একটি ঐতিহাসিক আলোকচিত্রের কাহিনি

আজ তোমাদের সামনে শিল্পকলার একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় মাধ্যম আলোকচিত্রের ঝাঁপি খুলে বসেছি। আর সেই মণিমাণিক্যে ভরা ঝাঁপি থেকে বার করে এনেছি এমন একটি আলোকচিত্র, যাকে আমরা মুখের ভাষায় সাধারণত ‘ছবি’ বলে থাকি।

আলম খোরশেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 June 2022, 03:11 AM
Updated : 8 June 2022, 03:39 AM

ক্যামেরার আলোতে তোলা এটি একটি সাদাকালো ছবি, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের জন্মের একেবারে গোড়ার গল্প। তোমরা জানো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম তার চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছিল ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু তার সূত্রপাত হয়েছিল সেই ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে, যা কালক্রমে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের আকার ধারণ করে এদেশের তৎকালীন স্বৈরাচারী শাসকের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সেই গণআন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় লড়াকু চরিত্রই এই ছবির মূল নায়ক।

সাকুল্যে নয়-দশ বছর বয়স হবে তার, যাকে প্রায় শিশুই বলা চলে, পথশিশু, সবাই যাদেরকে আদর করে ‘টোকাই’ নামে সম্বোধন করে, তেমনি এক শিশু, যার কোনো চালচুলোর খবর জানা ছিল না কারও, এমনকি তার বাবা-মার দেওয়া আদুরে নামটাও নয়।

১৯৬৯ সালের সেই অগ্নিগর্ভ আন্দোলনের একেবারে শেষ পর্যায়ে একদিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখনকার ঘৃণিত সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের একটি ছবিতে জুতার মালা পরিয়ে মিছিল করে আসছিল হাই কোর্টের দিকটায়। আর সেই মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিল কে জানো? খোদ সেই অকুতোভয় শিশুটি! এই লেখার সঙ্গে ছাপা ছবিটির দিকে এক নজর তাকালেই তোমরা দেখতে পাবে তার চোখে মুখে কেমন জোরালো প্রতিবাদের অভিব্যক্তি আর শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে সুতীব্র ঘৃণা ও আক্রোশ।

তো, এই অভূতপূর্ব দৃশ্যটি হঠাৎ করে চোখে পড়ে যায় সেই সময়কার একজন বিখ্যাত আলোকচিত্রী তথা ফটো-সাংবাদিকের। তিনি আর কালবিলম্ব না করে তার ক্যামেরার শাটার টিপে দেন এবং তার ফিতায় তুলে নেন ইতিহাসের এক জীবন্ত কিংবদন্তি এই দুর্লভ দলিলকে; কেননা তার পরমুহূর্তেই প্রতিশোধকামী, ক্রুদ্ধ পুলিশের গুলিতে রাজপথে লুটিয়ে পড়ে সেই শিশুবীরের রক্তাক্ত, নিথর দেহ। তবে সেই নাম না-জানা শহীদ পথশিশুর রক্ত বৃথা যায়নি। কিছুদিনের মধ্যেই আইয়ুব খানকে তার আরেক সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের হাতে শাসনভার তুলে দিয়ে লেজ গুটিয়ে পালাতে হয়েছিল ক্ষমতার মসনদ থেকে।

তার পরের ঘটনা তো ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। জনতার ক্রমবর্ধমান দাবির মুখে ইয়াহিয়া খান এর পরের বছরই সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। সেই নির্বাচনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু পশ্চিমা শাসকশ্রেণি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার পরিবর্তে গড়িমসি করে নানারকম ছলচাতুরি ও চক্রান্তের আশ্রয় নেওয়ার পাঁয়তারা করতে থাকে।

এভাবে দিন গড়িয়ে যেতে থাকে, আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, যেদিন তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান তথা আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু বজ্রনির্ঘোষে উচ্চারণ করেন তার সেই অমর বাণী, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তার এই উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মরণপণ মুক্তিযুদ্ধে এবং এর ঠিক নয়মাস পরেই, ১৬ ডিসেম্বরের ঊষালগ্নে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লাল সূর্যটিকে।

রশীদ তালুকদার (১৯৩৯-২০১১)

তোমরা শুনে অবাক হবে যে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারণের সেই তর্জনী-ওঁচানো মহাকাব্যিক ভঙ্গিমার ছবিটিও কিন্তু তুলেছিলেন সেই একই আলোকচিত্রী, যার ক্যামেরায় বন্দি হয়েছিল ওই শিশুটির বীরদর্পে মিছিলের নেতৃত্ব দেওয়ার তেজোদ্দীপ্ত ছবিটি।

তোমাদের নিশ্চয়ই খুব জানতে ইচ্ছে করছে সেই সাহসী ও সৌভাগ্যবান আলোকচিত্রী মানুষটির কথা যার হাতে খোদ ইতিহাস ধরা দিয়েছিল তার সবটুকু গরিমা ও সৌন্দর্য নিয়ে। তার নাম রশীদ তালুকদার। তিনি এই দেশের একজন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ফটো-সাংবাদিক; যার নেশাই ছিল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও, ইতিহাসের পেছনে ধাবিত হওয়া এবং তার অতল থেকে মহামূল্যবান সব মণিমুক্তো তুলে আনা। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিসংগ্রামপূর্ব অগ্নিগর্ভ সময় ও স্বদেশের ছবি তুলেই তিনি ক্ষান্ত হননি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তার ক্যামেরাকে হাতিয়ার বানিয়ে সেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং পাক-হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক নিপীড়ন, নির্যাতন এবং অকুতোভয় মুক্তিসেনানীদের বীরত্বব্যঞ্জক প্রতিরোধের অসংখ্য ঐতিহাসিক ছবি তুলে রাখেন তার সর্বত্রগামী সাহসী ক্যামেরার খাঁজে খাঁজে।

তোমরা জানো যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে, পরাজয় নিশ্চিত জেনে, পাকবাহিনী তাদের দেশীয় দোসর, আল শামস ও আল বদর বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান তথা বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে ধরে নিয়ে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে। সেই হৃদয়বিদারক সংবাদ শুনে রশীদ তালুকদার ছুটে যান রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে এবং আরও একবার তার ক্যামেরায় তুলে নেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জীবনের অন্তিম পর্বের মর্মন্তুদ মুহূর্তগুলোকে।

ক্যামেরা-সৈনিক এই রশীদ তালুকদার আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তার বাক্সময় ক্যামেরার শাটার চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে তিনি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন ২০১১ সালে। ছোট্ট বন্ধুরা, চলো আমরা সবাই দাঁড়িয়ে উঠে সেই শহীদ শিশুসেনানী আর তার জীবনের শেষ মুহূর্তের বীরত্বময় আত্মবলিদানের ছবি তুলে রাখা অসামান্য আলোকচিত্রী, দুজনের প্রতিই আমাদের অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি আজ।

আগের পর্ব

কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!