কৃষণ চন্দরের শিশুরা

ভগবান বলেন, “নিজের সৃষ্টি দেখে যদি কেউ না হাসে, তবে সে ভগবান নয়।”

মো. ইয়াকুব আলীমো. ইয়াকুব আলী
Published : 24 May 2023, 11:16 AM
Updated : 24 May 2023, 11:16 AM

কৃষণ চন্দর (২৩ নভেম্বর ১৯১৪ – ৮ মার্চ ১৯৭৭) একজন ভারতীয় কথাসাহিত্যিক, তিনি উর্দু ও হিন্দি ভাষায় লিখতেন। তার লেখা ‘দাদর পুলের বাচ্চারা’ গল্পের বইটি যেন সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে রসিকতার অপর নাম। এতে গল্প আছে সাতটি। অর্ঘ দাশের অনুবাদে ১১৯ পৃষ্ঠার এ বইটি প্রকাশ করেছে কলকাতার দীপায়ন প্রকাশনী।

এ বইয়ের নামগল্পটা অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ। গল্পে স্বয়ং ভগবান একজন চরিত্র। গল্পের কথকের সঙ্গে তার দেখা হয় তার বস্তির ঘরে। তখন গল্প কথকের পেটে দু’দিন ধরে কিছুই পড়েনি। ভগবান এসেছেন শহরের শিশুদের অবস্থা দেখতে, কারণ শিশুরাই ভবিষ্যৎ। আর ভগবান সবাইকে শিশু করেই পৃথিবীতে পাঠান। তারপর তারা পৃথিবীর আলো হাওয়ায় বেড়ে ওঠে। আর ভগবান শিশুদের অবস্থা দেখার জন্য বস্তির একজনকে বেছে নেওয়ার কারণও বলেছেন।

এর আগে তিনি গিয়েছিলেন একজন ফিল্মস্টারের কাছে, কিন্তু তার হৃদয় থেকে তিনি কোন সুগন্ধ পাননি। তারপর গিয়েছিলেন একজন দালালের কাছে, কিন্তু তার চোখে তিনি লজ্জার চিহ্নমাত্র দেখেননি। তারপর গিয়েছিলেন একজন বারবণিতার কাছে, কিন্তু তিনি তার বুকে কোন শিশুর কলরব শুনতে পাননি। তারপর গিয়েছিলেন একজন পীরের কাছে, কিন্তু সেই পীর বেঁচে আছে দানের ওপর। তারপর গিয়েছিলেন একজন ধোপার কাছে, কিন্তু সে তার স্ত্রীকে অত্যাচার করে। 

ভগবান স্কুলে ভর্তি হতে গেলে প্রিন্সিপাল তার পিতার নাম ও পেশা জিজ্ঞেস করেন। কারণ পিতার পেশা থেকে ধারণা পাওয়া যাবে যে তারা এ স্কুলের ফিস দিতে পারবে কিনা!

তারপর ভগবান আসেন বস্তির এ গল্প কথকের কাছে। ছোট কলেবরের এ বইটার অর্ধেক অংশ জুড়েই আছে বইয়ের নামগল্পটা। এ গল্পে হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে নিরন্ন মানুষের জীবনের বাস্তব ছবি। আর ভগবানের বয়ানে তুলে ধরা হয়েছে তার স্বরূপ। শুরুতেই ভগবান কথককে নিয়ে খেতে যান একটা রেস্তোরাঁয়। সেখানকার খাবারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে- “তুমি এখনো বোম্বাইয়ের পাউরুটির পিস দেখনি। এতো মিহি ও পাতলা করে কাটা যে এদিক ওদিক দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। ওর ওপর একটু মাখন লাগিয়ে অনায়াসে শেভও করতে পারবে। আর ডিম? বোম্বাইয়ের মুরগির ডিম এতো ছোট যে ওই ডিমের ওমলেট খেতে গেলে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য নিতে হয়। বাকি থাকে এক কাপ চায়ের কথা। এই চায়ের কাপ এতো বড় যে চোখের জলও তাতে অতি কষ্টে ধরে।”

