এটি বিশ্বের টিকে থাকা বৃহত্তম প্রাসাদের মধ্যে একটি।
Published : 31 Aug 2023, 12:58 PM
ইস্তাম্বুল শহরে প্রবেশ করেই মনে হয়েছে মিশর, গ্রিস, রোম, স্পেন আর চেক রিপাবলিকের কথা। বিশেষ করে শহরজুড়ে প্রত্নস্থাপনা আর পাথুরে সড়কগুলো দেখে। মনে মনে ভাবছিলাম রাস্তাগুলো একদম ইউরোপের মতো। পরে নিজেকে সংশোধন করলাম, আসলে ইউরোপের সড়ক ইস্তাম্বুলের মতো।
১২৯৯ থেকে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ৬২৪ বছর এশিয়া ও ইউরোপ শাসন করেছে উসমানি শাসকরা। ৫২ লাখ বর্গকিলোমিটারের সাবেক উসমানি সাম্রাজ্য বর্তমানে ৪৯টি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তুরস্কের রাজধানী শহরে এসে উসমানি সাম্রাজ্যের আবাসস্থল না দেখা, রীতিমত অপরাধ!
তোপকাপি প্রাসাদ একটি স্থাপত্য বিস্ময় যা অটোমান সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের কথা বলে। এ প্রাসাদের রান্নাঘরে প্রায় ১ হাজার ২০০ চীনামাটির তৈজসপত্রের একটি সংগ্রহ রয়েছে, যার মধ্যে চীন থেকে আসা একটি সেলাডন বাটি রয়েছে যেটি খাবারে বিষ মেশানো থাকলে রঙ পরিবর্তন করবে। তোপকাপি প্রাসাদটি বিশ্বের টিকে থাকা বৃহত্তম প্রাসাদের মধ্যে একটি এবং সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদের আদেশে ১৪৬০ থেকে ১৪৭৮ সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল।
প্রাসাদটি প্রায় চার শতাব্দী ধরে অটোমান সুলতানদের আবাসস্থল হিসেবে কাজ করেছে। এটি রাজ্যের প্রশাসনিক এবং শিক্ষামূলক সদর দপ্তরও ছিল। মেহমেদের মৃত্যুর পর প্রায় ৩০ জন সুলতান রাজপ্রাসাদ থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন এবং একাধিকবার পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করেছেন। ইসলামিক, ইউরোপীয় এবং অটোমান স্থাপত্যশৈলীর একটি অনন্য মিশ্রণ এ তোপকাপি প্রাসাদ। এটি উসমানি সুলতানদের ঐশ্বর্য আর সৌন্দর্যপ্রিয়তার কিংবা বিলাসিতার কথাই বলে।
প্যালেসের অনেকগুলো অংশ রয়েছে- যেমন মূলপ্রাসাদ, গেট রয়েছে ৪টি, রান্নাঘর, পার্লামেন্ট সেকশন, বেকারি আইটেম বানানোর জায়গা, লাইব্রেরি আর হারেম। ট্রেজারি সেকশনে রয়েছে হীরা, মুক্তা, পান্নার মুকুট, তরবারি, নেকলেস আর সোনার বিশাল কয়েকটি সিংহাসন। এর মধ্যে একটি সিংহাসন রয়েছে যা ২৫ হাজার মুক্তা আর সোনার পাতে মোড়ানো। এটি নাদিরশাহ সুলতান মেহমুদকে উপহার দিয়েছিলেন। এর মূল্যমান আমাদের কল্পনার বাইরে। বিশ্বের সব থেকে বড় ডায়মন্ড শোভা পাচ্ছে ট্রেজারি অংশে। জাদুঘরে আছে ক্যালিগ্রাফি, পেইন্টিং আর বিভিন্ন ধরনের ঘড়ি। হীরা বসানো বড় একটি ঘড়ি আছে যা রাশিয়ার জার নিকোলাস সুলতান মজিদকে উপহার দিয়েছেন।
১৯২৪ সালে এই প্যালেসকে জাদুঘরে পরিণত করা হয়। গেট দিয়ে প্রবেশ করার সময় ৫০০ বছর আগের কথা ভাবার চেষ্টা করলাম। সেটি আমার কল্পনার বাইরে। সুলতানের জীবনযাপন, প্রাসাদ, ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিজের চোখে দেখলেও আমার কাছে রূপকথা মনে হয়। আমি যে সময়টাতে গেছি, সেটি মহামারী পরবর্তীকাল। ইস্তাম্বুলের প্রতিটি পর্যটনকেন্দ্র লোকে লোকারণ্য। পুরো প্রাসাদ কমপ্লেক্স দারুণ মায়াময়, চারদিকে উদ্ভিদ, ফুল আর সবুজ ঘাস। ঘাসগুলো দেখে মনে হচ্ছিল- নিজের গা এলিয়ে দিই। অডিয়েন্স চেম্বার, সুলতান আহমেদ লাইব্রেরি, ট্রেজারি বিল্ডিং আর টাওয়ার অব জাস্টিস। এক বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে প্রবেশ করছি আরেক বিল্ডিং-এ। রাজপোশাকগুলো এত বড় হয় কী করে! সোনার প্রলেপ দেওয়া ৬৪ কেজি ওজনের মোমদানি, এও কি সম্ভব!
