সোমেশ্বরী যেন কত বছর ধরে, কত বাধা-বিপত্তি, ঝড়-বাদল সহ্য করে আসছে, তবুও তার তেজ এতোটুকু কমেনি।
Published : 07 Aug 2023, 12:44 AM
ঈদের ছুটি বলি বা পূজার ছুটি, প্রতিবার কোনো না কোনো জায়গায় আমার যাওয়ার ইচ্ছা থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয়ে থাকে ঢাকার বাইরে। এবছরও ঈদুল আজহার ছুটিতে সেই ইচ্ছার ব্যতিক্রম ছিলো না।
কিন্তু ঈদের আগ পর্যন্ত মা-বাবার মধ্যে কোথাও যাওয়ার কোনো আগ্রহ দেখছিলাম না। ঠিক ঈদের দুই দিন আগে হঠাৎ করে মা-বাবার কাছে শুনলাম আমরা নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরিতে বেড়াতে যাচ্ছি। থাকার জন্য বিরিশিরির ওয়াইডব্লিউসিএ-এর গেস্টহাউজ বুকিং দেওয়া হলো। ঠিক হলো ঈদের দিন দুপুরে আমরা রওনা হবো।
ঈদের দিন সকালে উঠে ব্যাগ গোছানো শুরু করি। তারপর স্নান করে দুপুরের খাবার খেয়ে গাড়ি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। গাড়িতে উঠতেই শুরু হয় বৃষ্টিভেজা পথ ধরে যাত্রা। সেদিন রাস্তা ফাঁকাই ছিলো। তাই বেশ তাড়াতাড়ি আমরা পৌঁছে যাই। ওয়াইডব্লিউসিএ-এর সামনে একটি সুন্দর বাগান রয়েছে। তাই রুমে ব্যাগ রেখে এসে বাগানটিতে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াই।
সেদিন সন্ধ্যার পর আমরা খাবার হোটেলের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। একে তো ঈদের দিন, অধিকাংশ খাবার হোটেল বন্ধ। তার উপর পুরো দুর্গাপুর উপজেলার রাস্তা খারাপ। তবে ভাগ্য ভালো ছিলো বলে আমরা একটি মিষ্টির দোকান খোলা পাই। সেই দোকানে পরোটা, ডাল, সবজি এবং মিষ্টি খাওয়া শেষে গেস্টহাউজে ফিরে আসি। রাতটা নির্বিঘ্নে কেটে যায়।
পরদিন সকালে উঠে দেখি বৃষ্টি হচ্ছে। দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছা ছিলো একটু ঘুরবো, এদিক-সেদিক যাবো। কিন্তু বৃষ্টি কিছুক্ষণের মধ্যে কমে এলো। তখন আমরা বেরিয়ে পড়ি। নাস্তা খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই একটি অটো নিয়ে চলে আসি বিরিশিরির নৌকাঘাটে। যে নদীর উপর এ ঘাট তার নাম সোমেশ্বরী। সেই ঘাট থেকে আমরা উপভোগ করি দূরের মেঘালয় পাহাড়ের অপূর্ব দৃশ্য।
সে পাহাড় অনেক বৃহৎ। তার উপর থেকে ধোঁয়ার মতো কিছু একটা বেরোচ্ছিলো। যা হোক, আমরা কিছুক্ষণ সে দৃশ্য উপভোগ করে নৌকায় উঠি নদীর ওপারে যাওয়ার জন্য। বেশিরভাগ পর্যটন কেন্দ্রগুলো নদীর ওপারে। নৌকায় একসাথে অনেক মানুষ ঠাসাঠাসি করে উঠলো। উঠলো কিছু মোটরসাইকেলও। ব্যাটারিচালিত নৌকা। তাই নদীর ওপারে পৌঁছাতে দু-তিন মিনিটের বেশি লাগলো না।
নদীর ওপারের নাম শিবগঞ্জ। সেখান থেকে একটি অটো সারাদিনের জন্য রিজার্ভ করলাম। শুরতেই গেলাম বিজয়পুরের চীনামাটির পাহাড়ে। যাওয়ার পথে একটু বৃষ্টি হলেও ওখানে পৌঁছানোর পর বৃষ্টি থেমে যায়। চীনামাটির পাহাড়ের সেই অসাধারণ দৃশ্য দেখে আমি থ। পাহাড়ের গায়ের কিছু পাথর সাদার সাথে গোলাপি মিশ্রিত। উপরে সবুজ গাছ-গাছালি, ঘাস। পাহাড়ের নিচের লেকটি সবুজ এবং নীলাভাব। সব মিলিয়ে এমন দৃশ্য যে দেখে কথা বলার ভাষা হারিয়ে যায়।
পাহাড়ের উপরে দেখা মিললো অনেক গাছ, ঘাস, কিছু ছাগল এবং কাদার। উপর থেকে চারদিক দেখতে পাচ্ছিলাম। বেশিরভাগ জায়গা সবুজ শ্যামল। চোখ জুড়িয়ে যায় সে দৃশ্য দেখলে।
