ভুবনবিখ্যাত এক ভবনের কথা

স্থপতি মীর মোবাশ্বের আলীর মতে আধুনিক পৃথিবীর সেরা একশটি স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে এটি একটি। ভাবা যায়! তা, তোমরা কি বলতে পারবে এই ভবনটির নাম?

আলম খোরশেদআলম খোরশেদ
Published : 25 July 2022, 04:32 AM
Updated : 25 July 2022, 04:32 AM

আজ চলো তোমাদের আরেকটি অন্যরকম শিল্পমাধ্যমের গল্প শোনাই। অবশ্য এ মাধ্যমটিকে আজও অনেকে ঠিক শিল্প বলে স্বীকৃতি দিতে চান না, বরং একে তারা বিশেষ একটি ‘বিদ্যা’ কিংবা ‘কৌশল’ কিংবা ‘প্রযুক্তি’ হিসেবে দেখতেই বেশি পছন্দ করেন।

আমি স্থাপত্যবিদ্যার কথা বলছি। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়াশোনা করেছি, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে এই নামে একটি আলাদা বিভাগ তথা অনুষদই ছিল, যাকে বলা হত ‘স্থাপত্যবিদ্যা অনুষদ’। অবশ্য আজকাল অনেকেই একে ‘স্থাপত্যকলা’ কিংবা ‘স্থাপত্যশিল্প’ বলতেই পছন্দ করেন। অর্থাৎ শিল্পকলার অন্য অনেক মাধ্যমের মতো স্থাপত্যও আজ একটি ‘শিল্প’ হিসেবে নিজের স্থান করে নিয়েছে।

তা তোমরা কি জান ‘স্থাপত্যবিদ্যা’ বা ‘স্থাপত্যকলা’ বলতে আসলে কী বোঝায়? মূলত ঘর বানাবার বিদ্যাকেই বলে স্থাপত্যবিদ্যা বা কৌশল। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, একে আবার ‘শিল্প’ বলার দরকার কী? এই প্রশ্নের উত্তরটা তোমরা খুব সহজেই পেয়ে যেতে পার, যদি তোমাদের গাঁয়ের তালগাছটায় বাবুই পাখিরা যে বাসাগুলো বানায়, তার দিকে তাকিয়ে দেখ।

এগুলো কি নিছক থাকার জায়গা, নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু? নিশ্চয়ই এগুলোর মধ্যে এমন কিছু নান্দনিক বৈশিষ্ট্য বা শিল্পিত উপাদান রয়েছে, যার ফলে সেগুলো আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং আমরা তাদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই। আর তাই সেটি তখন আর নিছক ‘কৌশল’ না থেকে ‘কলা’ কিংবা ‘শিল্পে’ রূপান্তরিত হয়।

লুই কান জন্মেছিলেন ১৯০১ সালে, এস্তোনিয়ায়। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবা-মার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন তিনি। বাবা ছিলেন কাচের নকশাকার আর মা সংগীতশিল্পী। ফলে লুই কানের মধ্যে জন্মসূত্রেই একজন শিল্পীর বাস ছিল।

তেমনি এক ভুবনবিখ্যাত ভবন রয়েছে আমাদের এই বাংলাদেশেই যাকে আমরা ‘স্থাপত্যশিল্প’ বা ‘বাস্তুকলা’র পরাকাষ্ঠা, অর্থাৎ অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি নিদর্শন বলে আখ্যায়িত করতে পারি। এ ধরনের স্থাপনার ভাবনা যাদের চিন্তার ফসল এবং যারা এদের মূল নকশাকার, তাদেরকে বলা হয় ‘স্থপতি’। বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত স্থপতি ও স্থাপত্যবিষয়ক লেখক মীর মোবাশ্বের আলীর মতে আধুনিক পৃথিবীর সেরা একশটি স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে এটি একটি। ভাবা যায়! তা, তোমরা কি বলতে পারবে এই ভবনটির নাম?