ইসলামিক জাদুঘরে প্রবেশের সময় নারী পর্যটকদের মাথা ঢেকে ঢুকতে হয়। প্রায় ৩০ মিনিট লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে জাদুঘরে প্রবেশ করলাম। এ জাদুঘরে আছে মহানবীর চুল এবং উহুদের যুদ্ধে হারানো ওনার একটি দাঁত। হজরত দাউদ (আ.)-এর ব্যবহৃত তরবারি, হজরত ইউসুফ (আ.)-এর পাগড়ি, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ব্যবহৃত জোব্বা, মা ফাতিমার পোশাক, বিভিন্ন সাহাবির ব্যবহৃত পাগড়ি ও অস্ত্র। কিন্তু ছবি তোলা এখানে একেবারে নিষেধ। দেশে ফিরবার পর অনেক পর্যটক বলেছেন, ওনারা ছবি তুলতে পেরেছেন। হারেমখানা নিয়ে বিশ্বব্যাপী নানা জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। মূলত সুলতান আহমেদের সময় থেকে হারেমখানার সূচনা হয়। এখানে ছিলো ৪০০ কক্ষ। এসব কক্ষে থাকতেন সুলতান আহমেদের মা, স্ত্রীরা, ছোট ছেলেমেয়ে এবং দাসীরা।
হারেমে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত ছিল। সুলতান, যুবরাজ এবং নিকট আত্মীয় নারীরা ছাড়া কেউ হারেমে প্রবেশ করতে পারতো না। কিন্তু হারেমকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়। আক্ষেপ করে বলছিল আমার গাইড। ট্রেজারি সেকশনে দুটো মূল্যবান জিনিস দেখবার জন্য দাঁড়াতে হয় বিশাল লাইনে। সেই দুটো বিষয়ের কথা কিছুটা বিশদ বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। ইস্তাবুল শহরে তোপকাপি প্যালেসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু হলো একটি পান্নাখচিত খঞ্জর।
১৯৬৪ সালে তৈরি আমেরিকান চলচ্চিত্র ‘টোপকাপি’ দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ছবিটির গল্প ইস্তাম্বুল শহরকে ঘিরে এবং শিল্পচোরদের একটি দলের সঙ্গে সম্পর্কিত যারা তোপকাপি মিউজিয়ামের ট্রেজারিতে প্রদর্শন করা অমূল্য পান্নাখচিত খঞ্জর চুরি করার অবিশ্বাস্য পরিকল্পনা করে। ‘টোপকাপি’ সারা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি থিয়েটারে দেখানো হয়েছিল। তারপর থেকেই ইস্তাম্বুলে আসা বিদেশিরা তোপকাপিতে পান্নাখচিত খঞ্জর দেখতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এ খঞ্জর কখন তৈরি করা হয়েছিল? এটি তোপকাপি প্রাসাদে প্রবেশ করল কীভাবে? এর মূল্য আসলে কী রকম! নাদির হান নামে আভসার গোত্রের একজন তুর্কি ইরানের সাফেভি রাজবংশকে উৎখাত করে এবং শাহ নাদির হিসেবে ইরানের সিংহাসন গ্রহণ করে। সেসময় বিশ্বে রাজ্য বিজয়ের একটি দুর্দান্ত ধারাবাহিকতা শুরু করেছিল তুর্কিরা। রত্নখচিত খঞ্জরটি ছিল অন্য অনেক মূল্যবান উপহারের মধ্যে একটি, যা ইরানে সুলতান মাহমুদ প্রথম (১৭৩০-৫৪) বিজয়ী নাদির শাহকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু খবর পাওয়া যায় যে, নাদির শাহকে হত্যা করা হয়েছে, যখন দূত অটোমান সাম্রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করে কেবল ইরানের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। রত্নখচিত খঞ্জরসহ উপহারগুলো তারপর ইস্তাম্বুলের কোষাগারে ফেরত আনা হয় এবং শেষ পর্যন্ত তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরে কোষাগারের অন্যতম সম্পদে পরিণত হয়। এ খঞ্জরকে শৈল্পিক ঐতিহ্যের একটি মাস্টারপিস হিসেবে ধরা হয়, যা ১৭ শতকের অটোমান সাম্রাজ্যকে একটি উচ্চ মর্যাদায় পৌঁছে দেয়।