যেহেতু কেবলই বৃষ্টি হয়েছে, তাই পাহাড়ে উঠবো কিনা এ নিয়ে একটু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। তবে সিদ্ধান্ত হলো যে পাহাড়ে আমরা উঠবো। পাহাড়ের উপরে দেখা মিললো অনেক গাছ, ঘাস, কিছু ছাগল এবং কাদার। উপর থেকে চারদিক দেখতে পাচ্ছিলাম। বেশিরভাগ জায়গা সবুজ শ্যামল। চোখ জুড়িয়ে যায় সে দৃশ্য দেখলে। পাহাড় থেকে কাদামাখা পায়ে নামলেও পাহাড় আমাকে যে দারুণ অভিজ্ঞতা দিলো তার সাথে এসব কিছুর তুলনা করা চলে না।
অটোতে করে আবারো শুরু হলো যাত্রা। এবার উদ্দেশ্য বিজয়পুর জিরো পয়েন্ট। জিরো পয়েন্ট থেকে ভারতের মেঘালয় পাহাড়কে আরও ভালোভাবে দেখা যায়। যেহেতু জিরো পয়েন্ট ভারতের বর্ডারের পাশে, তাই সেখানে দেখলাম ভারতের বিভিন্ন চকোলেট, সাবান বিক্রি হচ্ছে। এখানকার বিজিবি ক্যাম্পের পাশে সোমেশ্বরীর পাড়ে এসে দেখলাম নদীটি যেন কত বছর ধরে কত বাধা, বিপত্তি, ঝড়, বাদল সহ্য করে আসছে, তবুও তার তেজ এতোটুকু কমেনি।
তারপরের সময়টা ছিলো দুপুরের খাওয়ার জন্য। খাওয়া শেষে আমরা যাত্রা করি রানিখং সাধু জোসেফের গির্জার উদ্দেশে। কিন্তু গির্জার গেট বন্ধ থাকায় মনের মধ্যে আফসোস নিয়ে আমাদের সেদিনের শেষ গন্তব্য কমলা পাহাড়ে যাই। যদিও বৃষ্টি হচ্ছিলো তবু আমরা সেই বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ে উঠি। পাহাড় থেকে নেমে আবারও ফিরে আসি শিবগঞ্জ নৌকার ঘাটে। তারপর নদী পার হয়ে ফিরে আসি বিরিশিরিতে।
পরদিন আরেকটা বৃষ্টিভেজা সকাল দিয়ে দিন শুরু হয়। যদিও বৃষ্টি আমাদের বেড়ানোতে কোনোভাবে তেমন বাধা দিতে পারেনি। এই দিনটা ছিলো বিরিশিরিতে আমাদের শেষ দিন। সকালের নাস্তা শেষে হতেই একটি অটো নিয়ে চলি আসি দুর্গাপুর। সেখান থেকে আরেকটি অটো ঠিক করা হয়। সেই অটো আমাদের গোপালপুর এবং লেঙ্গুরা ঘুরিয়ে দেখাবে। প্রথমে গেলাম গোপালপুরে। সেখান থেকে মেঘালয় পাহাড় দেখা যায়। আশপাশে অনেক টিলার ছড়াছড়ি। তার মধ্যে দুটি টিলাতে উঠলাম। টিলার উপর একটি আদিবাসীদের বাড়িতে ঢুঁ মারা হলো।
এরপর আবার যাত্রা শুরু। উদ্দেশ্য কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরা। লেঙ্গুরায় আছে সাত শহীদের স্মৃতিস্তম্ভ। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ যোদ্ধাদের সমাধি আছে এখানে। সেখান থেকে আমি মেঘালয় পাহাড়কে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখি। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে লেঙ্গুরা নদী। আর স্মৃতিস্তম্ভের আশপাশ অনেক গাছ-গাছালি দিয়ে ভরা। আমরা নদীতে নেমে পা জলে ভেজাই। এসব শেষে শুরু হয় ফিরতি যাত্রা।
দুর্গাপুরে ফিরে সাগরদীঘি নামে একটি জায়গায় যাই। সেখানে এককালে দীঘি ছিলো। এখন আর নেই। তবে সেখান থেকে সোমেশ্বরী নদীর আরেক রূপ দেখলাম। নদীর অবস্থা ভালো নয়। দিনের পর দিন নদী থেকে বালু উত্তোলন করার কারণে চারদিকে বালু রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। রয়েছে বালু উত্তোলনের যন্ত্রও। এ যেন এক বিবর্ণ, ছেঁড়া-ফাটা নদী। নদীর পানি পড়ে রয়েছে নির্জীব অবস্থায়। সন্ধ্যা হতে হতেই গেস্টহাউজে ফিরি।
আবার এলো আরেকটি সকাল। আমাদের ঢাকায় ফেরার সকাল। আবারও সেই ব্যস্ত শহরে ফিরতে হবে। ফিরতে হবে একঘেয়েমির এক শহরে, যেখানে প্রকৃতিকে এতো কাছে পাবো না। ফেরার পথে নেত্রকোণা শহরটা এক চক্কর ঘুরে দেখা হলো। স্বাদ নিই ওই এলাকার বিখ্যাত বালিশ মিষ্টির। এটি একটি স্বল্পসময়ের ভ্রমণ হলেও এই ভ্রমণে আমার যেসব অভিজ্ঞতা হয়েছে তা কি আর কোথাও পাবো! এখন দূর থেকেই বলতে ইচ্ছে করে- সোমেশ্বরী, জেগে আছো?