ঠিক বলেছ, এটি হচ্ছে আমাদের সুবিখ্যাত ‘জাতীয় সংসদ ভবন’। বিশ্বখ্যাত এই স্থাপত্যের নকশাকারের নাম লুই ইসাদোর কান, যিনি ‘লুই কান’ হিসাবেই একনামে পরিচিত বিশ্বময়। আমাদের স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর আগে ১৯৬৫ সালে এটি নির্মাণের কাজ শুরু হয়। তখন আমাদের এই দেশ ছিল পাকিস্তানের অংশ। নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের তুলনায় আমাদের লোকসংখ্যা ছিল অনেক বেশি। আমাদের সম্পদ, সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য সবই ছিল সমৃদ্ধতর।

কিন্তু পাকিস্তানের শাসকেরা এ অঞ্চলের মানুষের প্রতি সবসময়ই শত্রুর মতো আচরণ করত। বাঙালিদের ওপর নিত্যদিনই চলত তাদের নির্মম শোষণ আর নির্যাতন। বঞ্চিত হতে হতে এ দেশের মানুষের মনে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠছিল ক্রমে। তখন দেশে ছিল সামরিক শাসন। দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন পাক সেনাবাহিনীর স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। তিনি বিক্ষুব্ধ বাঙালিদের শান্ত করার জন্য তখন ঢাকায় ‘শেরেবাংলা নগর’ নাম দিয়ে একটি দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

ঠিক হয়েছিল দ্বিতীয় রাজধানীতে আইনপ্রণেতাদের সভার জন্য একটি সংসদ ভবন তৈরি করা হবে। এই ভবনের স্থপতি নির্বাচন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ওই সময়কার পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ স্থপতি, বাঙালির ছেলে মাজহারুল ইসলামকে। তিনি তখন এর প্রধান স্থপতি হিসেবে আমন্ত্রণ করে আনলেন বিখ্যাত মার্কিন স্থপতি লুই কানকে।

লুই কান জন্মেছিলেন ১৯০১ সালে, এস্তোনিয়ায়। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবা-মার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন তিনি। বাবা ছিলেন কাচের নকশাকার আর মা সংগীতশিল্পী। ফলে লুই কানের মধ্যে জন্মসূত্রেই একজন শিল্পীর বাস ছিল। আমরা তার প্রতিটি স্থাপত্যকর্মে, বিশেষ করে আমাদের সংসদ ভবনে, তার সুস্পষ্ট ছাপ দেখতে পাই। তিনি ছিলেন পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যশাস্ত্রের ছাত্র। নিজের শহর ফিলাডেলফিয়ার একটি চিকিৎসা গবেষণাগারের নকশা তৈরি করে তিনি প্রথম খ্যাতি অর্জন করেন। তারপর তিনি যে আরও কত শত অসাধারণ সব কাজ করেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

১৯৬২ সালে তৎকালীন সরকারের আমন্ত্রণে লুই কান প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসেন। ভবন নির্মাণের বিষয়টি চূড়ান্ত হয় তখনই। নানা ধরনের জরিপ, সমীক্ষার শেষে অতঃপর নির্মাণকাজ শুরু হয়। মূলত আমাদের দেশজ মাধ্যম ইট ও কংক্রিট, কিছু মার্বেল, নদীমাতৃক বাংলার থৈ থৈ পানি, সবুজের সমারোহ আর সূর্যকরোজ্জ্বল বাংলার অবারিত আলোর সম্মিলন ঘটিয়ে তিনি এই বিশাল প্রকল্পটির নকশা ও বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেন। এরই মধ্যে চলে আসে একাত্তর। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ভবন নির্মাণের কাজটি তখন মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে পুনরায় এর কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৮২ সালে।

কিন্তু এরই মধ্যে ঘটে যায় আর-এক মর্মান্তিক ঘটনা। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ফেরার পথে ১৯৭৪ সালে নিউ ইয়র্কের এক রেলস্টেশনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে মৃত্যু হয় লুই কানের। তিনি তাই দেখে যেতে পারেননি তার এই অসাধারণ স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শনটি। তার মৃত্যুর পর বাংলাদেশের মেধাবী স্থপতি ও প্রকৌশলীরা লুই কানের দেখিয়ে যাওয়া পথ ধরেই মূল নকশার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে ১৯৮২ সালে আমাদের ‘জাতীয় সংসদ ভবন’ নির্মাণের সব কাজ শেষ করেন।

মনে রাখতে হবে, এই ভবনটি একটি অনুপম স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শনমাত্র নয়, এটি আমাদের নবীন গণতন্ত্রের সূতিকাগারও বটে। আমাদের এই দুর্ভাগা দেশটিতে যেদিন প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে যেদিন এই দেশের বুকে নির্মিত হবে একটি সত্যিকার স্বাধীন, সভ্য ও শোষণমুক্ত সমাজ, কেবল সেইদিনই রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক এই ‘জাতীয় সংসদ ভবন’ এর নির্মাতা, স্থপতি লুই কানের প্রতি আমাদের অপরিসীম ঋণটুকু শোধ হবে বলে মনে করি। তোমাদের সবাইকে মনেপ্রাণে সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যেতে হবে বৈকি।