে পুরল কিটকট। তারপর আরাম করে চিবুতে লাগল। বলল, ‘কী মজা! খেজুর আমার খুব পছন্দ।’ শুভ্র বলল, ‘খেজুর আমারও পছন্দ। কিন্তু তাই বলে খেজুরের বিচিও চিবিয়ে খাবে তুমি?’ কিটকট বলল, ‘আহা! রাগছ কেন? খেজুরের বিচি আমার কাছে তোমাদের চিপসের চেয়েও বেশি মজাদার।’
কোনো সাড়াশব্দ নেই কিটকটের। কয়েকবার ডাকার পরও কোনা সাড়া না পেয়ে শুভ্র ভাবল, কিটকট হয়তো ফিরে গেছে।
টিফিনের সময় প্রায় ফুরিয়ে এলো। শুভ্র কিটকটকে আবার স্কুলব্যাগে ঢুকে যেতে বলল। কিটকট বলল, ‘টিফিন খেয়ে তো শেষ করে ফেলেছি। এখন ব্যাগে আছে শুধু বই আর খাতা।’ শুভ্র বলল, ‘ব্যাগে বসে একটু পড়ালেখা করলেই তো পার।’
কিটকট আঁতকে উঠে বলল, ‘পড়ালেখার ভয়ে পালিয়ে এসেছি এখানে। এখানে এসেও পড়তে হবে আমাকে? থ্রিতে ওঠার পর অনেক পড়া বেড়েছে আমার! আর তুমি তো ক্লাশ ফাইভে পড়। তোমার বইপত্র দেখেই ভয় লাগছে আমার। আমি পারব না। তোমার পড়া তুমিই পড়। আমাকে এবার একটু শান্তিমতো ঘুমাতে দাও। তোমার স্কুল শেষ হলে আমাকে জাগিয়ে দিয়ো। আমি তোমার সঙ্গে তোমার বাড়ি যাব।’ শুভ্র বলল, ‘তুমি আমার বাড়ি যাবে? মানে? কেন?’
কিটকট উত্তর দেওয়ার আগেই ঘণ্টা পড়লো। সবাই ক্লাসে ফিরে আসতে শুরু করেছে দেখে শুভ্রর স্কুলব্যাগে চট করে ঢুকে পড়ল কিটকট। এদিকে ক্ষিদেয় পেটটা চোঁ চোঁ করছে শুভ্রর। স্কুল ছুটি হলে ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো শুভ্র। বন্ধুদের এড়াতে প্রতিদিনের রাস্তা ছেড়ে অন্যপথে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিল শুভ্র। কিটকটের সঙ্গে কথা বলতে হবে তার। জানতে হবে কেন সে শুভ্রর সঙ্গে তার বাড়ি যেতে চায়। স্কুল থেকে খানিকটা এগিয়ে একটা নিরিবিলি জায়গা বুঝে ব্যাগের চেইন খুললো শুভ্র। বলল, ‘কিটকট, বাইরে বেরিয়ে এসো।’
কোনো সাড়াশব্দ নেই কিটকটের। কয়েকবার ডাকার পরও কোনা সাড়া না পেয়ে শুভ্র ভাবল, কিটকট হয়তো ফিরে গেছে। কিন্তু যেই না ব্যাগের চেইন লাগাতে গেছে, অমনি ব্যাগ থেকে হুশ করে বেরিয়ে এলো কিটকট। তারপর হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘এইভাবে কেউ ব্যাগের চেইন লাগায় নাকি! আরেকটু হলেই তো আমার ডান কানটা কাটা পড়তো! মিষ্টি করে ডেকে ঘুম থেকে তুলতে পার না? ব্যাগে তো দেখলাম তোমার গানের একটা খাতাও আছে। একটা গান গেয়ে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে পারতে।’
এমনিতেই খিদেয় নাজেহাল অবস্থা, তার ওপর কিটকটের এইসব অদ্ভুত আবদার শুনে শুভ্রর নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে জানতে চাইল, ‘কিটকট, তুমি কেন আমার বাসায় যেতে চাও?’ উত্তরে কিটকট বলল, ‘শুনেছি আর মাত্র কদিন পরে তোমাদের ঈদ। তোমরা নাকি ঈদে অনেক আনন্দ কর? নতুন জামা-কাপড় পর? সেমাই, কোর্মা, পোলাও, মাংস রান্না কর? আমি কখনো এইসব খাবার খাইনি। আমার খুব শখ আমি নতুন পাঞ্জাবী পরে পোলাও-মাংস খাব। আমার টকটকে লাল একটা পাঞ্জাবীরও খুব শখ। তুমি আমাকে একটা লাল পাঞ্জাবী কিনে দিবে?’
ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল শুভ্র। বলল, ‘আমি কীভাবে তোমাকে পাঞ্জাবী কিনে দিব? আমি টাকা পাব কোথায়? আর আমি তোমাকে এতোদিন কোথায় লুকিয়ে রাখব?’ শুভ্রর কথা শুনে কিটকটের চোখ ছলছল করতে লাগল। বলল, ‘তাহলে ঈদ না করেই আমাকে ফিরে যেতে হবে? লাল পাঞ্জাবী পরতে পারব না আমি? ইস! তোমাকে কিন্তু আমার খুব ভাল লেগেছিল। তোমাকে ছেড়ে যেতেও আমার খুব কষ্ট হবে।’
কিটকটের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। কিটকটের চোখে পানি দেখে এইবার ভীষণ কষ্ট হতে লাগল শুভ্রর। সে কিটকটের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি প্লিজ কান্না করো না। একটা কিছু হবেই। আমি মা-বাবাকে তোমার কথা বুঝিয়ে বলব। ওরা নিশ্চয়ই তোমাকে লাল পাঞ্জাবী কিনে দিবে।’ কথাটা শুনেই হাসতে শুরু করল কিটকট। কী সুন্দর ওর হাসি! হাসলে ওর সবকটি দাঁত বাইরে বেরিয়ে আসে। শুভ্র আদর করে কিটকটকে কোলে তুলে নিল। এই ঈদটা নিশ্চয়ই ওরা একসঙ্গে করবে। কিটকটকে ব্যাগে ভরে বাড়ির দিকে দ্রুত এগিয়ে চলল শুভ্র।