ভগবান এবং কথক শিশুরূপ নিয়ে নেমে পড়ে বোম্বাইয়ের রাস্তায়। কথক নেন একঝুড়ি পেয়ারা আর ভগবান নেন একঝুড়ি বই। তারপর মুদিদোকান দিতে গিয়ে তাদেরকে স্থানীয় মাস্তান থেকে শুরু করে পুলিশ সবাইকেই চাঁদা দিতে হয়। এতোকিছুর পরও যে বিষয়টা ভগবানকে অবাক করে সেটা হলো- কেউ একটাও বই কিনে না। এর ব্যাখ্যা হিসেবে কথক বলেছেন, “মা-বাবাদের স্কুলের বই কেনার পয়সা নেই, তারা তোমার গল্পের বই কিনবে কোথা থেকে। আর লেখাপড়ার বাস্তব অবস্থা আরও ভয়াবহ।”

ফুটপাতের একজন হকারের ভাষায়, “আমরা যদি ঠিকমতো স্কুল কলেজে যেতাম, তাহলে আমি বিএ পাশ হতাম, শরীফ হতো এনট্রান্স পাশ। এই গোরখা যদি স্কুলে যেতো তাহলে আজ ও মেয়েদের ওড়না বিক্রি না করে স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত।” শহরের শিশুরা বরং পড়াশোনা বাদ দিয়ে সব রকমের খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িত। এমনকি বয়সের তুলনায় তারা এমনসব খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িত যে ভগবান সেটা বিশ্বাসই করতে চান না।

আরও আছে শ্রেণি-বৈষম্য। শহরের একপ্রান্তে যখন শিশুরা জীবনের নূন্যতম মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত তখন অন্যপ্রান্তে শিশুরা বেড়ে উঠছে একেবারে আদর্শ পরিবেশে, জীবনের সব অধিকার সম্পূর্ণ ভোগ করে। সেখানে ভগবান ভর্তি হতে গেলে প্রিন্সিপাল তার পিতার নাম ও পেশা জিজ্ঞেস করেন। কারণ পিতার পেশা থেকে ধারণা পাওয়া যাবে যে তারা এ স্কুলের ফিস দিতে পারবে কিনা!

এছাড়া শহরের একপ্রান্তে শিশুদের দিয়ে ভিক্ষা করানো হয়। সেই প্রক্রিয়াটা গা শিউরে ওঠার মতো। ভিক্ষুক শিশু ভিকির ভাষায়, “লোকে স্বাস্থ্যবান বাচ্চাদের ভিক্ষা দেয় না। সুস্থ সবল সম্পূর্ণ শিশুর প্রতি কেউ দয়া দেখায় না। তবে হ্যাঁ, যদি কোন বাচ্চার পা ভাঙা হয় বা হাত না থাকে, বা যদি অন্ধ হয়, তাহলে লোকে তাদের দেখে দুঃখ পেয়ে পয়সা দেয়। এ ধরনের ভিকিরি বাচ্চারা প্রচুর রোজগার করে।” এভাবেই শিশুগুলো বোম্বাইয়ের লাভের চাকার সঙ্গে বাঁধা পড়ে যায়। 

“ওহে সরল মতি ঈশ্বর- ওরা তোমার পূজা করে না, নিজের মনোবাসনাকে পূজা করে।”

