Published : 29 Jul 2023, 11:49 PM
ওয়াচ টাওয়ারে যাওয়ার রাস্তাটা একটা হিজল আর করচ বাগানের ভেতর দিয়ে। শুনসান, ছায়াময়। খুব পছন্দ হয় সবার। শীত হওয়ায় বনের নিচটা শুকনো। কিছু পুরনো পাতা পড়ে আছে গাছগুলোর নিচে। মম-সিঁথি প্রচুর ছবি তুলছে। ওরা সিদ্ধান্ত নেয়- দুপুরের খাবারটা ওরা হিজল-করচের ছায়াময় এই বনেই সারবে।
বিশাল ওয়াচ টাওয়ারের কাছে পৌঁছে যায় ওরা। তারপর সিঁড়ি বেয়ে টাওয়ারের সর্ব্বোচ্চ তলায়। চোখের সামনে বিশাল বাইক্কা বিল। হাজার হাজার পাখির ওড়াউড়ি। অন্য একটা জগৎ। নানা ধরনের লতা আর জলজ গুল্মে ভরপুর। ভালো লাগায় মন ভরে যায় সবার। টাওয়ার, টাওয়ারের নিচ, বিলের পাড়ে প্রচুর ছবি তুলে সবাই। তারপর ফিরে আসে জারুল বনে।
চমৎকার একটা জায়গা বেছে নিয়ে চাদর বিছান চান্দুমামা। তারপর তাদের মিনি পিকনিক শুরু হয়। খাবারের পরই মম-সিঁথি-কুমু-মুমু আর টুসির গান। চান্দুমামা সব ভিডিও করে রাখেন, একটা অপূর্ব স্মৃতি হিসেবে। সূর্য ডুবতে আর বেশি দেরি নেই। পাখিরা তাদের অস্থায়ী নীড়ে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাইক্কা বিলের পানিতে সূর্যের কমলা আভা। টুটন কাকু গাড়িতে স্টার্ট দেন। গাড়ি শ্রীমঙ্গলের পথে যাত্রা শুরু করে।
শ্রীমঙ্গল শহরের সবচেয়ে বড় মাছের আড়তদার মজম্মিল মিয়া। সারাক্ষণ দাবড়ে বেড়াচ্ছে হাওরের মাছ ধরা জেলেদের। ওর দাপটে শান্তিতে নেই মৎস্যজীবীরা। সারারাত জেগে মাছ ধরে সকালে ওর পোষা পান্ডাদের জন্য শান্তিতে মাছ বিক্রি করার উপায় নেই। জেটিঘাট, কাশীপুর ঘাট তো বটেই, অন্যান্য ছোট ছোট ঘাটও তার লোকদের দখলে। জোর জবরদস্তি করে ওরাই মাছের দখল নিয়ে নেবে। তারপর দ্বিগুণ দামে আড়ত থেকে বেচবে।
মজম্মিল মিয়ার হাত অনেক লম্বা, তাই কেউই ওর বিপক্ষে যেতে চায় না। ওর দয়ায় যা পাচ্ছে জেলেরা তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। সারা হাইল হাওরে যখন মাছের আকাল তখন বাইক্কা বিল অভয়াশ্রম গড়ে ওঠে। গত কয়েক বছর ধরে হাওরে মাছের উৎপাদন বাড়ানোতে বাইক্কা বিল বড় একটা ভূমিকা রাখলেও সম্প্রতি বাইক্কা বিল লুটের ঘটনায় মজাম্মিল মিয়ার জড়িত থাকাটা উড়িয়ে দিচ্ছে না কেউই।
চান্দুমামার পুরনো বন্ধুদের মতানুযায়ী বাইক্কা বিলের আশপাশের গ্রামেও মজাম্মিলের চর রয়েছে। ওরাই রাতে বাইক্কা বিলসহ রিজার্ভ বিলগুলোর মাছ চুরি করে। অন্য বিলের যাই হোক, বাইক্কা বিলের মা মাছ ধরা পড়লে ভবিষ্যতে বিশাল হাইল হাওরে দেশিমাছের অস্তিত্ব থাকবে না। চান্দুমামা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন বলেই তার দুশ্চিন্তা বেশি।
প্রশাসন মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছে। অনেকগুলো এনজিও এ বিষয়ে নিয়মিত কাজ করছে। সাধারণ মানুষ এটা বুঝলেও ‘চোর না শুনে ধর্মের কাহিনি’। মজম্মিল আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা ঠিকই রাতের আঁধারে দিব্যি মাছ চুরি করছে। প্রশাসন অনেক চেষ্টা করেও কোনভাবেই এটা থামাতে পারছে না। চান্দুমামা সমাধানের কোন রাস্তা খুঁজে পান না। শ্রীমঙ্গলে ক্ষতিকর এই মৎস্য সিন্ডিকেটের হাত থেকে বাইক্কা বিল কি বাঁচানোর কোন উপায় নেই!