আমি যত সহজ করে গল্পটি বললাম বিষয়টি একদমই সরল নয়। পান্না পাথর সংগ্রহ, সেগুলো হাত বদল হয়ে স্প্যানিশদের কাছ থেকে অটোম্যানদের কাছে যাওয়া। একটি খঞ্জর মূল্যবান কিছু পাথর দিয়ে তৈরি করা, দারুণ জটিল একটি প্রক্রিয়া। সমস্ত তথ্য আমাকে গল্পের মতো করে বলেছে আমার গাইড রিজেল।
তোপকাপি প্যালেসের দ্বিতীয় আকর্ষণীয় বস্তুটি হলো একটি মূল্যবান পাথর। এর নাম ‘স্পুনমেকার’স ডায়মন্ড’, এটি ৪৯টি পুরনো খনিকাটা হীরার একটি দ্বি সারিবেষ্টিত পাথর। এর উৎস একটি ক্লাসিক রহস্য। অন্যান্য অনেক ঐতিহাসিক হীরার মতো এই পাথরের ক্ষেত্রেও উপকথা কিংবা কিংবদন্তি থেকে সত্যকে আলাদা করা কঠিন। কেউ নিশ্চিত নয় যে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম হীরাটি আবর্জনার স্তূপে পাওয়া গেছে নাকি নেপোলিয়নের মায়ের হাত হয়ে নানা ঘটনা প্রবাহে এসে পৌঁছেছে তোপকাপি রাজপ্রাসাদে!
কীভাবে অবিশ্বাস্য ‘স্পুনমেকার’স ডায়মন্ড’ ইস্তাম্বুলের তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরে এলো? জাদুঘরের রেকর্ডে এটিকে ১৭ শতকের চতুর্থ সুলতান মোহাম্মদের নামে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ডায়মন্ডের উৎপত্তি সম্পর্কে বেশ কয়েকটি ভিন্ন উপকথা বিদ্যমান। সবচেয়ে জনপ্রিয় সংস্করণটি উসমানিয় আদালতের সরকারি ইতিহাসবিদ মোহাম্মদ রাশিদের হাতে লেখা এবং কিছুটা এরকম- একজন দরিদ্র জেলে ইস্তাম্বুলের কাছে উপকূলে অলসভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, যখন সে একটি বড় চকচকে পাথর দেখতে পেল, সেই পাথর তুলে নিয়ে নিজের পকেটে রাখলো।
কয়েকদিন পকেটে রাখার পর, তিনটি চামচের বিনিময়ে জেলে এক চামচ ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে। স্পুনমেকার তারপর এটিকে একজন রত্নব্যবসায়ীর কাছে নিয়ে যায়, সেই রত্নব্যবসায়ী ১০টি মুদ্রার বিনিময়ে কিনে নেয় পাথরটি। রত্নব্যবসায়ী এটি একজন সহযোগী জুয়েলারকে দেখালেন এবং তারা আবিষ্কার করলেন যে এই গোলাকার পাথরটি আসলে একটি হীরা। উভয় জুয়েলার্সই এর মালিকানা নিয়ে বিবাদে লিপ্ত হলো এবং যখন প্রাসাদের প্রধান জুয়েলার এটির কথা শুনেছিলেন, তিনি উভয় জুয়েলারকে হীরা কেনার জন্য অর্থ দিয়েছিলেন।
নটে গাছটি মুড়োলো, গল্প কি তবে এখানেই ফুরালো! একদম নয়! হীরার গল্প চলতে থাকে। ১৭ শতকে এটি যায় আলি পাশার দখলে, তারপর সুলতান চতুর্থ মেহমেদের কুক্ষিগত হয়। কিংবদন্তি আছে নেপোলিয়নের মাকে নিয়েও। এই হীরা একসময় নেপোলিয়নের মায়ের কাছেও ছিল। তারপর এই রত্ন তুর্কিদের তোপকাপি প্যালেসে এলে ডিজাইনারদের দ্বারা প্রক্রিয়াজাত করা হয় এবং আবিষ্কৃত হয় ৮৬ ক্যারেটের অনন্য টুকরো এটি।
ভিড় ঠেলে কোনরকম একটি ছবিই তুলতে পেরেছিলাম রত্নটির! প্রায় গোটা দিন অতিবাহিত হলো তোপকাপি প্রাসাদ দেখতে। কিছুটা ক্লান্তও লাগছিল, পেটে কিছু যায়নি বহুক্ষণ হলো। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে খাবারের খোঁজে গেলাম!