ভগবানের নিজের স্বরূপ এবং মনস্তত্ত্ব নিয়েও বিস্তারিত আলাপ করা হয়েছে এ গল্পে। ভগবান বলছেন, “কখনো মনে হয় আমি একটা আগুন... তারপর আমি হলাম জল... তারপর আমি হলাম সূর্য... কখনো আমি একটা গাছ... কখনো একটা সাপ... কখনো একটা পাথরের স্তুপ... আমার এতো নাম, এতো বাসনা, আমাকে ঘিরে এতো ভয়। তারপর মানুষ ভয়কে জয় করলো। আমিও অনেক উপরে উঠে গেলাম। আমি গাছ, পাথর, জল থেকে মহাশূন্যে পালিয়ে গেলাম, এবার আমি রূপ, স্থান, নামবিহীন কেবল এক শক্তি।”

ভগবান কি আসলে মানুষ? এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, “মানুষ? তার মানে খুনিও আক্রান্ত। ভ্রমর আবার ফুলও। বার্ধক্য এবং যৌবন। জীবন এবং বলিদান। হৃদয় আবার সখ্যতা। ঘৃণা আবার শত্রুতা। সভ্যতা আবার অসভ্যতা, দেবদূত আবার শয়তান, মানুষ।” ভগবান নিজের রসবোধের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন, “নিজের সৃষ্টি দেখে যদি কেউ না হাসে, তবে সে ভগবান নয়।”

ভগবানের পূজার বিষয়ে বলা হয়েছে, “ওহে সরল মতি ঈশ্বর- ওরা তোমার পূজা করে না, নিজের মনোবাসনাকে পূজা করে।” আর ভারতবর্ষে ভগবানের পূজা করার ব্যাপারে বলা হয়েছে, “এখানে প্রতি পদে পদে মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরুদ্বার। আমরা ভগবানের সবথেকে বড় উপাসক ও পূজারী। আমরা আমাদের ঈশ্বরের জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারি।”

তারপরের গল্প ‘আলুচে’ এর বিষয়বস্তু সময়ের সঙ্গে কাশ্মীরের একটা বদলে যাওয়া গ্রামের।  ‘ভক্ত সুদামা’ গল্পটা একজন বিশ্বাসী মানুষের, যে বিশ্বাস করে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খারাপ সময় বদলে ভালো সময় আসবে। ‘একই প্রত্যাশা’ গল্পটা একজন মেয়ের হাত বদলের গল্প। ছ’বছর বয়সে তার বাবা-মা অভাবে পড়ে তাকে বিক্রি করে দেন। তারপর বিভিন্ন হাত ঘুরে একসময় সে চলচ্চিত্র জগতের প্রতিষ্ঠিত নায়িকা হয়ে উঠেন।

‘বিলাস’ গল্পটা একজন মধ্যবিত্ত কেরানির যে জীবনের একটা পর্যায়ে এসে নিজের জন্য কিছুটা সময় বের করে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ে। ‘পবিত্র’ গল্পটা একেবারে আমাদের আধুনিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। ‘দিল দৌলত ঔর দুনিয়া’ একেবারেই মনস্তাত্ত্বিক একটা গল্প। আমরা আসলে কিসে সুখ খুঁজে পাই সেটা কি আমরা জানি! আবার আমাদের সবার সুখের ঠিকানা কি একই?

কৃষণ চন্দরের অপূর্ব লেখনীর গুণে প্রত্যেকটা গল্পই হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য। প্রাত্যহিক জীবনের ভেতর এবং বাহিরের রূপের রয়েছে পুঙ্খানুপুঙ্খ বণর্না। সেখানে প্রকৃতি থেকে শুরু করে মানুষ, সামাজিকতা, অর্থনীতি সবকিছুই উঠে এসেছে। ভগবানের বিশ্বাসের স্বরূপ অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে। বইয়ের নামগল্পের কয়েকটা বাক্য দিয়ে লেখাটা শেষ করতে চাই, “জীবনে শেষবারের মতো আমি যখন ভগবানকে দেখলাম তখন তিনি ছ’বছরের এক অন্ধ দুর্বল শিশু, সন্ধের লাল সূর্যালোকের প্রেক্ষাপটে দু’হাত ছড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি পুলের ওপর ভিক্ষা চাইছেন।”