কোন সমাধান বের করতে পারলেন মামা? গিট্টুর প্রশ্নে বাস্তবে ফিরে আসেন চান্দুমামা।
নারে! বিষয়টা জটিল। মানুষ তো সচেতন নয়। প্রশাসনের সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু মানুষ যদি বাইক্কা বিলের উপকারটা কী এটা বুঝতো, তাহলে নিজেরাই সমাধান করে ফেলতে পারতো। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। তুই ইলিশের ব্যাপারটা দেখ। ডিমওয়ালা মা মাছ আর জাটকা নিধন বন্ধ করতে সরকারকে একটা বিশাল উদ্যোগ নিতে হচ্ছে প্রতিবছর। একই দৃষ্টিকোণ থেকে বাইক্কা বিলকে না দেখলে চলবে?
কিন্তু এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের বাইরে কিছু এনজিও ছাড়া কেউ নেই। ফলে মৎস্য সিন্ডিকেট তাদের কাজ করে যাচ্ছে। কিছু নগদ টাকা পাওয়া যাচ্ছে বলে ওদের সাথে কিছু মানুষ জুটে গেছে। রাতের বেলা বাইক্কা বিলের চারপাশে এবং বিলে পাহারা বসানো ছাড়া কোন উপায় নেই। এ কাজে স্থানীয় প্রশাসনের সামর্থ্যও নেই। অতএব......। প্রচণ্ড হতাশা ঝরে পড়ে চান্দুমামার কণ্ঠে।
মামা আমি কি একটু চেষ্টা করে দেখতে পারি?
তুই? তুই কী করতে পারবি? এটা ছোট ব্যাপার নারে গিট্টু! মাছ চোরদের গ্রুপটা বিশাল। তোর পক্ষে এদের বিপক্ষে কিছু করা খুবই কঠিন।
মামা মানুষের পক্ষে খোলা চোখে যেটা কঠিন, ভূতদের পক্ষে সেটা কঠিন তো না-ও হতে পারে। আমি চেষ্টা করে দেখতে তো পারি!
তা পারিস। তবে সেটা গোপনে এবং সাধারণ মানুষের ক্ষতি না করে।
ওকে চেষ্টা করে দেখি মামা।
ওকে ভাগনে। তবে সাবধান।
ঠিক আছে মামা।
রাতের বেলা গিট্টু তার ঢাকার দুই বন্ধু তিড়িং-বিড়িং আর খালাতো ভাই মিট্টুকে শ্রীমঙ্গল আসতে বলে। ভূতদের তো আর আমাদের মতো গাড়ি-ঘোড়ার ব্যাপার নেই। যেখানে ইচ্ছে সেখানে যখন-তখনই উপস্থিত হতে পারে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তিড়িং-বিড়িং আর মিট্টু শ্রীমঙ্গল এসে উপস্থিত।
প্রচণ্ড শীতে জবুথবু শ্রীমঙ্গল। সন্ধ্যার পরপরই রাস্তায় লোক চলাচল কমে গেছে। গাঢ় কুয়াশার চাদরে ঢাকা চারপাশের প্রকৃতি। আকাশে চাঁদ থাকলেও তা বুঝার উপায় নেই। এক ধরনের ঘোলাটে ভাব চারদিকে। চারজন মিলে পদ্মপুকুরে পূর্ব পাশের উঁচু চারা জমিতে বিছানো খড়ের গাদার উপর বসে বিষয়টা নিয়ে আলোচনায় মাতে। চান্দুমামার কাছ থেকে যা জেনেছে গিট্টু সবকথা তিনজনকে জানায়। বাইক্কা বিলে একটা বড় অপারেশন হবে সহসাই। এ সিদ্ধান্তে একমত হয় চার বাচ্চা ভূত।
চান্দুমামার ছুটি শেষ হয়ে এলো বলে। এদিকে কিছুই করা গেলো না। মামা তার প্রিয়বন্ধু অবিনাশের সাথে কথা বলেন। দীর্ঘ আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত হয় না। আসলে বালুমহাল থেকে বালু চুরি, গাছমহাল থেকে গাছ চুরি কিংবা বাঁশমহাল থেকে বাঁশ চুরি ঠেকানো কঠিন। মহালগুলো লিজ হয়ে যাওয়ার পর লিজ গ্রহণকারীরই দায়িত্ব চুরি ঠেকানো। রিজার্ভ ফরেস্ট কিংবা মাছের অভয়ারণ্য থেকে মাছ চুরি বন্ধ করা প্রশাসনের দায়িত্ব। কিন্তু কথা একটাই ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা’ বাঁধবে কে?
প্রশাসনের অর্থ, লোকবল কোনটাই নেই এ কাজ করার জন্য। অতএব যা হবার তাই হবে। লোভীদের খপ্পরে পড়ে শেষ হয়ে যাবে দেশের সম্পদ আর ভবিষ্যৎ। চান্দুমামা তবুও হাল ছাড়েন না। স্থানীয় প্রেস ক্লাবের সদস্যদের বুঝান এটার গুরুত্ব। সাংবাদিকরা সায় দেন। কিন্তু তাদের পক্ষে রিপোর্ট কিংবা রিপোর্টের ফলোআপ করা ছাড়া আর কী করার আছে! টিভি সাংবাদিকরা কয়েক মিনিটের ভিডিও প্রতিবেদনে বিষয়টা তুলে ধরতে পারেন। এটুকুই। চান্দুমামা হতাশা থেকে মুক্ত হতে পারেন না।
চলবে…